বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

যে গ্রামে দেয়াল শিল্পিত

  •    
  • ৮ মার্চ, ২০২১ ২১:৫৪

টিকোইল গ্রামে প্রায় প্রতিটি বাড়ির দেয়ালে আলপনা আঁকা। গ্রামের বাসিন্দারা যেন পেয়ে গেছেন বিশাল বিশাল ক্যানভাস। প্রত্যেকে হয়ে উঠেছেন সৌন্দর্যপিপাসু শিল্পী।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে সড়কপথে নাচোল উপজেলার নেজামপুর ইউনিয়নের টিকোইল গ্রামে ঢুকলে চোখে পড়বে বাড়িঘরের সামনের দেয়ালে বিভিন্ন ধরনের আলপনা আঁকা। প্রায় সব বাড়ির দেয়ালে শিল্পকর্ম।

গ্রামের অধিকাংশ বাসিন্দা হিন্দু ধর্মের অনুসারী। পূজাপার্বণসহ বিভিন্ন উৎসবে বাড়িকে সাজিয়ে তুলতেই তারা এঁকে থাকেন আলপনা।

টিকোইল গ্রামের একটা বাড়ির নামই ‘আলপনা বাড়ি’। দোতলা বাড়িটির দেয়ালে বড় করে লেখা এ নাম। এ বাড়ি থেকেই পুরো গ্রামে দেয়ালে আলপনা করার চল শুরু হয়েছে।

বাড়ির মালিক দাসু বর্মন। বাড়ির সামনে যেতেই দেখা হলো দাসু বর্মনের স্ত্রী দেখন বর্মনের সঙ্গে। পরম আতিথেয়তায় তিনি নিয়ে যান বাড়ির ভেতরে। বাড়িতে ঢুকতেই মনে হলো, আলপনার রাজ্যে চলে এসেছি। মাটির দেয়াল যেন সৃষ্টিশীলতার বড় বড় ক্যানভাস। আর এসব ক্যানভাসে ফুটে উঠেছে ফুল, লতাপাতা, পাখি।

একটু সামনে যেতেই দেখা মিলল দেয়ালে বিখ্যাত ব্যক্তিদের ছবি: বঙ্গবন্ধুর ছবি তো আছেই, সেই সঙ্গে আছে কাজী নজরুল ইসলাম, ইলা মিত্র, শেখা হাসিনার ছবি।

ঘরের দেয়ালে বিখ্যাত ব্যক্তিদের ছবি

মাটির ঘরের পাশে ‘আলপনা বাড়ি’তে যুক্ত হয়েছে দুটো পাকা ঘর। জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে দেয়া হয়েছে এ ঘর। সেই ঘরগুলোর দেয়ালও আলপনায় রাঙিয়ে তুলেছেন বাড়ির মেয়েরা।

দেখন বর্মন বলেন, লেখাপড়া তিনি কিছুই জানেন না। নিজের মনে যা ভালো লাগে তাই আঁকেন। কবে থেকে আঁকা শুরু করেছেন, তার হিসাব মনে না থাকলেও বলেন, ‘বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে এলাম, তখন বাড়ি লেপার সময় আমি লাল মাটি দিয়ে করতাম, এতে রং আসত। বিভিন্ন ধরনের মাটি ও বিভিন্ন ফুল ও লতাপাতা দিয়ে রং তৈরি করলাম।

‘এরপর মনে হলো একটু নকশা করি। এভাবেই যখন যেটা মনে এসেছে, তারই নকশা করেছি। বাড়ির লোকেরা খুশি হতো, সবাই দেখত। এরপর বাড়তে বাড়তে গত ২০ বছর থেকে এখন দেশ-বিদেশ সব জায়গা থেকে মানুষ আসে দেখতে। গত দুই-তিন বছর থেকে প্রতিদিনই মানুষ আসে। সবাই বলে আপনি বিরক্ত হন না? আমি বলি না। কেউ বলে, কাকিমা একটা ছবি তুলব, সবার সাথেই কথা বলে আমার দিন কেটে যায়।’

আলপনা আঁকার কাজ করে থাকে শিশুরাও

আলপনা আঁকার খরচ কীভাবে ওঠে? দেখন বর্মনের উত্তর, ‘আমি দুটা কাপড় কম কিনে আলপনা আঁকি। বাড়িতে তিনটা গরু আছে। সেগুলো লালন-পালন করে চলে যায় সংসার। আমার কোনো ভিটেমাটি নেই। সরকারিভাবে বাড়িটা করে দিয়েছে। সেখানেই আছি।’

দেখন বর্মনের মেয়ে অনীতা বর্মন তাদের বাড়িতে রাখা একটা ভিজিটর বই বের করে এনে দেখান, বইয়ের পাতা ভরে গেছে দর্শনার্থীদের মন্তব্যে। অনীতা বর্মন বলছিলেন, নিজেদের ভালোলাগা থেকে এ আলপনাগুলো করলেও এখন সবাই দেখতে আসে। ভালোই লাগে।

অনীতা জানান, সাধারণ দুর্গাপূজার সময় আলপনা করেন তারা। এছাড়া কীর্তনের সময়ও নতুন করে আলপনা আঁকা হয়। তবে কোনো আলপনার রং চটে গেলে আবার আঁকেন। যেহেতু এখন দূরদূরান্ত থেকে লোক আসে দেখতে। এ কারণে দর্শনার্থীদের কথা মাথায় রেখে সুযোগ পেলেই আলপনা আঁকেন তারা।

দেখন বর্মনের আরেক মেয়ে জয়া বর্মন, মায়ের এমন সৃষ্টিশীল কাজ নিয়ে গর্ব অনুভব করেন। একজন নারী হয়ে তার মা গ্রামের অন্যদের পথ দেখিয়েছেন।

জয়া বলেন, ‘আমার মায়ের কারণে জেলা প্রশাসকসহ দেশ-বিদেশের অনেক বড় বড় মানুষ এসেছেন। যাদের কাছে আমরা কোনোদিনই যেতে পারতাম না, তারা আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছেন। আমার মায়ের এই আলপনার জন্যই এ গ্রামটা সবার কাছেই পরিচিতি পেয়েছে। টিকোইল গ্রাম পরিচিতি পেয়েছে ‘আলপনা গ্রাম’ নামে।’

একটি বেসরকারি সংস্থায় কাজ করেন জয়া বর্মন। বলেন, তাদের বাড়ির পেছনে থাকা সরকারি পুকুরটি সংস্কার করে সেখানে একটি বা দুটি ছোট নৌকা রাখা গেলে দর্শনার্থীরা নৌকার চড়ে আরও কিছুটা সময় গ্রামীণ পরিবেশে কাটাতে পারতেন।

আলপনায় তুলে ধরা হয় নানা মোটিফ

টিকোইল গ্রামে আলপনা আঁকার পথ দেখানো দেখন বর্মনের কাছে আলপনা আঁকা শিখেছেন তার নাতনি সাথী বর্মন। স্থানীয় উচ্চ বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণিতে পড়া সাথী বর্মন বলছিলেন, তার আলপনা আঁকতে ভালো লাগে, তার দাদির কাছে গ্রামের সবাই আলপনা আঁকা শিখে এখন আলপনা করে বাড়িতে।

গ্রামের অন্য বাড়িগুলোতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির মেয়ে ও বধূরা আলপনা আঁকা শিখে নিয়েছেন। টিকোইল গ্রামের শ্রীমতী শম্পা রাণী তেমনি একজন। তিনি এখন নিজ বাড়িতে আলপনা নিজেই আঁকতে পারেন।

শম্পা রাণী বলেন, তাদের গ্রামে অনেকেই আসেন আলপনা দেখতে, এটা তাদের ভালোই লাগে।

নেজামপুর গ্রামের সমাজকর্মী মনিরুল ইসলামের মতে, টিকোইল গ্রামের নারীদের করা আলপনার কারণে তাদের ইউনিয়ন নাচোল উপজেলায় সবার কাছে পরিচিত হয়েছে, পেয়েছে নতুন মাত্রা। এ গ্রামের কারণেই এখানে পাকা রাস্তা হয়েছে, বসেছে সৌর বিদ্যুতের সড়ক বাতি, জেলা প্রশাসনসহ সবার নজরে পড়েছে গ্রামটি। এর সুফল পাচ্ছে এলাকার সবাই।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে এ গ্রাম দেখতে এসেছেন গোলাম রশিদ। তিনি জানান, এই গ্রামটি সবার কাছে খুব বেশি পরিচিত ছিল না। এখানকার নারীদের করা আলপনায় গ্রামটি শুধু দেশে নয়, বিদেশেও পরিচিত হয়ে উঠেছে।

সৃজনশীল দেখন বর্মনের একটা ইচ্ছা সবস ময়ই উঁকি দেয়। কোনো একদিন তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কানে পৌঁছাবেন তার এ শিল্পকর্মের কথা, তার আলপনার কথা। কথার কথায় তিনি বলেন, ‘এত মানুষ আমার কাজ দেখে, যদি প্রধানমন্ত্রীর সাথে একবার দেখা করার সুযোগ হতো, তাহলে আমার আলপনা গ্রামে তাকে দাওয়াত দিতাম, আমাদের গ্রামের মানুষের করা আলপনা দেখে তিনি খুশি হতেন।’

এ বিভাগের আরো খবর