বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

অমিত শক্তির শৈল্পিক প্রকাশের সূর্যসারথি সুলতান

  •    
  • ১০ আগস্ট, ২০২১ ১৪:২৭

১৯৫০ সালে ইউরোপ সফরের সময় যৌথ প্রদর্শনীতে তার ছবি সমকালীন বিশ্ববিখ্যাত চিত্রশিল্পী পাবলো পিকাসো, ডুফি, সালভেদর দালি, পল ক্লি, কনেট, মাতিসের ছবির সঙ্গে প্রদর্শিত হয়। সুলতানই একমাত্র এশিয়ান শিল্পী যার ছবি এসব শিল্পীর ছবির সঙ্গে একত্রে প্রদর্শিত হয়েছিল।

বাঙালি জাতিসত্তার গভীরতম অন্তর ভূমিতে সহস্র বছর ধরে যে অমিত শক্তি সুপ্ত ছিল, তারই নান্দনিক শৈল্পিক প্রকাশের অন্যতম সূর্যসারথি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান।

তার জীবনের মূল সুর-ছন্দ খুঁজে পেয়েছিলেন বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবন, কৃষক এবং কৃষিকাজের মধ্যে। আবহমান বাংলার সেই ইতিহাস-ঐতিহ্য, দ্রোহ-প্রতিবাদ, বিপ্লব-সংগ্রাম এবং বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যেও টিকে থাকার ইতিহাস তার শিল্পকর্মকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে।

তার ছবিতে গ্রামীণ জীবনের পরিপূর্ণতা, প্রাণপ্রাচুর্যের পাশাপাশি শ্রেণির দ্বন্দ্ব এবং গ্রামীণ অর্থনীতির হালও অনেকটা ফুটে উঠেছে। তার ছবিগুলোতে বিশ্বসভ্যতার কেন্দ্র হিসেবে গ্রামের মহিমা উঠে এসেছে এবং কৃষককে এই কেন্দ্রের রূপকার হিসেবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

শুধু রং-তুলির স্পর্শে তিনি সৌন্দর্য অন্বেষণ করেননি, বাস্তবেও প্রমাণ দিয়েছেন ভালোবাসার। তাই ঢাকার ফুটপাত থেকে দুর্লভ নাগালিঙ্গম বৃক্ষ নিধন হতে দেখে তার চোখ প্লাবিত হয়েছিল।

বলতেন, ‘এ তো শুধু একটি বৃক্ষের নিঃশেষ নয়, গোটা জীবনের পরিসমাপ্তি।’ এস এম সুলতানের পুরো নাম শেখ মোহাম্মদ সুলতান। তবে, নড়াইলবাসীর কাছে তিনি ‘লাল মিয়া’ হিসেবে সমধিক পরিচিত।

১০ আগস্ট, মঙ্গলবার বরেণ্য শিল্পীর ৯৭তম জন্মদিন। গুণী এই শিল্পী ১৯২৪ সালের ১০ আগস্ট নড়াইলের মাছিমদিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মেছের আলী। মা মাজু বিবি। চেহারার সঙ্গে মিলিয়ে পিতা-মাতা আদর করে নাম রেখেছিলেন লাল মিয়া।

দারিদ্র্যের মাঝে বেড়ে ওঠা লাল মিয়া তথা এস এম সুলতান ১৯২৮ সালে নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন। স্কুলের অবসরে রাজমিস্ত্রি বাবাকে কাজে সহযোগিতা করতেন এবং মাঝে মাঝে ছবি আঁকতেন।

চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান। ছবি: সংগৃহীত

১৯৩৩ সালে পঞ্চম শ্রেণিতে থাকতে জমিদার শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ছবি এঁকে তাক লাগিয়ে দেন সুলতান। মুগ্ধ হন শ্যামাপ্রসাদসহ নড়াইলের তৎকালীন জমিদাররা। পড়ালেখা ছেড়ে ১৯৩৮ সালে চলে যান ভারতের কলকাতায়। চিত্রসমালোচক শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে তার (সুলতান) পরিচয় হয়।

অ্যাকাডেমিক যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও সোহরাওয়ার্দীর সুপারিশে ১৯৪১ সালে ভর্তি হন কলকাতা আর্ট স্কুলে। ১৯৪৩ মতান্তরে ১৯৪৪ সালে কলকাতা আর্ট স্কুল ত্যাগ করে ঘুরে বেড়ান এখানে-সেখানে। কিছুদিন কাশ্মীরের পাহাড়ে উপজাতিদের সঙ্গে বসবাস এবং তাদের জীবন-জীবিকাভিত্তিক ছবি আঁকেন সুলতান।

১৯৪৫ মতান্তরে ১৯৪৬ সালে ভারতের সিমলায় প্রথম একক চিত্রপ্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় সুলতানের। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের লাহোরেও চিত্রপ্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় তার। চিত্রপ্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর বোন ফাতিমা জিন্নাহ। ১৯৫০ সালে চিত্রশিল্পীদের আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে পাকিস্তান সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে আমেরিকা যান সুলতান। এরপর ইউরোপে বেশ কয়েকটি একক ও যৌথ প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেন তিনি। এ সময় বিখ্যাত চিত্রশিল্পী পাবলো পিকাসো, সালভেদর দালি, পল ক্লিসহ খ্যাতিমান চিত্রশিল্পীদের ছবির পাশে এস এম সুলতানের ছবি স্থান পায়।

১৯৫৩ সালে নড়াইলে ফিরে আসেন সুলতান। শিশু-কিশোরদের সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি চারুকলা শিক্ষার ব্যবস্থা করেন। ১৯৬৯ সালের ১০ জুলাই ‘দ্য ইনস্টিটিউট অব ফাইন আর্ট’ প্রতিষ্ঠা করেন। উদ্বোধন করেন যশোরের তৎকালীন জেলা প্রশাসক ইনাম আহম্মদ চৌধুরী। ১৯৮৭ সালে স্থাপিত হয় ‘শিশুস্বর্গ’। অবশ্য অনেক আগেই স্বপ্নের শিশুস্বর্গ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন এস এম সুলতান।

চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান। ছবি: সংগৃহীত

চিত্রাঙ্কনের পাশাপাশি বাঁশি এবং সুরযন্ত্র বাজাতেও পটু ছিলেন তিনি। সুলতান বিষধর সাপ, ভল্লুক, বানর, খরগোশ, মদনটাক, ময়না, গিনিপিগ, মুনিয়া, ষাঁড়সহ বিভিন্ন পশু-পাখি পুষতেন। সুলতান হিংসা, বিদ্বেষ, হানাহানি পছন্দ করতেন না।

চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের ৭০ বছরের বোহেমিয়ান জীবনে তিনি তুলির আঁচড়ে দেশ, মাটি, মাটির গন্ধ আর ঘামে ভেজা মেহনতি মানুষের সঙ্গে নিজেকে একাকার করে সৃষ্টি করেছেন ‘পাট কাটা’, ‘ধান কাটা’, ‘ধান ঝাড়া’, ‘ধান ভানা’, ‘জলকে চলা’, ‘চর দখল’, ‘গ্রামের খাল’, ‘গ্রামের দুপুর’, ‘নদী পারাপার’, ‘ধান মাড়াই’, ‘জমি কর্ষণে যাত্রা’, ‘মাছ ধরা’, ‘নদীর ঘাটে’, ‘গুনটানা’, ‘ফসল কাটার ক্ষণে, ‘শরতের গ্রামীণ জীবন’, ‘শাপলা তোলা’র মতো বিশ্ববিখ্যাত সব ছবি।

১৯৫০ সালে ইউরোপ সফরের সময় যৌথ প্রদর্শনীতে তার ছবি সমকালীন বিশ্ববিখ্যাত চিত্রশিল্পী পাবলো পিকাসো, ডুফি, সালভেদর দালি, পল ক্লি, কনেট, মাতিসের ছবির সঙ্গে প্রদর্শিত হয়। সুলতানই একমাত্র এশিয়ান শিল্পী যার ছবি এসব শিল্পীর ছবির সঙ্গে একত্রে প্রদর্শিত হয়েছিল।

কালোত্তীর্ণ এই শিল্পী ১৯৮২ সালে ‘একুশে পদক’, ১৯৮৪ সালে ‘রেসিডেন্ট আর্টিস্ট’ ১৯৮৬ সালে ‘বাংলাদেশ চারুশিল্পী সংসদ সম্মাননা’ এবং ১৯৯৩ সালে ‘স্বাধীনতা পদক’ পেয়েছেন।

এ ছাড়া ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ম্যান অব দ্য ইয়ার’, নিউ ইয়র্কের বায়োগ্রাফিক্যাল সেন্টার থেকে ‘ম্যান অব অ্যাচিভমেন্ট’ এবং এশিয়া উইক পত্রিকা থেকে ‘ম্যান অব এশিয়া’ পুরস্কার লাভ করেন।

অসুস্থ অবস্থায় ১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর যশোর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার পর নড়াইলে প্রিয় জন্মভূমিতে তাকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়।

চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান। ছবি: সংগৃহীত

১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর খ্যতিমান এই শিল্পীর মৃত্যুর পর তার বাসভবন, শিশুস্বর্গ ও সমাধিস্থল ঘিরে ‘এস এম সুলতান স্মৃতি সংগ্রহশালা’ নির্মাণ করা হয়। ২০০৯ সালে স্থাপন করা হয় এস এম সুলতান আর্ট কলেজ; যা বর্তমানে এস এম সুলতান বেঙ্গল চারুকলা মহাবিদ্যালয় নামে প্রতিষ্ঠিত। এ ছাড়া সংগ্রহশালার পাশে ‘শিশুস্বর্গ-১’ এবং সুলতান আর্ট কলেজের পাশে ‘শিশুস্বর্গ-২’ ও লাল বাউল সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

তবে করোনাকালে এখন কোনো দর্শনার্থীর আগমন নেই। সংশ্লিষ্টদের আশা, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবার জমে উঠবে সংগ্রহশালা।

এদিকে চিত্রা নদীর পাশে সুলতানের ব্যবহৃত ‘ভ্রাম্যমাণ শিশুস্বর্গ’ তথা দ্বিতল নৌকাটি তুলে রাখা হয়েছে। নৌকাটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য চিত্রা নদীর কোল ঘেঁষে ঘাটের নির্মাণকাজ শুরু হলেও প্রয়োজনীয় অর্থের অভাবে তা থেমে আছে। দর্শনার্থীরা ঘাট নির্মাণসহ সুলতানের ব্যবহৃত দ্বিতল নৌকাটি যথাযথ সংরক্ষণের দাবি করেছেন।

এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান বলেন, ‘সুলতান সংগ্রহশালার উন্নয়নসহ ঘাট নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। অর্থ বরাদ্দ পেলে কাজ শুরু হবে।’

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান জানান, এস এম সুলতানের ৯৭তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে জেলা প্রশাসন ও এস এম সুলতান ফাউন্ডেশন বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে শিল্পীর মাজারে পুষ্পস্তবক অর্পণ, মাজার জিয়ারত, কোরআনখানি, মিলাদ মাহফিল এবং বিশেষ প্রার্থনা। করোনার কারণে স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্বল্প পরিসরে এসব কর্মসূচি পালিত হবে।

এ বিভাগের আরো খবর