ধানমন্ডির শংকর এলাকা থেকে প্রতিদিনই সাতমসজিদ রোড-সায়েন্স ল্যাবরেটরি হয়ে ফকিরাপুল যাতায়াত করেন প্রিন্টিং ব্যবসায়ী সোহান পারভেজ। এই পথে দুটি জায়গায় রয়েছে ‘হাতির’ ভাস্কর্য। একটি পিলখানার বিজিবি সদর দপ্তরের গেটের পাশে, আরেকটি সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ে।
বিজিবি সদর দপ্তরের গেটের পাশের ভাস্কর্যকে প্রথম দর্শনে হাতির বলে মেনে নেয়া বেশ কঠিন। গেটের দুই পাশে দুটি করে মোট চারটি এবং আরও একটি আছে গেটের ওপরে।
প্রকৃতিতে ঘুরে বেড়ানো বা চিড়িয়াখানায় বন্দি হাতির যত ছবি দেখেছেন, তার কোনোটির সঙ্গেই ভাস্কর্যের ‘হাতি’ মেলাতে পারেন না সোহান পারভেজ। এলিফ্যান্ট রোডের দুটি হাতির অবয়ব নিয়েও আপত্তি রয়েছে তার।
এই ব্যবসায়ী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বলতে গেলে প্রতিদিনই একবার করে চোখ আটকায় এই ভাস্কর্যগুলোতে। আমার কাছে সবচেয়ে অদ্ভুত লাগে বিজিবির গেটের হাতিগুলো।
‘হাতি দেখতে কি এ রকম হয় বলেন? দেখতে কেমন যেন! আর সায়েন্সল্যাবের মাথার হাতির দিকে তাকানো যায় না। না বড় হাতি, না বাচ্চা হাতি কেমন জানি সাইজ এগুলোর। অনেক দিন ধরে আবার সেটার মুখ, দাঁত, লেজ ভাঙা, চারদিকে নোংরা।’
বিজিবি সদর দপ্তরের গেটের হাতির প্রতিটিতে দাঁত রয়েছে। প্রাপ্তবয়স্ক হাতির বাহ্যিক কিছু বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে লিঙ্গ নির্ধারণের সাধারণ কিছু পদ্ধতি রয়েছে। সে অনুযায়ী, আফ্রিকান হাতির ক্ষেত্রে পুরুষ বা মাদি- দুই ধরনের হাতিতেই লম্বা দাঁত দেখা যায়। তবে এশিয়ান মাদি হাতির লম্বা দাঁত নেই, কখনও কখনও এ ধরনের মাদি হাতির দৃশ্যমান দাঁতই থাকে না। এ ছাড়া, হাতির প্রতিটি দলে পুরুষের পাশাপাশি মাদি হাতিও থাকে।
বিজিবি সদর দপ্তরের গেটে হাতির ভাস্কর্য
বিজিবি গেটের ভাস্কর্যে সবগুলো হাতির লম্বা দাঁত থাকায় ধরে নেয়া যেতে পারে, সেগুলো আফ্রিকান প্রজাতির পুরুষ ও মাদি হাতির একটি দল। বিশালাকার কান থেকেও ধরে নেয়া যায়, ভাস্কর এশিয়ান হাতি নয়, তৈরি করতে চেয়েছেন আফ্রিকান প্রজাতির হাতি।
তবে মাথা থেকে শুরু করে দেহের আর কোনো গড়ন থেকেই এই ভাস্কর্যে হাতির বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া মুশকিল। মাথা, দীর্ঘ প্যাঁচানো শুঁড়, দেহের তুলনায় সরু পা, ঘাড় থেকে নিচের দিকে প্রায় সোজা নেমে যাওয়া দেহ, এমনকি এমন ধবধবে সাদা রঙের হাতি আফ্রিকার কোথাও নেই।
এলিফ্যান্ট রোডে হাতির ভাস্কর্য
এলিফ্যান্ট রোডে ঢোকার মুখের দুটি হাতি এসব জটিলতা কিছুটা এড়াতে পারলেও প্রাপ্তবয়স্ক হাতির পাশে থাকা বাচ্চা হাতিরও দাঁত কীভাবে গজালো সেই প্রশ্নের কোনো জবাব নেই। তাছাড়া, এই হাতির শুঁড়ও দেহের তুলনায় লম্বা, দেহের গড়ন নিয়েও আছে বিস্তর প্রশ্ন। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ভাঙা পড়েছে দাঁত, লেজ।
প্রাণী বিশেষজ্ঞরা দিশেহারা
বাঘ ও হাতি বিশেষজ্ঞ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. এম এ আজিজ বলছেন, এসব ভাস্কর্য যারা বানাচ্ছেন তাদের হাতি নিয়ে বাস্তব কোনো ধারণা নেই।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কেউ যদি কোনো প্রাণীর ভাস্কর্য বানান, তার প্রথম দায়িত্ব হলো রিয়েল ওয়ার্ল্ডে প্রাণীটিকে দেখা, ইভেন নট ইন ফটোগ্রাফ। আমাদের এখানে হয় কি, যিনি এটা বানান, ইন্টারনেটে তিনি হয়তো একটা ছবি দেখে সেটা বানানোর চেষ্টা করেন। যিনি এগুলো বানাচ্ছেন, তার উচিত ছিল এক্সপার্টদের সঙ্গে কথা বলা।’
বিজিবি সদর দপ্তরের গেটের পাশের ভাস্কর্যকে আফ্রিকান প্রজাতির হাতি হিসেবে শনাক্ত করার পক্ষে ড. আজিজ। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘আফ্রিকান প্রজাতির হাতির কান অনেক বড় হয়, তাছাড়া সামনের দিক থেকে এদের অ্যাপিয়ারেন্স কিছুটা অ্যাগ্রেসিভ। এশিয়ান এলিফ্যান্টের অ্যাপিয়েরেন্স অতটা অ্যাগ্রেসিভ নয়।’
আফ্রিকান হাতি (বাঁয়ে) এবং এশিয়ান হাতি
হাতির গায়ে সাদা রং চড়ানোর বিষয়ে প্রচণ্ড আপত্তি আছে ড. আজিজের। তিনি বলেন, কোনো হাতির বায়োলজিক্যাল কোনো প্রবলেম হলে গায়ের রং কিছুটা সাদা হতে পারে। তবে একেবারে সাদা বলতে যা বোঝায় এটা কিন্তু সেই সাদা না। তাছাড়া সাদা হাতি আমি কেন করব! ন্যাচারাল ওয়ার্ল্ডে এটা তো এক্সেপশনাল ঘটনা। মানুষের মধ্যেও আমরা কারও কারও শ্বেত রোগ দেখে থাকি, কিন্তু সেটা তো কমন নয়। আপনি হয়তো বনে এক শটা হাতি দেখলেন, তার মধ্যে একটা হয়তো পাওয়া যাবে কিছুটা সাদা। আমি সেটাই কেন ভাস্কর্যের জন্য বেছে নেব?’
ভাস্কর্যের হাতির শুঁড় তুলনামূলক লম্বা জানিয়ে তিনি বলেন, বিজিবি গেটের হাতির শুঁড়ে যেভাবে কয়েক প্যাঁচ রয়েছে সেটাও অসম্ভব।
অধ্যাপক ড. এম এ আজিজের কাছে এলিফ্যান্ট রোডের বাচ্চা হাতির দাঁত গজানোর কোনো ব্যাখ্যা নেই। তিনি বলেন, ‘নরমালি বাচ্চা হাতির দাঁত বাইরে ওইভাবে এক্সপোজড থাকে না। আমাদের বাচ্চাদেরও তো শুরুতে থাকে না। এরপর তার দুধদাঁত ওঠে, তারপর সেগুলো পড়ে গিয়ে স্থায়ী দাঁত ওঠে।’
ড. আজিজ মনে করেন, এ ধরনের ভাস্কর্য কেবল সৌন্দর্যহানিই ঘটাচ্ছে না, প্রাণী সম্পর্কে মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তিরও জন্ম দিচ্ছে। বিশেষ করে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশুরা। তিনি বলেন, ‘আমাদের বাচ্চারা বা ইয়াং জেনারেশন হয়তো ১০ বছর পরে আর হাতিই দেখবে না। তখন এসব ভাস্কর্য থেকে তারা একটা ধারণা নেবে। ক্লাসে টিচার যখন বলবে, এশিয়ান মাদি হাতির দাঁত থাকে না, তখন তারা বলবে, কই আমরা তো এলিফ্যান্ট রোডের সব হাতিরই দাঁত দেখেছি।’
বাচ্চাসহ এশিয়ান হাতি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ ফিরোজ জামানও দিচ্ছেন একই মত।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘হাতির কানটা কতটুকু লম্বা হয়, শুঁড়টা কতটুকু লম্বা হয়, মাথার সঙ্গে বডির রেশিও কত, এসব চিন্তা করা হচ্ছে না। ভাস্কর্য বানাতে পারে বানিয়ে রেখে দেয়। সেটা কিসের ভাস্কর্য হলো, মানুষের হলো না জন্তুর হলো, এগুলো তারা চিন্তা করে না।
‘ওই জায়গাগুলোতে ভাস্কর্য বসিয়েছে কেন, উদ্দেশ্য কী? এখন এই প্রাণীগুলো অতি বিপন্ন হয়ে গেছে। এই অতি বিপন্ন প্রাণীগুলো নিয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য, দরদ সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন জায়গায় এসব ভাস্কর্য আমরা করে থাকি। সেখানে আমরা একটা হাতির ভাস্কর্য বসাতে গিয়ে সেটা হাতি না হয়ে যদি অন্য কিছু বোঝায় তাহলে এটা খারাপ অবশ্যই।’
তিনি বলেন, ‘আমি নিজে ওয়াইল্ড লাইফ নিয়ে কাজ করি, কখনও আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয় না। সারা পৃথিবীতে যেকোনো জিনিস সরকার যখন করে তারা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে খোঁজে; এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ কে, তাদের পরামর্শ নেয়, সেই অনুয়ায়ী কাজ করে। আর আমাদের দেশে তোয়াক্কা করে না এগুলো।
‘আপনি একটা প্রাণী যখন ডিসপ্লে করবেন, কোন মোশনে সেটা থাকা উচিত, সেই প্রাণীটা বসলে কীভাবে বসে থাকে, কত অ্যাঙ্গেলে মাথাটা ঘুরিয়ে থাকে, কত অ্যাঙ্গেলে বডিটা ঘোরানো থাকে। হাতিটা থাকলে শুঁড়টা কীভাবে থাকে? কোন অ্যাঙ্গেলে ঘোরানো থাকে।’
বিজিবি সদর দপ্তরের গেটে ভাস্কর্যের হাতির শুঁড়ে আছে বিস্ময়কর প্যাচ
শিল্পবোদ্ধা, নগর বিশেষজ্ঞরাও দুশ্চিন্তায়
এসব ভাস্কর্য নিয়ে নিউজবাংলা কথা বলেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ওরিয়েন্টাল আর্টের শিক্ষক গুপু ত্রিবেদীর সঙ্গে।
তিনি বলেন, ‘এই ভাস্কর্যগুলো কে করেছে আমি জানি না, কিন্তু কাজগুলো খুবই দুর্বল। সোজা কথা এগুলো ডিসপ্রোপরসন ওয়ার্ক। ভাস্কর্যের যে প্রোপরসন থাকে, সেটা ঠিক নাই। চোখের জায়গায় চোখ নাই, দাঁতের জায়গায় দাঁত নাই। মাথা আর বডির কোনো সম্পৃক্ততা নাই। অ্যাবনরমাল একটা ব্যাপার।
‘আর সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ের বাচ্চা হাতির তো দাঁত হয়ে আছে। এই কাজগুলো নিয়ে যদি বলি তাহলে এগুলো না শিল্প, না অশিল্প, কিছুর মধ্যেই পড়ে না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ভাস্কর্য বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ভাস্কর মুকুল কুমার বাড়ৈ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এই ভাস্কর্যগুলো দিয়ে আমাদের আরবান কর্তৃপক্ষের শিল্পবোধের যে জায়গাটা, সেখানে কিছুটা হলেও দুর্বলতার প্রকাশ পায়। সবকিছু মিলেই তো আমাদের প্রকাশ এবং আমরা আমাদেরই প্রকাশিত করছি। সে ক্ষেত্রে আমাদের শিল্প উৎকর্ষে র যে জায়গাটা সেটা অপ্রকাশিত হচ্ছে।’
নগর পরিকল্পনাবিদ, গবেষক ও শিল্পসমালোচক অধ্যাপক নজরুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যখন একটা হাতির ভাস্কর্য বসানো হয়েছিল, সেটা তো করেছিল নিশ্চয় সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য। হাতি, ঘোড়া যাই হোক, এগুলো তো সৌন্দর্যের জন্য বসাতেই পারে।
‘সেটা ঠিক আছে, কিন্তু জায়গাটা যেন সুন্দরভাবে পরিকল্পিত হয় ও স্থাপনাটা সুন্দর হয় এবং সবচেয়ে বড় কথা বসানোর পরে যেন এটা যত্নের সঙ্গে সংরক্ষিত হয়। তা না করে একটা কিছু বানালাম, অযত্নে ফেলে রাখলাম, তাতে শহরের সৌন্দর্য সেটাও বাড়ে না আর শিল্পকর্মের প্রতি আমাদের যে অবজ্ঞা সেটা প্রমাণ দেয়। আর আমরা জন্তু-জানোয়ারকে কতটা ভালোবাসি বা বাসি না সেটাও প্রমাণ রাখে।’
এসব ভাস্কর্য কার পরামর্শে এবং কার অনুমতি নিয়ে করা হচ্ছে- প্রশ্ন ছুড়ে তিনি বলেন, ‘এটায় তো অবশ্যই সিটি করপোরেশনের অনুমোদন লাগবে। এখন আমাদের এত বড় শহর, রাজধানী, বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুলের শহরের একটা। কিন্তু এখানে শিল্পকর্ম কোথায় কীভাবে স্থাপন করা হবে, কে সংরক্ষণ করবে কোনো নিয়মকানুন নাই। কোনো চিন্তাভাবনা নাই।’
এলিফ্যান্ট রোডের হাতির ভাস্কর্যের দাঁত, মুখও ভেঙে গেছে
ভাস্কর অধরা, কর্তৃপক্ষের চোখে শিল্প
বিজিবি সদর দপ্তরের গেটের পাশে ও এলিফ্যান্ট রোডের ভাস্কর্যের নির্মাতা সম্পর্কে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কোনো তথ্য পায়নি নিউজবাংলা। তবে বেশ কয়েকটি সূত্রের দাবি, বিজিবি গেটের ভাস্কর্যের নির্মাতার নাম কবীর চৌধুরী। দেশে আর কোথাও তার কোনো শিল্পকর্ম আছে কি না, সে ব্যাপারে ভাস্কর্যশিল্পীরাও কোনো তথ্য দিতে পারেননি।
বিজিবির গেটের হাতিগুলোকে শুধু শিল্পকর্ম হিসেবেই দেখতে চান বাহিনীর পরিচালক (অপারেশন) লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফয়জুর রহমান।
হাতির ভাস্কর্যের প্রসঙ্গ তুলতেই তিনি নিউজবাংলা প্রতিবেদককে বলেন, ‘শুঁড় নিয়ে বলবেন তো? শুঁড়টা অনেক লম্বা তাই তো? দেখেন সবকিছু তো স্কেল হিসেবে হয় না। সেই হিসেবে প্রতীকী অর্থে ধরে নেয়াটাই সবচেয়ে শৈল্পিক হবে আরকি।’
বিজিবি সদর দপ্তরের গেটের উপরেও আছে ভাস্কর্যের একটি হাতি
বিজিবির এই কর্মকর্তা দাবি করেন, হাতির ভাস্কর্য বানানো হয়েছে ঢাকা ও পিলখানার ঐতিহ্যকে তুলে ধরতে।
এই ধরনের শ্বেতশুভ্র এবং বেঢপ হাতি ঐতিহ্য বহন করে কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সেটার যৌক্তিকতা একেবারেই একেকজনের কাছে একেক রকম। একেকজনের চিন্তার লাইন একেক রকম হবে। তবে যে উদ্দেশ্যে করা সেটা মূলত ঐহিত্যকে ধারণ, স্মৃতিকে ধরে রাখা। আমরা নিজেদেরকে ঐতিহ্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছি; হ্যাঁ পিলখানায় সিম্বল অফ হাতি।’
আর ঢাকায় হাতির ভাস্কর্য নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মাকসুদ হাসেম।
তিনি বলেন, ‘সংবাদ সংক্রান্ত এবং মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলার জন্য আমাদের পাবলিক রিলেশন অফিসার আছে, তার সঙ্গে কথা বলতে হবে।’