ইরানে ফার্সি ভাষায় বিশ্বকবি রবীন্দ্র চর্চা নিয়ে বই লিখেছেন বরিশালের প্রবীণ সাংবাদিক আনিসুর রহমান খান স্বপন। বইয়ের নাম ‘পারস্যে রবীন্দ্রনাথ’ ও ‘ফার্সী ভাষার ব্যাকরণ’।
বই দুটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্সি বিভাগে পড়ানো হয়।
বর্তমানে কাজ করছেন ইরানের প্রাচীন ধর্ম ‘আভেস্তা’ নিয়ে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও গবেষণা করছেন এই গবেষক। তার উদ্যোগে প্রতিবছর বিজয় দিবস ও স্বাধীনতা দিবসে মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র প্রদর্শন করা হয় নতুন প্রজন্মের জন্য।
আনিসুর জানান, বরিশালে স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসে মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র প্রদর্শনী করা হয় রিপোর্টার্স ইউনিটির সহযোগিতায়। এখানে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত পাঁচশ বই, মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রশিক্ষণে ডামি বন্দুক, রেডিও, মাইনসহ সে সময়কার স্মৃতি বিজড়িত ছবিগুলো প্রদর্শন করা তরুণ প্রজন্মের জন্য। এই প্রদর্শনী মূলত আগামী প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আরও ভালো ধারণা দেয়ার জন্যই করা হয়।
আনিসুর রহমানের সংগ্রহে আছে হাতে লেখা বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান এবং কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে লেখা গীতাঞ্জলিসহ অসংখ্য দুর্লভ বই আছে। রয়েছে মুক্তিযুদ্ধকালীন পত্রিকার কপিও।
ইরানে রবীন্দ্রচর্চা নিয়ে আগ্রহ যেভাবে
আনিসুর রহমান খান স্বপন জানিয়েছেন, ১৯৮৬ সালে ইরানে যুদ্ধের সময় সে দেশে যান সংবাদ সংগ্রহে।
‘তখন তেহরানের দুইটি মিডিয়া হাউসে কর্মরত ছিলাম। সেখানে বেশ ঝুঁকির মধ্যে আমাদের কাজ করতে হতো। ১০ বছর টানা কাজ করি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে সেখানে গবেষণা করেছি।’
তিনি বলেন, ‘ইরানে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতি এবং ভ্রমণ নিয়েও আমার কাজ রয়েছে।’
৭০ বছর বয়সে ১৯৩২ এর গ্রীষ্মে পারস্য সফর করেন রবীন্দ্রনাথ।
আনিসুর রহমান জানান, ইরানে যাওয়ার পর ‘পারস্যে রবীন্দ্রচর্চা’ সম্পর্কে আগ্রহ যাগে তার।
কাজ করতে গিয়ে দেখেন, ইরানের সিংহভাগ মানুষই প্রথম দৃষ্টিতে বাংলাদেশিদেরকে হিন্দিভাষী বা ভারতীয় বলে মনে করে। কয়েকজন শোবেহ হিন্দি বা ভারতীয় উপমহাদেশের অংশ হিসেবে বাংলাদেশকে চেনে।
তিনি বলেন, “আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রেক্ষাপট, ভাষা, জাতীয়তা যে ভারত থেকে পৃথক, তা এখানে বোঝাতে কিছুটা সময় নষ্ট হয়। তবে আসল কথা হচ্ছে আধুনিক ইসলামি প্রজাতন্ত্রের ইরানের শিক্ষিত সমাজ ভারতের কবি হিসেবে জানেন ‘তাগোর’ বা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেই এবং তিনি যে ভারতের মতো বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতেরও রচয়িতা, তা জেনে তারা বিস্মিত হন।’
রবীন্দ্রনাথকে পারস্যে সংবর্ধনা দেয়া হয় সেখানকার কবি শেখ সাদীর মাজারে। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে সেখানকার অনেক কবি কাজ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের লেখা ফার্সি ভাষায় অনুবাদ করে সেখানেও রবীন্দ্রচর্চার জোর দিয়েছেন সেই কবি ও সাহিত্যিকরা।
কবিগুরু ১৯৩২ সালের ১১ এপ্রিল পারস্যের উদ্দেশ্যে কলকাতা ছাড়েন। পারস্য সম্রাটের আমন্ত্রণে অনুষ্ঠিত এই সফরে কবির সঙ্গী ছিলেন পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী, অমিয় চক্রবর্তী, কেদারনাথ চট্রোপাধ্যায় এবং বন্ধু দীনশা জে জে বাবায়ী ইরানি।
পারস্য সম্রাটের প্রতিনিধি এবং কবি-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীরা কবিকে স্বাগত জানান। এর মধ্যে ২৩ এপ্রিল কবি ইস্ফাহানে প্রবেশ করেন। সেখানে ছয় দিন অবস্থানকালে ইস্ফানের বিখ্যাত মসজিদ, প্রাসাদ, বাগ বাগিচা, গির্জা, ঐতিহাসিক ও দ্রষ্টব্য স্থানসমূহ কবি পরিদর্শন করেন।
এরপর কবি তেহরানে যান। সেখানে দুই সপ্তাহ থাকার সময় কবিকে কেন্দ্র করে ১৮টি অনুষ্ঠান হয়। ৬ মে কবির ৭০ তম জন্মদিন উপলক্ষে পারস্য সম্রাটের আদেশে বাগ-এ-নিরুদৌলায় সমস্ত দিনব্যাপী উৎসব হয়।
এ সময় কবিকে হাজার হাজার লোকের অভিবাদন, অভিনন্দন, টেলিগ্রাম, পুষ্পস্তবক ও উপহার এবং পারস্য রাজ্যের পক্ষ হতে বিজ্ঞান-সাহিত্যের প্রথম শ্রেণির রাজকীয় পদক ও সনদ দেয়া হয়।
১৫ মে কবি ইরানের সে সময়ের বাদশা ফয়সালের আমন্ত্রণে বাগদাদে যান।
এক মাস ২২ দিন পর ৩ জুন ইরাক ও পারস্য ভ্রমণ শেষে কবি কলকাতায় আসেন।
রবীন্দ্রনাথের পারস্য সফর- সে দেশের শুধু প্রশাসনিক, সাংস্কৃতিক অঙ্গনেই নয়; বরং ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক অঙ্গনেও প্রচুর সাড়া জাগিয়েছিল। তাছাড়া সে সময়কার ইরানি পত্রিকায় কবির সাক্ষাতকার ছাপা হয়।
বরিশাল কবিতা পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ মেহেদী হাসান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘পারস্যে যে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে চর্চা হয় সেটা একমাত্র আনিসুর রহমান খান স্বপনের মাধ্যমেই জেনেছি।’
খেলাঘরের সংগঠক মইনুল ইসলাম সবুজ বলেন, ‘আনিস ভাইকে এক কথায় আমি সব্যসাচী হিসেবে চিনি। তিনি যেমন একাধারে সাংবাদিক, অপরদিকে তার গবেষণা অতুলনীয়। অনেক সাংবাদিক, শিক্ষক রাতের পর রাত শুধু বসে থাকে জ্ঞান আহরণের জন্য।’
শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাত বরিশাল প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক এসএম জাকির হোসেন বলেন, ‘বরিশালে তাকে (আনিসুর) সাংবাদিকদের গুরু হিসেবে চেনে। তাকে সাংবাদিকদের সাংবাদিকও বলে অনেকে। তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে অনেক কাজ করেছেস। যেটা আমাদের বাঙালিদের সম্পদ হিসেবে আমি মনে করি।’
আনিসুর রহমান খান স্বপনের জন্ম ১৯৫৭ সালের ৩০ জানুয়ারি। জন্ম ঢাকায় হলেও পড়াশোনা করেন বরিশালের ব্রজমোহন স্কুল ও ব্রজমোহন কলেজে। বাংলা সাহিত্যে স্নাতক এবং পরে স্নাতকোত্তর করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে কিছুদিন এম ফিল এবং ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি গবেষণা করলেও তা অসমাপ্ত রেখে ১৯৮৬ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত থাকেন তেহরানে।
সেখানে কাজ করেছেন রেডিও তেহরানের বাংলা অনুষ্ঠানে এবং ডেইলি তেহরান টাইমস এ।
তিনি পশ্চিমবঙ্গের প্রতিক্ষণ, বিভাব ও সাংস্কৃতিক খবরেও লেখালেখি করতেন নিয়মিত।
ফার্স ব্যাকরণ নামে তার প্রথম গ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯৯০ সালে। এরপর ১৯৯৩ সালে পারস্যে রবীন্দ্রনাথ, ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশে ফার্সি ভাষা ও সাহিত্য, ১৯৮৬ সালে অনুবাদ একটি মোরগের কাহিনি, ১৯৮৭ সালে পারলৌকিক জীবন এবং ১৯৯১ সালে সফরজাদেহ: স্বনির্বাচিত কবিতা নামে তার গ্রন্থ প্রকাশিত হয়।
প্রকাশিতব্য রয়েছে, মাহদী সহেলির কবিতা, দারাশুকোহর অনুদিত উপনিষদ, নাজিম হিকমতের কবিতা, খলিল জীব্রানের সুভাষিত সুবচন, জরথ্রুষ্ট্রের আভেস্তা।