স্বর্গের বারান্দায় তখন গুনগুন করছিলেন কবিগুরু।
‘অযুত বৎসর আগে হে বসন্ত, প্রথম ফাল্গুনে
মত্ত কুতূহলী,
প্রথম যেদিন খুলি নন্দনের দক্ষিণ-দুয়ার
মর্তে এলে চলি,
অকস্মাৎ দাঁড়াইলে মানবের কুটিরপ্রাঙ্গণে
পীতাম্বর পরি,
উতলা উত্তরী হতে উড়াইয়া উম্মাদ পবনে
মন্দারমঞ্জরী,
দলে দলে নরনারী ছুটে এল গৃহদ্বার খুলি
লয়ে বীণা বেণু-
মাতিয়া পাগল নৃত্যে হাসিয়া করিল হানাহানি
ছুঁড়ি পুষ্পরেণু।
সখা, সেই অতিদূর সদ্যোজাত আদি মধুমাসে
তরুণ ধরায়
এনেছিলে যে কুসুম ডুবাইয়া তপ্ত কিরণের
স্বর্ণমদিরায়...
পুরোটা শেষ করতে পারলেন না রবীন্দ্রনাথ। হঠাৎ কে যেন বলে উঠল, এ আপনি কী শোনালেন গুরুদেব! মধু, মধু!
গুরুদেব খুশি হলেন নাকি রাগ করলেন, বোঝা গেল না। গোঁফ যে তার মুখটাই আড়াল করে রেখেছে বিজ্ঞাপনের মতো। তবে জবাব দিলেন, এটা আমার ‘বসন্ত’ কবিতা। কেবল শুরু করেছিলাম, এর মধ্যেই বাগড়া বাধিয়ে দিলে। তুমি কে ভাই?
গুরুদেব, আমি মধুমাস।
মধুমাস! গুরুদেব পারলে লাফিয়ে ওঠেন। ওহে মধুমাস, তুমিও স্বর্গে চলে এসেছ? আহা!
আবারও গুনগুন করে উঠলেন গুরুদেব-
ব্যর্থ জীবনের সে কয়খানি পরম অধ্যায়
ওগো মধুমাস,
তোমার কুসুমগন্ধে বর্ষে বর্ষে শূন্যে জলে স্থলে
হইবে প্রকাশ।
বকুল চম্পকে তারা গাঁথা হয়ে নিত্য যাবে চলি
যুগ যুগান্তরে,
বসন্তে বসন্তে তারা কুঞ্জে কুঞ্জে উঠিবে আকুলি
কুহুকলস্বরে।
অমর বেদনা মোর হে বসন্ত, রহি গেল তব
মর্মরনিশ্বাসে
উত্তপ্ত যৌবনমোহ রক্তরৌদ্রে রহিল রঞ্জিত
চৈত্রসন্ধ্যাকাশে।
কবিতাটা শেষ করে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন গুরুদেব। তারপর জানতে চাইলেন, ওহে মধুমাস, এ কবিতাখানা কেমন লাগল?
কিন্তু কোনো জবাব নেই। গুরুদেব বললেন, জবাব দিচ্ছ না কেন ওহে প্রিয় মধুমাস?
মধুমাস বলল, আমি তো মৃতপ্রায়।
আর্তনাদ করে উঠলেন গুরুদেব। বলো কী!
জি গুরুদেব। বাংলাদেশে আমি মৃতপ্রায়।
কিন্তু কেন?
তা তো জানি না। দু-একটি বাদে বাংলাদেশের প্রায় সব পত্রপত্রিকা আমার ঠিকানাই বদলে দিয়েছে। জ্যৈষ্ঠকেই মধুমাস বলে প্রচার করছে।
গুরুদেবের কপালে এবার কয়েকটা ভাঁজ পড়ল। বলো কী হে!
এই তো দেখুন না গুরুদেব।
বলেই ট্যাব খুলে কয়েকটা পত্রিকার ওয়েবসাইট দেখিয়ে দিল মধুমাস। গুরুদেবও অবাক হয়ে পত্রিকার শিরোনামগুলো দেখতে লাগলেন। দেখতে দেখতে গুরুদেবের চেহারাটা লাল হয়ে উঠতে লাগল।
গুরুদেব বললেন, কিন্তু এ কী করে সম্ভব! বাঙালি কবিদের অন্যতম কবি পঞ্চদশ শতকের বিদ্যাপতিও বলেছেন-
‘মধু ঋতু, মধুকর পাঁতি;
মধুর-কুসুম-মধু-মাতি।
মধুর বৃন্দাবন মাঝ,
মধুর মধুর রসরাজ।
মধুর-যুবতীগণ-সঙ্গ
মধুর মধুর রস রঙ্গ।
মধুর যন্ত্র সুরসাল,
মধুর মধুর করতাল।
মধুর নটন-গতিভঙ্গ,
মধুর নটনী-নট-রঙ্গ।
মধুর মধুর রস গান,
মধুর বিদ্যাপতি ভান।’
এটা বিদ্যাপতির পদাবলী-কীর্তনের ‘মধু ঋতু মধুকর পাঁতি’ কবিতা। ষোড়শ শতকের আরেক বাঙালি কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী। চণ্ডীকাব্যের ‘ফুল্লরার বারমাস্যা’ কবিতায় মুকুন্দরাম লিখেছেন-
‘...মধুমাসে মলয়-মারুত বহে মন্দ
মালতীর মধুকর পিয়ে মকরন্দ।
বনিতা পুরুষ যত পীড়য়ে মদনে
ফুল্লরার অঙ্গ পুড়ে উদর-দহনে।’
এটুকু বলে গুরুদেব থামলেন। মধুমাস বলল, গুরুদেব, আপনার গীতবিতানেও তো এই গানটা আছে-
এবার গুন গুন করে গাইতে শুরু করল মধুমাস-
‘বিদায় করেছ যারে নয়ন-জলে,
এখন ফিরাবে তারে কিসের ছলে।
আজি মধু সমীরণে, নিশীথে কুসুম-বনে,
তারে কি পড়েছে মনে বকুল-তলে?’
এটুকু গেয়েই হঠাৎ থেমে গেল মধুমাস। বলল, আপনার আরেকটা গানের কথা মনে পড়ল গুরুদেব। এটাও আপনার গীতবিতানে ‘নাট্যগীতি’ শিরোনামে ৫৬ নম্বর গান হিসেবে আছে।
‘আজি উন্মাদ মধুনিশি ওগো চৈত্রনিশীথশশী।
তুমি এ বিপুল ধরণীর পানে কী দেখিছ একা বসি
চৈত্রনিশীথশশী।...
এবার গুরুদেব বললেন, আমার ‘আশ্রমপীড়া’ নাটকের প্রথম দৃশ্যের কথা মনে আছে? নবকান্তের সংলাপ দিয়ে এভাবে শুরু করেছিলাম-
‘ওঃ! প্রেমের রহস্য কে ভেদ করতে পারে! না জানি সে কিসের বন্ধন যাতে এক হৃদয়ের সঙ্গে আর এক হৃদয় বাঁধা পড়ে! কী জ্যোৎস্নাপাশ, কী পুষ্পসৌরভের ডোর, কী মুকুলিত মধুমাসের মধুর মলয়ানিলের বন্ধন!’
মনে পড়ে মধুমাস?
মধুমাস মাথা নেড়ে বলল, মনে পড়ে গুরুদেব। মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’র সে কথাগুলোও মনে পড়ে-
‘না দিল দানব-বালা হুহুঙ্কার রবে, মাতঙ্গিনী-যূথ যথা মত্ত মধুকালে।’
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কপালকুণ্ডলা উপন্যাসেও আছে-
‘এমত নহে যে, একেবারে বায়ু বহিতেছিল না, মধুমাসে দেহ¯স্নিগ্ধকর বায়ু অতি মন্দ-একান্ত নিঃশব্দ বায়ু মাত্র, তাহাতে কেবলমাত্র বৃক্ষের সর্বাগ্রভাগারূঢ় পত্রগুলি হেলিতেছিল, কেবলমাত্র আভূমিপ্রণত শ্যামা লতা দুলিতেছিল; কেবলমাত্র নীলাম্বরসঞ্চারী ক্ষুদ্র শ্বেতাম্বুদখ-গুলি ধীরে ধীরে চলিতেছিল।’
মধুমাস এবার জানতে চাইল, গুরুদেব, ‘মধুমাস’ নামটা কী করে এল?
গুরুদেব বললেন, ওটা পাওয়া যাবে কলিম খান ও রবি চক্রবর্তীর ‘বঙ্গীয় সমার্থকোষ অভিধান’ থেকে। ওখানে বলা হয়েছে- ‘চৈত্রমাসকে কেন মধুমাস বলা হয়, তার কারণ জানা যায় ‘বসন্ত’ শব্দ থেকে। দুধের থেকে সর, সর থেকে ঘোল-মাখন হয়ে ঘি-এ পৌঁছানো যায়। সেই সুবাদে মধু হলো ঘি। ঠিক সেইরূপ বৈশাখ থেকে বসবাস ও বর্ষের শুরু এবং তার চূড়ান্ত হয় বসন্তে। সেই বসন্তের শেষ মাস হলো চৈত্রমাস। গ্রহণ-বর্জন-পুনরুৎপাদনের নীতিতে চলা মানবজীবনের জৈবিক সার্থকতা পুনরুৎপাদনে। বসন্তের অন্তে বা চৈত্র মাসে মানুষের প্রতিপালন প্রাচীন শব্দবিদগণের অখণ্ড চিন্তাশৃঙ্খলার সঙ্গে খাপ খেয়ে যায়। সেই কারণে তারা চৈত্র মাসকে মধুমাস নাম দিয়েছিলেন।’
এছাড়া হিন্দি ভাষায় ‘বাহারি’ মানে মধুকাল বা মধুমাস। আবার ‘বাহারকে দিন’ মানে বসন্তকাল। অপরদিকে ফারসিতে ‘বহার’ মানে বসন্তকাল। ‘বহারী’ অর্থ বাসন্তী বা বসন্তকাল সম্বন্ধীয়। ষোড়শ শতকের বাংলা ভাষার বিখ্যাত কবি দৌলত উজির বাহরাম খান তার কাব্যে বলেছেন, ‘মধুমাসে উতলা বাতাস, কুহরে পিক; যদি সে কমল শিশিরে দহল কি করিব মধুমাসে।’ বসন্তের সখা কোকিল। এই কোকিলের আরেক নাম হলো ‘মধুসখা’।
মধুমাস বলল, গুরুদেব, খনার বচনেও শুনেছি-
‘মধুমাসে ত্রয়োদশ দিনে রয় শনি
খনা বলে সে বৎসর হবে শস্য হানি।’
অথবা-
‘মধুমাসে প্রথম দিবসে হয় যেই বার।
রবি শোষে, মঙ্গল বর্ষে, দুর্ভিক্ষ বুধবার।’
এবার একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন গুরুদেব। জানতে চাইলেন, শুধু কি বাংলাদেশের পত্রপত্রিকাতেই তোমার ঠিকানা বদল হয়েছে মধুমাস?
জি গুরুদেব। শুধু বাংলাদেশের কিছু পত্রিকা। ভারতের বাংলা ভাষার রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের কোনো পত্রিকা আমার ঠিকানা বদলায়নি- চৈত্রই রেখেছে।
এবার মুচকি হাসলেন গুরুদেব। বললেন, কিন্তু সাহিত্য থেকে তোমাকে বদলাবে কেমন করে?
মধুমাসের কণ্ঠে আফসোস, ওরা তো সাহিত্য পড়ে না। দিন দিন সাহিত্যপড়ুয়ার সংখ্যা কমে যাচ্ছে।
গুরুদেব বললেন, তা বুঝলাম। সাহিত্য পড়ে না, কাজেই কী করে জানবে? কিন্তু অভিধানও কি দেখে না?
কী যে বলেন না গুরুদেব! কেউ অভিধান ঘাঁটলে তো! এখন কেউ আর অত কষ্ট করে না। গুগলে সার্চ দেয়। সবকিছু গুগল থেকেই জোগাড় করে।
তাহলে তো বড্ড মুশকিল হলো! বসন্তে সবচেয়ে বেশি ফুল ফোটে। এটুকু তো সবাই জানে?
জি গুরুদেব, এটা সবাই জানে।
তাহলে তো বিষয়টা সহজ হয়ে গেল। ফাল্গুনে ফুল ফুটতে শুরু করে। চৈত্রে গিয়ে ফুলগুলো মধুতে ভরে যায়। আর ফুল মানেই মধু। কাজেই মধুমাস মানেই চৈত্রমাস। কারণ মধু থাকে ফুলে, ফলে নয়।
গুরুদেব, আপনিই তো বসন্তকে মানে মধুমাসকে বাঙালির মধ্যে জনপ্রিয় করেছেন। উৎসব পালনের রীতি চালু করেছেন। সে জন্যই আমি আপনার দ্বারস্থ হয়েছি। কিছু একটা করুন। আমি নিজের ঠিকানায় থাকতে চাই।
গুরুদেব বললেন, হতাশ হয়ো না প্রিয় মধুমাস। নিশ্চয়ই সবার মধুমাসোদয় মানে বোধোদয় হবে। মর্ত্য ছেড়ে এখানে থাকলে শেষে দেখবে তোমার ঠিকুজিই বদলে গেছে। তুমি মর্ত্যইে ফিরে যাও হে মধুমাস।
গুরুদেবের নির্দেশ। না মেনে উপায় আছে! আবার মর্ত্যের পথে পা বাড়াল মধুমাস। তার কণ্ঠে তখন শচীনদেব বর্মণের গান-
‘বঁধু গো
এই মধুমাস বুঝিবা বিফল হলো
ভুলে গেছ তুমি সেই মধু নামে ডাকা
মিলনছায়া মধুমাস আজিকে ঢাকা...’
লেখক: শিশু সাহিত্যিক, কলাম লেখক।