উনিশ শতকে বাংলা সাহিত্যের নবজাগরণের অন্যতম পুরোধা, বাংলা ভাষায় অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্মদিন আজ।
১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি যশোরের কেশবপুরের কপোতাক্ষ নদের তীরে সাগরদাঁড়ি গ্রামের বিখ্যাত দত্ত পরিবারে জন্ম হয় তার।
মায়ের কাছেই মধুসূদনের শিক্ষাজীবন শুরু। সাগরদাঁড়ির পাঠশালায় পড়াশোনা করলেও মাত্র সাত বছর বয়সে পাড়ি জমান কলকাতায়। খিদিরপুর স্কুলে দুই বছর পড়ার পর ১৮৩৩ সালে হিন্দু কলেজে ভর্তি হন তিনি। সেখানেই শেখেন বাংলা, সংস্কৃত ও ফারসি ভাষা।
১৮৩৪ সালে তিনি কলেজের পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে ইংরেজি ‘নাট্যবিষয়ক প্রস্তাব’ আবৃত্তি করে নজর কাড়েন। এখানে পড়াশোনার সময় নারীশিক্ষা বিষয়ে প্রবন্ধ লিখে স্বর্ণপদক জিতেন তিনি।
হিন্দু কলেজে পড়ার সময়েই মধুসূদনের কাব্যচর্চার শুরু। সেই সময়ে তার কবিতা জ্ঞানান্বেষণ, বেঙ্গল স্পেকটেটর, লিটারারি গ্লেমার, ক্যালকাটা লাইব্রেরি গ্যাজেট, লিটারারি ব্লোসম, কমেট পত্রিকায় প্রকাশ হতো।
১৮৪৪ থেকে ১৮৪৭ সাল পর্যন্ত তিনি বিশপস কলেজে অধ্যয়ন করেন। সেখানেই তিনি ইংরেজি ছাড়াও গ্রিক, ল্যাটিন ও সংস্কৃত ভাষা শেখার সুযোগ পান।
এ সময় ধর্মান্তরের কারণে মধুসূদন তার পরিবার, আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। তার বাবাও একসময় অর্থ পাঠানো বন্ধ করে দেন।
এমন পরিস্থিতিতে ভাগ্যান্বেষণে ১৮৪৮ সালে মাদ্রাজ যান মধুসূদন। সেখানে তিনি দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেন। ১৮৪৮ থেকে ১৮৫২ সময়কালে তিনি মাদ্রাজ মেইল অরফ্যান অ্যাসাইলাম স্কুলে এবং ১৮৫২ থেকে ১৮৫৬ সময়কালে মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত হাইস্কুলে শিক্ষকতা করেন।
মাদ্রাজের সঙ্গে মধুসূদনের জীবনের ঘটনাবহুল অনেক স্মৃতি জড়িত। এখানেই তিনি সাংবাদিক ও কবি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।
তিনি ১৮৪৮ থেকে ১৮৫৬ সময়কালে ইউরেশন (পরবর্তী সময়কার ইস্টার্ন গার্ডিয়ান), মাদ্রাজ সার্কুলেটর, জেনারেল ক্রনিকল ও হিন্দু ক্রনিকল পত্রিকা সম্পাদনা করেন। একই সময়ে মাদ্রাজ স্পেকটেটর পত্রিকার সহকারী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
মাদ্রাজে অবস্থানকালেই ছদ্মনামে তার প্রথম ও দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ হয়।
টিমোথি পেনপোয়েম ছদ্মনামে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ দ্য ক্যাপটিভ লেডি এবং দ্বিতীয় গ্রন্থ ভিশন্স অফ দ্য পাস্ট প্রকাশ হয়।
মাদ্রাজেই রেবেকা ও হেনরিয়েটার সঙ্গে তার প্রথম ও দ্বিতীয় বিয়ে হয়। এখানে বসেই তিনি ইতালিয়ান, ফরাসি, জার্মান, হিব্রু, তামিল ও তেলেগু ভাষা শিখেন।
১৮৫৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কলকাতা আসেন মধুসূদন। এ সময় বিভিন্ন পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখেন এবং বাংলায় সাহিত্যচর্চার তাগিদ অনুভব করেন।
১৮৫৮ সালে রামনারায়ণ তর্করত্নের রত্নাবলী নাটকটি ইংরেজিতে অনুবাদ করতে গিয়ে তিনি বাংলা নাট্যসাহিত্যে উপযুক্ত নাটকের অভাব অনুভব করেন। তখন তার বাংলায় নাটক রচনার ইচ্ছা জাগে।
তিনি মহাভারতের দেবযানী-যযাতি কাহিনি অবলম্বনে ১৮৫৮ সালে পাশ্চাত্য রীতিতে রচনা করেন নাটক ‘শর্মিষ্ঠা’। এটিই প্রকৃত অর্থে বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম মৌলিক নাটক। একই অর্থে মধুসূদনও বাংলা সাহিত্যের প্রথম নাট্যকার।
পরের বছর মধুসূদন রচনা করেন দুটি প্রহসন- ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ ও ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’।
প্রথমটিতে তিনি ইংরেজি শিক্ষিত ইয়ং বেঙ্গলদের মাদকাসক্তি, উচ্ছৃঙ্খলতা ও অনাচারকে কটাক্ষ করেন। দ্বিতীয়টিতে রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের আচারসর্বস্ব ও নীতিভ্রষ্ট সমাজপতিদের গোপন অভিসার তুলে ধরেন।
এ ক্ষেত্রেও মধুসূদন পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন। তার প্রহসন দুটি কাহিনি, সংলাপ ও চরিত্রসৃষ্টির দিক থেকে আজও অতুলনীয়।
১৮৬০ সালে তিনি গ্রিক পুরাণ থেকে কাহিনি নিয়ে রচনা করেন নাটক ‘পদ্মাবতী’।
এ নাটকেই তিনি পরীক্ষামূলকভাবে ইংরেজি কাব্যের অনুকরণে অমিত্রাক্ষর ছন্দের ব্যবহার করেন। বাংলা কাব্যে এ ছন্দের ব্যবহার এটাই প্রথম। এর মাধ্যমে তিনি বাংলা কাব্যকে ছন্দের বন্ধন থেকে মুক্তি দেন।
অমিত্রাক্ষর ছন্দের ব্যবহারে এই সফলতা তাকে ভীষণভাবে উৎসাহ জোগায় এবং এই ছন্দে একই বছর তিনি রচনা করেন কবিতা ‘তিলোত্তমা সম্ভব’।
পরের বছর ১৮৬১ সালে রামায়ণের কাহিনি নিয়ে একই ছন্দে তিনি রচনা করেন তার সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি মহাকাব্য ‘মেঘনাদবধ’। এটিই বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম মৌলিক মহাকাব্য।
বাংলা সাহিত্যকে তিনি সমৃদ্ধ করে গেছেন বাংলা ভাষায় প্রকাশিত ১২টি গ্রন্থ দিয়ে। এ ছাড়াও ইংরেজি ভাষায় তার ৫টি গ্রন্থ রয়েছে।
১৮৭৩ সালের ২৯ জুন আলিপুর জেনারেল হাসপাতালে মৃত্যু হয় বাংলা সাহিত্যের এ যুগপ্রবর্তকের।