‘কোন পাথেয় নিয়ে তোমরা এসেছ? মহৎ আকাঙ্ক্ষা। তোমরা বিদ্যালয়ে শিখবে বলে ভর্তি হয়েছ। কী শিখতে হবে ভেবে দেখ। পাখি তার বাপ-মায়ের কাছে কী শেখে? পাখা মেলতে শেখে, উড়তে শেখে। মানুষকেও তার অন্তরের পাখা মেলতে শিখতে হবে, তাকে শিখতে হবে কী করে বড় করে আকাঙ্ক্ষা করতে হয়। পেট ভরাতে হবে। এ শেখাবার জন্যে বেশি সাধনা দরকার নেই; কিন্তু পুরোপুরি মানুষ হতে হবে- এই শিক্ষার জন্যে যে অপরিমিত আকাঙ্ক্ষার দরকার তাকেই শেষ পর্যন্ত জাগিয়ে রাখবার জন্যে মানুষের শিক্ষা।’
১৯১৯ সালের ৭ নভেম্বর সিলেট মুরারীচাঁদ (এমসি) কলেজে দেয়া বক্তৃতায় এমনটি বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
রবীন্দ্রনাথের এই বক্তৃতা মুগ্ধ করেছিল উপস্থিত শিক্ষার্থীদের। এর মধ্যে একজন পরে এ নিয়ে চিঠি লিখেন কবিকে। চিঠির এক জায়গায় প্রশ্ন রাখেন- ‘আকাঙ্ক্ষা বড় করতে হলে কী করতে হবে?’ এই শিক্ষার্থীর নাম সৈয়দ মুজতবা আলী। পরবর্তী সময়ে স্বনামে খ্যাত ও রসসাহিত্যের অনন্য অবস্থানে পৌঁছার পরও তার স্বীকারোক্তি- ‘আমার অন্তর্জগৎ রবীন্দ্রনাথের গড়া’।
এমসি কলেজে বক্তৃতা দেয়ার দুদিন আগেই রবীন্দ্রনাথ আসেন সিলেটে। যা তখন শ্রীহট্ট নামেও খ্যাত ছিল, কবিগুরু ভালোবেসে যার নাম দিয়েছিলেন ‘সুন্দরী শ্রীভূমি’।
১৯১৯ সালের ৫ নভেম্বর। হেমন্তের শীত শীত সকাল। চারদিকে কুয়াশার আঁধার। তার ভেতর থেকেই যেন একটা ট্রেন এসে থামল সিলেট রেলওয়ে স্টেশনে। প্রতিদিনই যেমন থামে। তবে এই ট্রেন থেকে নেমে এলেন দীর্ঘ শুভ্রকেশ আর শ্মশ্রুমণ্ডিত বিশেষ একজন। ছয় বছর আগে যিনি উপমহাদেশের প্রথম ব্যক্তি হিসেবে নোবেল জয় করেছেন। অবশ্য গান আর কবিতায় তারও আগেই তিনি জয় করে নিয়েছেন বাঙালির হৃদয়। শ্রীহট্টে পা রাখলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
সিলেটে তিন দিন অবস্থান করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কবিগুরুর এই সফর নিয়ে প্রখ্যাত সম্পাদক নলিনীকুমার ভদ্র লেখেন- ‘কবির জীবনী থেকে এ তিনটি দিনের কাহিনি (সিলেট ভ্রমণের ৩ দিন) বাদ দিয়ে যদি কোনো শ্রীহট্টের ইতিহাস লেখা হয় তাহলে তা হবে অসম্পূর্ণ। অনাগত যুগে আমাদের ভবিষ্যৎ বংশীয়রা এ কাহিনি পড়ে গর্ব অনুভব করবে- যদিও ঈর্ষা করবে তারা আমাদের অপরিসীম সৌভাগ্যকে।’
সিলেট ভ্রমণের আনন্দস্মৃতির কথা উল্লেখ করে রবীন্দ্রনাথ ১৯১৯ সালের ৩ ডিসেম্বর ইতিহাসবিদ ও কলম্বো বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কালিদাস নাগকে এক চিঠিতে লেখেন, ‘আশ্রমে ফিরে এসেছি। পাহাড় (শিলং) থেকে নেমে আসবার পথে গৌহাটি, শিলেট (সিলেট) ও আগরতলা ঘুরে এলুম। বলা বাহুল্য বক্তৃতার ত্রুটি হয়নি। দিনে চারটে করে বেশ প্রমাণসই বক্তৃতা দিয়েছি এমন দুর্ঘটনাও ঘটেছে। এমনতর রসনার অমিতাচারী আমি যে রাজি হয়েছি তার কারণ ওখানকার লোকেরা এখনও আমাকে হৃদয় দিয়ে আদর করে, এটা দেখে বিস্মিত হয়েছিলুম। বুঝলুম কলকাতা অঞ্চলের লোকের মতো ওরা এখনও আমাকে এত বেশি চেনেনি। ওরা আমাকে যা-তা একটা কিছু মনে করে। তাই সেই সুযোগ পেয়ে খুব করে আমার মনের কথা ওদের শুনিয়ে দিয়ে এলুম।’ (চিঠিপত্র-১২)
সিলেটে ভ্রমণকালে ৬ নভেম্বর টাউন হল প্রাঙ্গণে ও ৭ নভেম্বর এমসি কলেজের ছাত্রাবাসের উদ্যোগে কবি সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে দুটি বক্তৃতা দেন রবীন্দ্রনাথ। পরবর্তী সময়ে টাউন হলের বক্তৃতা ‘বাঙালীর সাধনা’ নামে ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় আর এমসি কলেজের বক্তৃতার সারমর্ম ‘আকাঙ্খা’ শিরোনামে ‘শান্তিনিকেতন’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
এমসি কলেজের বক্তৃতার কিছু অংশ শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে। ওই বক্তৃতায় রবীন্দ্রনাথ শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে আরও বলেন, ‘যে দেশে বিদ্যালয়ে কেবল দেখতে পাই, ছাত্র নোটবুকের পত্রপুট মেলে ধরে বিদ্যার মুষ্টিভিক্ষা করছে কিংবা পরীক্ষায় পাশের দিকে তাকিয়ে টেক্সট বইয়ের পাতায় পাতায় বিদ্যার উঞ্ছবৃত্তিতে নিযুক্ত, যে দেশে মানুষের বড় প্রয়োজনের সামগ্রী মাত্রই পরের কাছে ভিক্ষা করে সংগ্রহ করা হচ্ছে, নিজের হাতে লোকে দেশকে কিছুই দিচ্চে না- না স্বাস্থ্য, না অন্ন, না জ্ঞান, না শক্তি; যে দেশে কর্মের ক্ষেত্র সংকীর্ণ, কর্মের চেষ্টা দুর্বল, যে দেশে শিল্পকলায় মানুষ আপন প্রাণমন আত্মার আনন্দকে নব নব রূপে সৃষ্টি করছে না; যে দেশে অভ্যাসে বন্ধনে সংস্কারের জালে মানুষের মন এবং অনুষ্ঠান বদ্ধ বিজড়িত; যে দেশে প্রশ্ন করা, বিচার করা নতুন করে চিন্তা করা ও সেই চিন্তা ব্যবহারে প্রয়োগ করা কেবল হাতে যে নেই তা নয়, সেটা নিষিদ্ধ এবং নিন্দনীয়, সেই দেশে মানুষ আপন সমাজে আত্মাকে দেখতে পায় না, কেবল হাতকড়া, পায়ের বেড়ি এবং মৃতযুগের আবর্জনারাশিকেই চারিদিকে দেখতে পায়, জড় বিধিকেই দেখে, জাগ্রত বিধাতাকে দেখে না।’
ভ্রমণকালে এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে মুগ্ধ হয়ে সিলেটকে নিয়ে একটি কবিতাও লেখেন রবীন্দ্রনাথ। সে সময় বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন করে সিলেটকে আসামের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছিল। এ নিয়ে আক্ষেপও ফুটে ওঠে রবীন্দ্রনাথের কবিতায়। শতাধিক বর্ষ পরেও সিলেটের বর্ণনা দিতে গিয়ে এখনও অনেকেই দ্বারস্থ হন সেই কবিতার।-
‘মমতাবিহীন কালস্রোতে/ বাঙলার রাষ্ট্রসীমা হতে/ নির্বাসিতা তুমি/ সুন্দরী শ্রীভূমি।/ ভারতী আপন পুণ্য হাতে/ বাঙালির হৃদয়ের সাথে/ বাণীমালা দিয়া/ বাঁধে তব হিয়া/ সে বাঁধনে চিরদিনতরে তব কাছে/ বাঙলার আশীর্বাদ গাঁথা আছে।’
এই কবিতা থেকে ধার করে সিলেটকে ‘সুন্দরী শ্রীভূমি’ হিসেবেও আখ্যায়িত করে থাকেন কেউ কেউ।
লেখক ও রবীন্দ্র গবেষক অধ্যাপক নৃপেন্দ্র লাল দাশ বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ কেবলমাত্র সিলেটকে নিয়েই কবিতা লিখেছেন। অন্য কোনো স্থান সম্পর্কে কোথাও কবিতা লিখেছিলেন কি না, জানা যায় না। রবীন্দ্র হস্তাক্ষরে লেখা কবিতাটির শিরোনাম ছিল না। তারিখও ছিল না। স্থান নামও ছিল না। পরে কবিপ্রণামে ‘শ্রীভূমি’ নামে প্রকাশিত হয়। রবীন্দ্র গবেষকদের অনুমান ১৯৩৬ সালে এই কবিতা রচিত হয়েছিল।’
সিলেটে এসে মণিপুরী নৃত্য দেখে মুগ্ধ হন রবীন্দ্রনাথ। মণিপুরী কাপড়ও তাকে মুগ্ধ করে। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ফারজানা সিদ্দিকা তর ‘সিলেটে রবীন্দ্রনাথ: শতবর্ষে ফিরে দেখা’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথ মণিপুরী নৃত্যকলায় এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, কলকাতায় ফিরবার পথে ত্রিপুরার রাজার সাহায্য নিয়ে একজন নাচের শিক্ষককে শান্তিনিকেতনে নিয়ে যান সেখানকার শিক্ষার্থীদের নাচ শেখাবার জন্যে।’
কবিগুরুর সিলেট সফরের শতবর্ষ পূর্ণ হয় ২০১৯ সালের নভেম্বরে। গর্ব আর ঈর্ষাজাগানিয়া সেই স্মৃতির স্মরণে সে বছর সিলেটে ব্যাপক আয়োজনের মধ্যে ‘শ্রীহট্টে রবীন্দ্রনাথ: শতবর্ষে স্মরণোৎসব’ শিরোনামে রবীন্দ্রনাথের পরিভ্রমণের একশ’ বছর পূর্তি পালন করা হয়। রবীন্দ্র স্মরণোৎসব বিশাল আয়োজনে পালন করা হলেও দীর্ঘদিন ধরেই অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে রবীন্দ্রস্মৃতিচিহ্নগুলো।
সিলেট ভ্রমণকালে নগরীর নয়াসড়কের মিশনারি বাংলোয় (পাদ্রী বাংলা নামে পরিচিত) থাকার ব্যবস্থা হয় রবীন্দ্রনাথের। এই বাংলোটির এখন আর অস্তিত্বই নেই। খ্রিষ্টান মিশনারি নেতারা বাংলোসহ ওই জায়গাটি অনেকটা গোপনে বিক্রি করে দেন। বর্তমানে সেখানে সিলেট উইমেন্স মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল নামে একটি বেসরকারি হাসপাতাল রয়েছে।
নগরীর চৌহাট্টা এলাকার এতিহ্যবাহী সিংহ বাড়িতে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে এ বাড়িটিকে অর্পিত সম্পত্তি উল্লেখ করে একটি প্রভাবশালী মহলকে বন্দোবস্ত করে দেয়া হয়েছিল। তবে আন্দোলনের মুখে পরে বন্দোবস্ত বাতিল করে কর্তৃপক্ষ। এমসি কলেজেও নেই রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিচিহ্ন ধরে রাখার মতো কোনো উদ্যোগ।
সিলেট ভ্রমণকালে নগরীর বন্দরবাজারের ব্রাহ্মমন্দিরে দুইবার যান রবীন্দ্রনাথ। সেখানে সমবেত প্রার্থনায়ও অংশ নেন। ব্রাহ্মমন্দিরটি এখন জরাজীর্ণ অবস্থায় কোনো রকমে টিকে আছে।
রবীন্দ্রনাথের মন কেড়েছিল সিলেটের মণিপুরী নৃত্য। নগরীর মাছিমপুরের মণিপুরী পল্লির মণ্ডপে বসে নৃত্য দেখেছিলেন তিনি। দীর্ঘদিনের দাবির পর গত বছর এই মণ্ডপপ্রাঙ্গণে রবীন্দ্রনাথের একটি আবক্ষ ভাস্কর্য স্থাপন করে সিলেট সিটি করপোরেশন। এটি নিয়েও আপত্তি জানায় মৌলবাদী গোষ্ঠী।
এ প্রসঙ্গে কবি তুষার কর বলেন, ‘কেবল গানবাজনা আর লোকদেখানো অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রস্মরণ নয়। রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিচিহ্নগুলোও আমাদের সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। তাতে আগামী প্রজন্ম এ বিষয়ে জানতে পারবে।’
আজ ইংরেজি সালে ৮ মে, বাংলায় ২৫ বৈশাখ। বাঙালি সত্তা ও সংস্কৃতির মহানায়ক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬০ তম জন্মদিন। ১২৬৮ বঙ্গাব্দের এই দিনে কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে জন্ম এই প্রবাদপুরুষের।