দেশজুড়ে লকডাউনে রাজপথ যখন শান্ত, যুদ্ধ তখন জমে উঠেছে অনলাইনে। একটি দেশি ফল নিয়ে গত এক মাসে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন নেটিজেনরা।
বেলে দোআঁশ ও পলি মাটিতে জন্মানো গ্রীষ্মকালীন ফল বাঙ্গি নিয়েই এই মুখোমুখি অবস্থান। বিতর্কের আশু সুরাহার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
একটি পক্ষ বাঙ্গির নানান গুণ বর্ণনায় মেতেছে, আর আরেক পক্ষ ফল হিসেবেই মানতে চাচ্ছেন না। বাঙ্গির পক্ষে-বিপক্ষে রীতিমতো দুটি গ্রুপ তৈরি হয়েছে ফেসবুকে। ১৫ এপ্রিল থেকে এই দুটি গ্রুপে সক্রিয় কয়েক হাজার সদস্য।
বাঙ্গির গুণে মুগ্ধ যারা
বাঙ্গিকে অতি পছন্দ করেন, এমন কয়েক হাজার ফেসবুক ব্যবহারকারী যোগ দিয়েছেন ‘বাংলাদেশ বাঙ্গি জনপ্রিয়করণ সমিতি- BABA JOSH’ নামের গ্রুপে। এই ফেসবুক গ্রুপের সদস্য এখন ৪ হাজার তিন শ। গ্রুপের সদস্যরা বাঙ্গিকে জনপ্রিয় ফল হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চান।
বাংলাদেশ বাঙ্গি জনপ্রিয়করণ সমিতি- BABA JOSH’ নামের ফেসবুক গ্রুপে সদস্য ৪ হাজারের বেশি
গ্রুপটি সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘এ প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের বেশিরভাগই বৈচিত্র্য পছন্দ করে না। হাতে গোনা কয়েকটা বিদেশী ফল চিনে। তা নিয়েই সন্তুষ্ট। মূলত বাঙ্গি একটি রূপক, আন্দোলনটা আসলে আমাদের হারিয়ে যাওয়া দেশীয় ফলগুলোকে লাইমলাইটে ফিরিয়ে আনা নিয়ে। তাছাড়া দেশীয় ফল ও কৃষিপণ্যের উপর চলমান কুৎসা রটনা নিবারণ, আত্মপরিচয় সংকট নিরসন ও হীনমন্যতা দূরীকরণও আমাদের লক্ষ্য।’
বাংলাদেশ বাঙ্গি জনপ্রিয়করণ সমিতির অ্যাডমিন অপু নজরুল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বাঙ্গি যদি জনপ্রিয়ই না হবে তাহলে বাজারের এত বাঙ্গি কোথায় যায়। আসলে গ্রুপটা খোলা হয়েছে রূপক অর্থে। এ প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের বেশিরভাগই বৈচিত্র্য পছন্দ করে না। হাতে গোনা কয়েকটা বিদেশি ফল চেনে। তা নিয়েই সন্তুষ্ট। মূলত বাঙ্গি একটি রূপক, আন্দোলনটা আসলে আমাদের হারিয়ে যাওয়া দেশীয় ফলগুলোকে লাইমলাইটে ফিরিয়ে আনা নিয়ে।’
অপু নজরুল আক্ষেপ করে বলেন, ‘একটা প্রজন্ম বাঙ্গি না খেয়েও বাঙ্গি নিয়ে ট্রল করে। আসলে সেই জায়গা থেকেও তারা জানতে পারবে বাঙ্গি নিয়ে। আমার এই গ্রুপ খোলার পর আরেকটি গ্রুপ খোলা হয়েছে। সেখানে ফলটি বিলুপ্তির কথা বলা হয়েছে। এতে কিন্তু আমি অনেক বেশি খুশি হয়েছি। ওখানেও অনেকে যোগ দিচ্ছে। তারাও বাঙ্গির পক্ষে কথা বলছে। নেতিবাচিক কোনো কিছু থেকে যদি ভালো কিছু হয় তবে সেটাই ভালো।’
এই গ্রুপের একজন সদস্য মন্তব্য করেছেন, ‘বাবাজোসের রাজনৈতিক সংগঠনের নাম হতে পারে হেফাজতে বাঙ্গি! আর এর মূলনীতি হবে, “বাঙ্গি লাভার জনগণ, বাঙ্গি হেফাজতে সারাজীবন!” আরও কিছু হয় কিনা জানান’
আরেকজন কয়েক কৃষকের ছবি দিয়ে মন্তব্য করেছেন, ‘যারা বাঙ্গি নিয়ে নেতিবাচক গ্রুপ বানিয়েছে তারা কৃষকের শত্রু, দেশের শত্রু। বাঙ্গি খান কৃষক বাঁচান’
একজন লিখেছেন, ‘বাঙ্গীর ভূবনে আমি প্রেম উদাসী, যতই খাই ১মবার বাঙ্গী খাওয়ার সাধ ২য় বার হয়নি আর হবে না।
ঠিক ১ম প্রেমের মত—’
বাঙ্গি বিলুপ্তির দাবিতেও শক্ত অবস্থান
বাংলাদেশ বাঙ্গি জনপ্রিয়করণ সমিতির ঠিক বিপরীত অবস্থান নিয়ে বাঙ্গি বিলুপ্তির দাবি তুলেছেন আরেকটি ফেসবুক গ্রুপের সদস্যরা। ‘বাংলাদেশ বাঙ্গি বিলুপ্তকরণ সমিতি– বাবাবিস’ নামের এই গ্রুপের সদস্য ৪ হাজার সাত শ। গ্রুপের অ্যাবাউট অংশে বলা হয়েছে, ‘বাঙ্গি নামের অখাদ্য, ফলরূপী ইম্পোস্টর দুর্গন্ধবোমা থেকে মানবসমাজকে উদ্ধার করতে আমাদের এই উদ্যোগ।’
'বাংলাদেশ বাঙ্গি বিলুপ্তকরণ সমিতি– বাবাবিস’ নামের ফেসবুক গ্রুপে সদস্য প্রায় ৫ হাজার
বাবাবিসের অ্যাডমিন আবদুল্লাহ আল মাহমুদ জানান, বাঙ্গি তার এক বন্ধুর তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকেই এই গ্রুপের জন্ম।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্রথমে বাঙ্গি জনপ্রিয়করণ গ্রুপটি করা হয়। সেটা দেখে আমাদের গ্রুপের আরেক এডিমিন ইসতিয়াক আকিবের ছোটবেলায় বাঙ্গি খাওয়ার কথা মনে পড়ে। বাঙ্গির যে গন্ধ তা নিয়ে বিরক্তি থেকেই আসলে এই গ্রুপের যাত্রা। তবে নেহাত মজা করার উদ্দেশ্যে এমন করা হয়েছে। এই যে একটা নেগেটিভ প্রচার চলছে তাতেও তো মানুষ বাঙ্গি কিনে দেখতে চাইছে এটা কেমন!’
বাঙ্গি বিরোধী গ্রুপ করেও বাঙ্গির ‘অত্যাচার’ থেকে মুক্তি পাননি আবদুল্লাহ আল মাহমুদ। সেই করুণ অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের গ্রুপ নিয়ে একটা পত্রিকায় প্রতিবেদন করা হয়েছিল, আর সেটা আমি বাবাকে জানানোর পর বাবা ওইদিন সন্ধ্যায় বাঙ্গি কিনে নিয়ে আসে।’
এই গ্রুপের এক সদস্য লিখেছেন, ‘বাসায় বাঙ্গি এনেছে।সবাই দোআ করবেন আমার জন্য। সেখানে একজন কমেন্ট করেছেন, না বাবা এত সহজে বাঙগি থেকে তোমাকে রেহাই দেয়া হবে না, খেতেই হবে।’
আরেক জন লিখেছেন, ‘আমি ছোট থেকে ভাবতাম, শুধু আমি ই বোধহয় বাঙ্গী পছন্দ করি না। এই গ্রুপে আইসা মনে হইতেছে, my whole life was a lie! বাংলাদেশ থেকে বাঙ্গি বিলুপ্তকরণের এই সমিতিতে যুক্ত হয়ে নিজেকে ধন্য বোধ করছি!প্রয়োজনে রাজপথে আন্দোলনে নামতে প্রস্তুত। আপনারা এগিয়ে চলুন।’
একজন লিখেছেন, ‘বাঙ্গি খাওয়ার জন্য বাসা থেকে অনেক চাপাচাপি করতেছে। প্লিজ হেল্প মি।’
সেখানে একজন কমেন্ট করেছেন, ‘কল ৯১১’।
আরেকজন লিখেছেন, ‘ফালুদায় বাংগি দেওয়ার অপরাধে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড রেস্টুরেন্ট মালিকের।’
বাঙ্গি সম্পর্কে জরুরি তথ্য
সরকারের কৃষি বাতায়নে বাঙ্গির গুণাগুণ ও চাষের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়, বাঙ্গি এক রকমের শশা জাতীয় ফল যার অন্য নাম খরমুজ, কাঁকুড়, ফুটি। যার বৈজ্ঞানিক নাম Cucumis melo এবং ইংরেজি নাম Muskmelon. দেশের প্রায় সব এলাকাতেই গ্রীষ্মকালে বাঙ্গি জন্মে। তরমুজের পর এটিই অধিক প্রচলিত শসা গোত্রীয় ফল। বাঙ্গিগাছ দেখতে অনেকটা শসা গাছের মতো, লতানো।
কৃষি বাতায়নে বলা হয়েছে, ছোট এবং লম্বাটে জাতকে চিনাল বলা হয়। ফুটি বেশ বড় আকারের হয়, কাচা ফল সবুজ, পাকলে হলুদ রঙের হয় এবং ফেটে যায়। ফলের বাইরের দিকটা মিষ্টি কুমড়ার মতো হালকা ডোরা কাটা খাঁজযুক্ত। খেতে তেমন মিষ্টি নয়, অনেকটা বেলে বেলে ধরনের। এর ভেতরটা ফাঁপা থাকে। কাঁচা বাঙ্গি সবজি হিসেবে রান্না করে খাওয়া যায়। বাঙ্গিতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে খাদ্যআঁশ, যা হজমশক্তি বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। এতে চিনির পরিমাণ কম থাকায় ডায়াবেটিস রোগীরাও খেতে পারেন।
বাঙ্গির বিভিন্ন জাত সম্পর্কে কৃষি বাতায়নে বলা হয়েছে, প্রধানত দুই জাতের বাঙ্গি দেখা যায়, বেলে ও এঁটেল বাঙ্গি। বেলে বাঙ্গির শাঁস নরম। খোসা খুব পাতলা, শাঁস খেতে বালি বালি লাগে, তেমন মিষ্টি নয়।
অন্যদিকে, এঁটেল বাঙ্গির শাঁস কচকচে, একটু শক্ত এবং তুলনামূলকভাবে বেশি মিষ্টি। বাঙ্গি লম্বাটে সাধারণত লম্বাটে হলেও গোলাকার মিষ্টি কুমড়ার মতো বাঙ্গিও রয়েছে। এ প্রজাতির বাঙ্গির অপর নাম চীনা বাঙ্গি।