বাংলাদেশের গণহত্যার চরিত্র বিচার করলে এখানে উদ্দেশ্য ও সংখ্যা দুটোর বিচারেই এটি অনেক বড়, যা ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিরা ঘটিয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য হলো, বাংলাদেশের এই এত বড় গণহত্যা এখনও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়নি বলে মন্তব্য করেছেন একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক স্বদেশ রায়।
বৃহস্পতিবার বিকেল ৪টায় বইমেলার মূল মঞ্চে ‘স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী: বাংলাদেশের গণহত্যা ও গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনের সময় এ কথা বলেন তিনি।
স্বদেশ রায় বলেন, ‘জাতিসংঘের জেনোসাইডের সংজ্ঞার আওতা বা পরিসর অনেক বেড়েছে, যা খুব সহজ আকারে বলা যায়, একটি জাতি বা নরগোষ্ঠীকে বা কোনো আদর্শের লোকদের নিশ্চিহ্ন বা তাদের পরিচয় পরিবর্তন ও আদর্শ পরিবর্তনের জন্য যে কোনো ধরনের হত্যা, নির্যাতন, বলপ্রয়োগ বা অন্য কোনোরূপ অত্যাচার জেনোসাইড বলে চিহ্নিত হবে, এবং সেখানে কত লোককে হত্যা করা হয়েছে বা নিহত হয়েছে, সেটা বড় নয়। তার থেকে অনেক বড় হলো, ওই হত্যা, নির্যাতন বা গৃহত্যাগে, ভূমিত্যাগে বাধ্য করার মূল কারণ। যদি এর মূল কারণ হয় ওই জনগোষ্ঠী, জাতি বা কোনো সম্প্রদায়কে নিশ্চিহ্ন করা, তাহলে সেটা অবশ্যই গণহত্যার মধ্যে পড়ে। তাই গণহত্যায় সংখ্যা কখনোই বড় নয়। এর উদ্দেশ্যই মূল কারণ হিসেবে ধরা হয়।’
তিনি বলেন, একাত্তরে পাকিস্তানিদের উদ্দেশ্যই ছিল একটি নরগোষ্ঠী ও তারা যে স্বাধীনতার চেতনায় এক হয়েছে, এই দুটোকে ধ্বংস করা।
তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানিরা যে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের টার্গেট করে হত্যা করার চেষ্টা করেছিল, এ ছিল জেনোসাইড। কারণ, এই হত্যার মাধ্যমে তারা বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতির অবসান ঘটাতে চেয়েছিল। এবং এ হত্যাকাণ্ড তারা আওয়ামী লীগের প্রান্তিক সমর্থক দরিদ্র মানুষ অবধি বিস্তৃত করেছিল। আর তাদের বাসস্থান অর্থাৎ বস্তিতে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে তাদের হত্যা করেছিল ও হত্যার চেষ্টা করেছিল।
‘এ ধরনের হত্যাকাণ্ড কোনো অংশেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাজি বাহিনী ইহুদিদের যেভাবে হত্যা করেছিল, তার থেকে কম ছিল না। তাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নাজি বাহিনীর নেতারা ও তাদের জেনারেলরা যেভাবে যুদ্ধাপরাধের জন্য বা জেনোসাইডের জন্য দায়ী, পাকিস্তানের তৎকালীন শাসক ও এখানে গণহত্যায় জড়িত সৈন্য ও তাদের কমান্ডাররা সমভাবে দায়ী।'
স্বদেশ রায় আরও বলেন, ‘এ কারণে আজও যেমন নাজি বাহিনীর নেতা বা জেনারেলদের বিচার হচ্ছে এই ৭৫ বছর পরে, তেমনি বাংলাদেশের গণহত্যাকারী পাকিস্তানি নেতা ও জেনারেলদের; এমনকি সরাসরি হত্যার সঙ্গে জড়িত সৈনিকদের আজ ৫০ বছর পরে বিচার হওয়া উচিত আন্তর্জাতিক আদালতে।’
অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী সাজ্জাদ আলী জহির (বীর প্রতীক), আহম্মেদ শরীফ এবং চৌধুরী শহীদ কাদের।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন।
মুনতাসীর মামুন বলেন, বিশ্বে গণহত্যার বিচার খুব কম হয়েছে। গণহত্যার জন্য তাত্ত্বিক কাঠামো নির্মাণ করা হয় কিন্তু শাসকরা সে কাঠামো নির্মাণ করে না। এটা এক ধরনের অপরাজনীতি এবং অপরাজনীতির বিরুদ্ধে আমাদের দাঁড়াতে হবে। বাংলাদেশেও এটি হয়েছে।