নারীরা অধিকার আদায়ে সচেতন হওয়ার কারণে সমাজে তালাকের সংখ্যা বেড়েছে বলে মনে করেন আইন বিশেষজ্ঞরা।
আইনজীবী মিতি সানজানা বলেন, ‘সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে অর্থনৈতিকভাবে নারীরা স্বাবলম্বী হচ্ছেন, আইন সম্পর্কে ব্যাপক প্রচার-প্রচারনা হচ্ছে, ফলে যখনই কোনো মিস-ম্যাচ বা অ্যাডজাস্টমেন্টের জায়গা থেকে একটা ফাটল দেখা দিচ্ছে, তখন তারা আর একসঙ্গে থাকতে চান না।’
নিউজবাংলা টোয়েন্টিফোর ডটকম-এর নিয়মিত আয়োজন ‘আমার আইন, আমার অধিকার’ অনুষ্ঠানে শনিবার এ কথা বলেন মিতি সানজানা।
যান্ত্রিকতা, মানুষের আত্মকেন্দ্রিকতা, যৌথ পরিবার ব্যবস্থা ভেঙে পড়া ও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ও তালাকের কারণ বলে উল্লেখ করেন মিতি।
তালাক দেয়ার ক্ষেত্রে নারীর দিক থেকে ৭০ শতাংশ আবেদন আসার কারণ ব্যাখ্যা করেন কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অফ বাংলাদেশের আইন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত প্রধান মেহেরবা সাবরীন।
তিনি বলেন, ‘খুব স্বাভাবিকভাবে আমরা দেখতে পাই, কোনো ধরনের মানসিক বা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হলে নারীরা আর মুখ বুজে থাকছেন না, যেটা, আমরা আমাদের আগের প্রজন্মে দেখেছি।
‘শিক্ষিত ও সচেতন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নারীরা আর্থিক দিক থেকে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। এই প্রক্রিয়াটা নারীদেরকে আরেকটু এগিয়ে দিচ্ছে। ফলে তারা বলতে পারছেন, কী ধরনের সমস্যার সম্মুখীন তারা হচ্ছেন।’
আইনজীবী ইশতিয়াক আব্দুল্লাহর সঞ্চালনায় এই অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে অংশ নেন ব্যারিস্টার মিতি সানজানা এবং মেহেরবা সাবরীন। শনিবার অনুষ্ঠানে আলোচনার বিষয় ছিল: তালাক।
তালাকের ফলে সন্তানের বেড়ে ওঠার উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে বলে আলোচনায় উঠে আসে। তবে তালাককে খারাপভাবে দেখার সুযোগ নেই বলেও মনে করেন আলোচকেরা। মিতি সানজানার মতে, ‘যদি কেউ এটিকে চুজ করতে চান, অবশ্যই তারা এই ডিসিশনটি নিতে পারেন।’
বাচ্চাদের বিষয়টি ভেবে দেখা, পরিণতির কথা মাথায় রেখে সবদিক ভেবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত বলেও মনে সুপ্রিম কোর্টের এই আইনজীবী।
তবে রাগের মাথায় যদি কেউ তালাকের সিদ্ধান্ত নেন, সেটাকে শোধরানোর আইনি অধিকার আছে বলে জানান মিতি সানজানা।
‘বিষয়গুলো আমাদের ধর্মীয় আইন দ্বারা পরিচালিত হয়ে থাকে। হিন্দু ব্যক্তির ক্ষেত্রে তার নিজস্ব ধর্মীয় আইন দ্বারা বিষয়টি পরিচালিত হবে, একজন মুসলিম ব্যক্তির ক্ষেত্রে আমাদের শরীয়াহ আইন রয়েছে। সেই মোতাবেক আসলে পরিচালিত হয়।’
মিতি সানজানা বলেন, ‘তিন ধরনের তালাক সাধারণত হয়ে থাকে। স্ত্রী স্বামীকে তালাক দিতে পারেন; স্বামী স্ত্রীকে তালাক দিতে পারেন; দুজন (স্বামী-স্ত্রী) পারস্পরিকভাবে তালাক নিতে পারেন।’
স্ত্রীরা চাইলেই তালাক দিতে পারেন না, এমন একটি প্রচলিত ধারনা নিয়ে জানতে চাইলে মিতি সানজানা বলেন, ‘আইনেই কিন্তু বলা হচ্ছে একজন পুরুষের যে ক্ষমতা স্ত্রীকে তালাক দেয়ার, সেটা কিন্তু অ্যাবসলিউট। তিনি চাইলে যে কোনো সময় তালাক দিতে পারেন। কিন্ত একজন নারীর ক্ষেত্রে একসেপশন রয়ে গেছে। একসেপশনটা হলো যে, তিনি যদি তালাক দিতে চান, তাহলে সে পাওয়ারটা তাকে অর্পণ করতে হবে। তাকে সেই ক্ষমতা তার স্বামী যদি অর্পণ না করেন, সেক্ষেত্রে তিনি কিন্তু তালাক দিতে পারেন না।’
কাবিননামার মাধ্যমেই সেই ক্ষমতাটি দেয়া হয় বলে জানান মিতি সানজানা। তাই কাবিননামার ১৮ নম্বর অংশটিকে গুরুত্ব সহকারে দেখার পরামর্শ দেন তিনি। কারণ সেখানে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ বলার মধ্য দিয়ে ক্ষমতা দেয়া না দেয়ার বিষয়টি মীমাংসিত হয়।
দর্শকের প্রশ্নের উত্তরে আলোচক মিতি সানজানা বলেন, হিল্লা বিয়ের একটা বিধান ছিল। কিন্তু হাইকোর্টের একটি যুগান্তকারী রায়ে হিল্লা বিয়ে অ্যাবোলিশ করে দেয়া হয়েছে।
‘তালাকের নোটিশ দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা কার্যকর হয়ে যাচ্ছে না। স্ত্রী তার হাজব্যান্ডকে নোটিশ দিলে ৯০ দিনের একটা সময়সীমা থাকে। ৯০ দিন পার হওয়ার পর তালাক কার্যকর হয়। এই তিন মাসের মধ্যে কেউ যদি ডিসিশান নেন, তার ডিসিশান বদল করতে চান, তালাক প্রত্যাহার করতে চান, তখন কিন্ত তা করার সুযোগ রয়ে গেছে।’
তবে তিন মাস পার হয়ে গেলে তালাকের নোটিশকে আর বাদ দেয়া যাবে না বলেও জানান মিতি। সেক্ষেত্রে তারা যদি আবারও একত্রিত হতে চান, তবে তাদের পুনর্বিবাহ করতে হবে বলে জানান তিনি। এক্ষেত্রে হিল্লা বিয়ের কোনো দরকার নেই।
স্ত্রী যদি সন্তান সম্ভাবা হন, সেক্ষেত্রে তালাক কার্যকর না হওয়ার যে বিষয়টি প্রচলিত রয়েছে, সেটাও সত্য নয় বলে মত দেন মেহেরবা সাবরীন।
‘ইউ ক্যান ফাইল ফর দ্য ডিভোর্স, কিন্তু দ্যাট ডিভোর্স শ্যাল বি ইফেক্টিভ যখন ওই সন্তানটি ভূমিষ্ঠ হয়েছে।’
মিতি সানজানা জানান, গর্ভবতী অবস্থায় কোনো স্ত্রীকে তালাক দেয়া হলে তিনি মা হওয়া পর্যন্ত ভরণ-পোষণ পাবেন। অন্যক্ষেত্রে এই মেয়াদ তিন মাস বা ৯০ দিন।
আইনজীবীরা জানান, নোটিশ পাওয়া বা না পাওয়ার সঙ্গে তালাক কার্যকরের কোনো সম্পর্ক নেই। তবে আইনি নিয়ম হচ্ছে, অবশ্যই তালাকের নোটিশ পাঠাতে হবে।
স্ত্রী তালাক দিলেও দেনমোহরের অর্থ পাওয়ার অধিকার আছে বলে জানান মেহেরবা সাবরীন। তিনি জানান, ডিভোর্স যিনি ফাইল করুন না কেন, সেখানে যদি দেনমোহরের অবশিষ্ট অর্থ থাকে, সেটা অবশ্যই স্ত্রী প্রাপ্য হবেন।