কে আছে মজেনি এখনও, হৃদয়কাড়া সেই সুর আর সহজ কথার যাদুতে!
এখন তো সবার মুখে-মুখে, আর মোবাইল ফোনে ঘুরে বেড়াচ্ছে গানটি- ‘আইলারে নয়া দামান আসমানেরও তেরা/ বিছানা বিছাইয়া দেও শাইল ধানের নেড়া/ দামান বও দামান…’।
সিলেট অঞ্চলের এই গান একদল চিকিৎসকের মাধ্যমে ঝড় তুলছে সারা দেশে। ভাইরাল হয়েছে ফেসবুকে। দেশের ভেতরে তো বটেই, দেশের বাইরে থাকা বাঙালিদের হৃদয়ও কেড়েছে গানটি। আর ফেসবুক-ইউটিউব-টিকটকে তরুণদের মধ্যে এই গান গাওয়ার রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। রিমিক্স-ফিউশনের মাধ্যমে নেচে গেয়ে তারা পরিবেশন করেছেন- নতুন বরকে বরণের এই গান।
হালের ট্রেন্ড হয়ে ওঠা এই গানটি কবেকার? গানটি কে লিখেছিলেন? সুরই বা কার? কে গেয়েছিলেন প্রথম? একেবারেই মানুষের মুখে মুখে, বিশেষত গ্রামীণ নারীদের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এই গানের বিষয়ে এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া সহজ নয়। তবুও নিউজবাংলা খোঁজার চেষ্টা করেছে গানটির উৎস।
গানের কথাই বলে দিচ্ছে, এটি মূলত সিলেট অঞ্চলের বিয়ের গান। আঞ্চলিক ভাষায় রচিত গানটি অর্ধশতাধিক বছর ধরে গীত হয়ে আসছে সিলেটের বিভিন্ন বিয়ের আসরে। হাস্যকৌতুক মিশ্রিত সহজ কথা আর বাংলার লোকসুরের এই গানের মাধ্যমে নতুন বরকে বরণ করা হয়।
এ গানে বরকে আকাশের তারার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। আর তাকে বসার জন্য ধানের খড় বিছিয়ে দেয়ার কথা বলা হয়েছে। পরের অন্তরাতেই নতুন বরকে পান খাওয়ার অনুরোধ করে কৌতুকচ্ছলে বলা হচ্ছে, যাওয়ার কথা বললে কান কেটে রাখা হবে।
সিলেটের ছেলে একুশ তাপাদার ঢাকার একটি পত্রিকার রিপোর্টার। তিনি বলেন, ‘আমি ছোটবেলা থেকেই মায়ের মুখে এই গীত শুনে আসছি। বিয়ের আসরে কয়েকজন নারী মিলে এটি গাইতেন। হিন্দু-মুসলমান সবাই মিলেই গাইতেন।’
সিলেটের নানা বয়সের আরও অন্তত ১০ জনের সঙ্গে কথা হয় এই গান নিয়ে। সবাই জানালেন, বিয়ের আসরেই শুনেছেন এই গান। তবে এর গীতিকার বা সুরকার কে, তা কেউই বলতে পারেননি।
সিলেট অঞ্চলের বিয়ের অনুষ্ঠানে নৃত্য-গীত একটি আবশ্যিক অনুষঙ্গ। হিন্দু, মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের বিয়েতেই স্বজন ও প্রতিবেশী নারীরা সম্মিলিতভাবে গান গেয়ে পরিবেশ আরও উৎসবমুখর করে তোলেন।
হালের কমিউনিটি সেন্টারনির্ভর বিয়ের আধিক্য আর বিদেশি সংস্কৃতির প্রভাবে কিছুটা কমেছে যদিও, তবু গ্রামাঞ্চলে মুসলিম বিয়েতে নারীদের গানের আসর বসানোর দৃশ্য এখনও দুর্লভ নয়। আর বছর বিশেক আগে তো এটি প্রায় আবশ্যিকই ছিল।
এখন অবশ্য ভিন্ন ফর্মে আবার ফিরেছে তা। গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে, বিয়ের ভিডিওচিত্র নির্মাণে ফিরে এসেছে নৃত্য-গীতের আয়োজন।
সাম্প্রতিক সময়ে ‘নয়া দামান’ গানের এমন ভাইরাল হওয়ার পেছনেও ভূমিকা রেখেছে এরকম একটি ভিডিওচিত্র। ছায়াছবি নামের একটি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠানের ইউটিউব পেজে দেয়া এই ভিডিওচিত্রে খুলনার এক কনের বন্ধু-স্বজন নারীদের এই গানে নাচতে-গাইতে দেখা যায়। এটা এরইমধ্যে কোটি দর্শক দেখে ফেলেছেন।
সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. জফির সেতু সিলেট অঞ্চলের বিয়ের গান সংগ্রহ করে নিজ সম্পাদনায় বছর তিনেক আগে বের করেছিলেন ‘সিলেটের বিয়ের গীত’ নামে একটি বই।
বইটির ১৪৯তম পৃষ্ঠায় ‘বর-বরণ’ শিরোনামে ১৫ লাইনের পুরো ‘নয়া দামান’ গানটি তুলে ধরা হয়েছে। তবে এখানেও গানের গীতিকার-সুরকারের নাম নেই।
অধ্যাপক সেতু নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এই গানটি সিলেট অঞ্চলের মুসলিম সম্প্রদায়ের বিয়ের গান। অনেক তথ্য তালাশ করেও এই গানের গীতিকার কে তা জানতে পারিনি। তবে সময়ের পরিক্রমায় গানের কথায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। আবার সিলেটেরই বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়ে গানের কথা কিছু বদলে গেছে।’
সিলেটের একুশে পদকপ্রাপ্ত প্রবীণ লোকসঙ্গীত শিল্পী সুষমা দাশ। তার ভাই পণ্ডিত রামকানাই দাশও সংগীতে একুশে পদক পেয়েছেন। অনেকেই দাবি করছেন, রামকানাই ও সুষমা দাশের মা দিব্যময়ী দাশ নয়া দামানের রচয়িতা। ফেসবুকে বৃহস্পতিবার এক পোস্টে নির্মাতা ও লেখক শাকুর মজিদ দিব্যময়ীর নাতনি কাবেরি দাশের বরাত দিয়ে জানিয়েছেন, এই গানটি দিব্যময়ীর লেখা।
তবে শুক্রবার সকালে সুষমা দাশ নিউজবাংলাকে জানিয়েছেন, এই গানটি কার লেখা তা তিনি জানেন না। মায়ের লেখা বলে তিনি কখনও শোনেননি।
একুশে পদকপ্রাপ্ত প্রবীণ লোকসঙ্গীত শিল্পী সুষমা দাশনয়া দামানের গীতিকার হিসেবে অনেক জায়গায় হাছন রাজার নামও ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে লোকসংস্কৃতি গবেষক সুমনকুমার দাশ নিশ্চিত করেছেন, এটি হাছন রাজার নয়, এতটা পুরোনোও নয়।
তিনি বলেন, ‘গানের স্থায়ীটা (উৎসমুখ) একই রকম রেখে বাকি অন্তরাগুলোর বিভিন্ন সময় পরিবর্তন, পরিমার্জন ও পরিবর্ধন হয়েছে। একেকজন একেকভাবে গেয়েছেন।
‘এই গানটি খুব বেশি পুরানো নয়। ৫০-৬০ বছর আগের হবে। গানের ভণিতায় গীতিকারের নাম না থাকায় বিভ্রান্তি বেড়েছে। ফলে এটি এতকাল ধরে লোকগান হিসেবেই বিবেচিত হয়ে আসছে। লোকের মুখে মুখেই যা ছড়িয়ে পড়েছে। যদিও ২০১৩ সালে আমাকে প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে সংগীতজ্ঞ রামকানাই দাশ গানটি তার মায়ের রচনা বলে জানিয়েছিলেন। অবশ্য সে গানের পঙক্তিতে “দামান” শব্দের বদলে “জামাই” শব্দ রয়েছে।’
সিলেট বেতারের জন্য ১৯৭৩ সালের দিকে এয়ারুন্নেছা খানম নামের এক শিল্পীর কণ্ঠে গানটি প্রথম রেকর্ড হয় বলে জানান সুমন।
১৯৭৩-৭৪ সালের দিকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রথম এই গানটি সমবেত কণ্ঠে পরিবেশন করেন সিলেটের কয়েকজন শিল্পী। সেই দলে ছিলেন সিলেটের প্রবীণ সঙ্গীত শিল্পী হিমাংশু বিশ্বাস।
প্রবীণ সঙ্গীত শিল্পী হিমাংশু বিশ্বাসতিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘১৯৭৩ কি ৭৪ সালে নওয়াজেশ আলী খানের পরিচালনায় ‘বর্ণালী’ অনুষ্ঠানে আমরা বিটিভিতে এই গানটি পরিবেশন করি। এর আগে সিলেট অঞ্চলের বাইরে এই গানটি পরিবেশন করা হয়েছে কি না তা আমার জানা নেই।’
গানের রচনাকাল সম্পর্কে হিমাংশু বলেন, ‘স্বাধীনতার পরে সিলেট নগরের মিরের ময়দানে বাংলাদেশ বেতারের সিলেট কেন্দ্র স্থাপন হয়। এর পরই বেতারে গানটি প্রথমবারের মতো রেকর্ড করা হয়। এর আগে এর কোনো রেকর্ড ছিল না। তখন সিলেট বেতার কেন্দ্রে এই অঞ্চলের অনেক বিয়ের গান প্রচারিত হতো।
‘বেতারের জন্য এই গানটির সুর করেছিলেন সিলেট বেতারের সঙ্গীত প্রযোজক আলী আকবর খান। এখন তার সুরেই গানটি গাওয়া হয়।’
তবে গানটির গীতিকারের নাম জানা যায়নি বলে জানান তিনিও।
হিমাংশুর কথার সত্যতা মিলল বাংলাদেশ বেতারের সিলেট কেন্দ্রে খোঁজ নিয়েও। বেতারে ৩৫ বছর আগে কয়েকজন নারী শিল্পীর সমবেত কণ্ঠে গাওয়া এই গানের একটি রেকর্ড রয়েছে।
বাংলাদেশ বেতারের সিলেট কেন্দ্রের সহকারী পরিচালক প্রদীপ চন্দ্র দাস বলেন, ‘আমাদের আর্কাইভে থাকা সবচেয়ে পুরোনো রেকর্ডে এই গানের সুরকার হিসেবে আলী আকবর খানের নাম রয়েছে। আর গীতিকারের জায়গায় লেখা রয়েছে অজ্ঞাত।’
আলী আকবর খান প্রয়াত হয়েছেন। তার ছেলে মতি খান বর্তমানে বাংলাদেশ বেতারে কর্মরত। তিনিও এই গানের গীতিকার কে তা জানাতে পারেননি।
নয়া দামানের ঢাকা মেডিক্যাল ভার্সনের ভিডিওতে নাচতে দেখা গেছে ডা. শাশ্বত চন্দন ও ডা. আনিকা ইবনাত শামাকেআমেরিকা প্রবাসী মিউজিশিয়ান মুজার উদ্যোগে সিলেটের সংগীত শিল্পী তোশিবা বেগমের গাওয়া ‘নয়া দামান’-এর নতুন ভার্সনটি সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তাতে বাঁশি বাজিয়েছেন মিম হক। অনেকেই তাদের গানের সঙ্গে নেচে ভিডিওচিত্র ধারণ করে ইউটিউবে ছাড়ছেন। সেগুলোও দর্শকদের আকৃষ্ট করছে। এই ভার্সনটিই গায়ে হলুদের ভিডিওতে ব্যবহার করেছে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠান ‘ছায়াছবি’।
সম্প্রতি গানটির সবশেষ ভার্সনের সংগীত শিল্পী তোশিবা তার পোস্ট করা এক টিকটক ভিডিওতে অনুযোগ করে বলেন, গানটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার নাম সামনে আসলেও তার নাম রয়ে যায় আড়ালে। আবেগাপ্লুত কণ্ঠে তিনি বলেন, এই গান সিলেট থেকে ভাইরাল হয়েছে, তার গায়কীতে গানটি এখন নতুন করে জনপ্রিয় হয়েছে। কিন্তু আলোচনায় তার নাম কোথাও নেই। বরং আলোচিত হচ্ছে ছায়াছবির ভিডিও ও মুজা।
তবে এই গানটি নিয়ে সবচেয়ে বেশি হইচই ফেলেছেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের তিন চিকিৎসক। করোনা রোগীদের চিকিৎসায় নিয়োজিত স্বাস্থ্যকর্মীদের উৎসাহ দিতে ঢাকা মেডিক্যালের করিডোরে এই গানের সঙ্গে তারা নেচেছেন। সেই ভিডিওচিত্র ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে, ব্যাপক প্রশংসিতও হয়েছে।
এ নিয়ে কথাসাহিত্যিক স্বকৃত নোমান বৃহস্পতিবার ফেসবুকে লেখেন, ‘নয়া দামান। একটি লোকগান কী পরিমাণ নাড়া দিল মানুষকে! হাসপাতালের ডাক্তারদের নৃত্যসহযোগে গাওয়া গানটা যতবার দেখি মুগ্ধ হই। এটাই ফোকলোরের শক্তি। গ্রামগঞ্জের ওই হেঁদিপেদি জনগণের সংস্কৃতিই বাঙালির মূল সংস্কৃতি। গ্রামের আউল-বাউল-বয়াতি গায়েন-ফকিররাই শেষ পর্যন্ত বাঙাল মানুষের চিত্ত দখল করে নেয়।’
পুরো গানটির কথা
আইলারে নয়া দামান আসমানের তেরা
বিছানা বিছাইয়া দেও শাইল ধানের নেরা।।
দামান বও, দামান বও।
বও দামান কওরে কথা খাওরে বাটার পান।
যাইবার লাগি চাওরে যদি কাটিয়া রাখমু কান।।
দামান বও, দামান বও।
আইলারে দামান্দের ভাই হিজলের মোরা।
ঠুনকি দিলে মাটি পড়ে ষাইট-সত্তইর উড়া।।
দামান বও, দামান বও।
আইলারে দামান্দের বইন কইবা একখান কথা।
কইন্যার ভাইর চেরা দেইখ্যা অইগেলা বোবা।।
দামান বও, দামান বও।
আইলারে দামান্দের বইন মোটা ভাইবৌ মোটা বটর গাইল।
উঠতে বইতে সময় লাগে করইন আইল তাইল।।
দামান বও দামান বও।
(এই গানের নানা ভার্সন রয়েছে। বিভিন্ন সময় কথার পরিবর্তন-পরিবর্ধন হয়েছে। এই কথাগুলো জফির সেতু সম্পাদিত ‘সিলেটের বিয়ের গীত’বই থেকে সংগৃহিত।)