একাত্তরের ডিসেম্বরে বিজয়ের ঠিক আগ মুহূর্তে পাকিস্তানের এজেন্টরা একে একে ধরে নিয়ে যায় লেখক, শিক্ষক, সাংবাদিক, শিল্পী, চিকিৎসকসহ দেশের সূর্য সন্তানদের।
এদের মধ্যে ছিলেন লেখক শহীদুল্লাহ কায়সার।
ওই বছরের ৩০ জানুয়ারি শহীদুল্লাহর ছোট ভাই জহির রায়হান জানতে পারেন, বড় ভাইকে ঢাকার মিরপুরে রাখা হয়েছে।
বড় ভাইয়ের খোঁজে মিরপুরে ছুটে যান জহির। এরপর কত ‘আরেক ফাগুন’ চলে গেছে, কত জল গড়িয়েছে ‘বরফ গলা নদী’তে। কিন্তু তিনি আর ফিরে আসেননি। সদ্য স্বাধীন দেশে ভাইকে খুঁজতে গিয়ে চিরতরে নিখোঁজ হলেন তিনি।
এরপর থেকে এ দিনটিকে জহির রায়হানের ‘প্রয়াণ দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়।
১৯৩৫ সালে ফেনী জেলার মজিপুর গ্রামে জন্ম হয় জহিরের। বাবা মওলানা মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ কলকাতা আলীয়া মাদ্রাসার অধ্যাপক ও ঢাকা আলীয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ছিলেন।
জহির রায়হান কলকাতায় মিত্র ইনস্টিটিউট ও পরে আলীয়া মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেন। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর পরিবারের সঙ্গে গ্রামে ফেরেন তিনি।
১৯৫০ সালে ফেনীর আমিরাবাদ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকায় কলেজে ভর্তি হন জহির। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা বিভাগে স্নাতক (সম্মান) শেষ করেন তিনি।
অল্প বয়সেই কমিউনিস্ট রাজনীতিতে যুক্ত হন জহির। সে সময় কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ছিল। পার্টিতে কুরিয়ারের দায়িত্ব পালন করতেন তিনি। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চিঠি ও সংবাদ পৌঁছে দেয়া ছিল তার কাজ।
জহিরের পারিবারিক নাম জহিরুল্লাহ। রাজনৈতিক সংগঠনটি গোপন হওয়ায় সেখানে তার নাম রাখা হয় রায়হান। এর পর থেকেই তিনি জহির রায়হান নামে পরিচিত।
১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী ছিলেন জহির। ২১ ফেব্রুয়ারি যে ১০ আন্দোলনকর্মী প্রথম ১৪৪ ধারা ভেঙেছিলেন, তাদের মধ্যে তিনি ছিলেন। অন্যদের সঙ্গে তাকেও মিছিল থেকে গ্রেপ্তার করে কারারুদ্ধ করা হয়।
ছাত্রজীবন থেকে শুরু জহির রায়হানের লেখালেখি। ১৯৫৫ সালে প্রথম প্রকাশ হয় তার গল্পসংগ্রহ ‘সূর্যগ্রহণ’। এর পরে লেখেন ‘শেষ বিকেলের মেয়ে’, ‘হাজার বছর ধরে’, ‘আরেক ফাল্গুন’, ‘বরফ গলা নদী’ এবং ‘আর কত দিন’।
‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাসের জন্য আদমজী পুরস্কার পান জহির। ১৯৭২ সালে তাকে বাংলা একাডেমি পুরস্কার দেয়া হয়।
১৯৫৬ সালে শুরু হয় জহিরের চলচ্চিত্র নির্মাণকাজ। ১৯৬১ সালে মুক্তি পায় প্রথম চলচ্চিত্র ‘কখনও আসেনি’।
এরপর একে একে নির্মাণ করেন ‘কাজল’, ‘কাঁচের দেয়াল’, ‘বেহুলা’, ‘জীবন থেকে নেয়া’, ‘আনোয়ারা’, ‘সঙ্গম’ ও ‘বাহানা’।
‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিতে প্রতীকী কাহিনির মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের স্বৈরশাসনকে তুলে ধরা হয় এবং জনগণকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে উদ্বুদ্ধ করা হয়।
‘লেট দেয়ার বি লাইট ’ নামের একটি ইংরেজি চলচ্চিত্রের নির্মাণ শুরু করেন জহির। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ায় তিনি তা শেষ করতে পারেননি।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর জহির কলকাতায় গিয়েছিলেন। সেখানে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার গণহত্যা নিয়ে নির্মাণ করেন ডকুমেন্টারি ফিল্ম ‘স্টপ জেনোসাইড’। এ চলচ্চিত্রটি বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে।