বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

মান্নান হীরা সাম্যের কথা বলতেন

  • অমিত রঞ্জন দে   
  • ২৪ ডিসেম্বর, ২০২০ ২১:২৬

মান্নান হীরা কেবলই নাটক করার জন্য নাটক করেননি। তিনি নাটক করতেন মানুষের জন্য, বিশ্বাস করতেন ‘শিল্প কেবল বিনোদনের জন্য না, মানুষের জন্য।’ তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মানুষে মানুষে সাম্য প্রতিষ্ঠায় মেধা, মনন ও কলমে লড়েছেন।

বুধবার রাত ৯টা ৪১ মিনিটে টুই টুই শব্দে ফেসবুকের ম্যাসেঞ্জারে একটি খবর ভেসে উঠল। নাট্যকার মান্নান হীরা আর নেই। মালিবাগের বাসায় হৃদযন্ত্রে সমস্যা দেখা দিলে কাকরাইল ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে নেয়ার পথে রাত পৌনে নয়টায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন।

মোবাইলের স্ক্রিনে কত সময় যে চোখ নিবদ্ধ হয়ে রইল বলতে পারবো না। এমনি করে আমার মতো অজস্র মানুষের চোখ আটকে যায় মোবাইল স্ক্রিনে। হীরা ভাই আপনি এভাবে চলে গেলেন? মাত্র ৬৩ বছর বয়সে কি এমন তাড়া ছিল?

১৯৫৬ সালে সিরাজগঞ্জ জেলায় তার জন্ম। সেখান থেকে মাধ্যমিক, রাজশাহী সরকারি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায়ই নাট্যচর্চার সাথে যুক্ত হন। শুরু থেকে যুক্ত থাকেন আরণ্যক নাট্যদলের সঙ্গে।

মান্নান হীরা কেবলই নাটক করার জন্য নাটক করেন নি। তিনি নাটক করতেন মানুষের জন্য, বিশ্বাস করতেন ‘শিল্প কেবল বিনোদনের জন্য না, মানুষের জন্য।’ তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মানুষে মানুষে সাম্য প্রতিষ্ঠায় মেধা, মনন ও কলমে লড়েছেন।

প্রধানত তিনি নাট্যকার হলেও অভিনয়, নির্দেশনাসহ অন্যান্য শাখার সঙ্গেও তার নিবিড় সম্পর্ক ছিল। সব সময় তিনি নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন মঞ্চনাটক, টেলিভিশন ও পথনাটক রচনায়।

তার নাটকের প্রধান উপাদান নিরন্ন মানুষ ও দরিদ্র জনপদ। প্রাণ-প্রকৃতিও সমাধিক গুরুত্ব পেয়েছে তার নাটকে। বিশেষ করে মান্নান হীরার নাটকসমূহ কৃষিজীবী মানুষ, তাদের উৎপাদন ও উপকরণ কেন্দ্র করে লেখা। তীক্ষ্ণ সংলাপের ঘাত-প্রতিঘাতে মান্নান হীরার নাটক যেমন অভিনয় উপযোগী, তেমনি সুখপাঠ্য।

তার লেখা উল্লেখযোগ্য নাটকগুলোর মধ্যে ময়ূর সিংহাসন, ভাগের মানুষ, ‘লাল জমিন’, ‘সাদাকালো’, ‘মুর্খ লোকের মুর্খ কথা’, ‘আদাব’, ‘বৌ’, ‘ফেরারী’ ‘নিশান’, ‘ঘুমের মানুষ’, ‘শেকল’, ‘জননী বীরাঙ্গনা’, ‘একাত্তরের রাজকন্যা’, ‘মেহেরজান’, ‘ফুটপাত’, ‘রেফারী’, ‘বাংলার বাদশা’ ও ‘সুখদৈত্য’ অন্যতম।

তিনি নির্মাণ করেছেন শিশুতোষ চলচ্চিত্র ‘একাত্তরের ক্ষুদিরাম’। নির্মাণ করেছেন স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘গরম ভাতের গল্প’ এবং ‘একাত্তরের রঙ পেন্সিল’।

মান্নান হীরা রাজনৈতিকভাবে সমাজতান্ত্রিক দর্শনে বিশ্বাস করতেন। সে দর্শনকে ভালোবেসেই তিনি মঞ্চে, পথে বা টেলিভিশনের জন্য নাটক নির্মাণ করেছেন। তাই তার নাটকে প্রচ্ছন্ন রাজনীতিকে কেন্দ্রে রেখে প্রেম ও অন্যান্য সামাজিক সম্পর্কগুলি আবর্তিত হয়েছে। প্রথাগত সমাজ ও রাষ্ট্র কাঠামো ভেঙে ফেলতে অনুপ্রেরণা জোগায় তার লেখা নাটক।

তার রচিত রাজনীতি আশ্রয়ী পথনাটক প্রশংসিত হয়েছে দেশ-বিদেশে। তার একাধিক নাটক অনূদিত হয়ে দিল্লি, হংকং, পাকিস্তান, নেপালসহ অনেক দেশে প্রদর্শিত হয়েছে।

মান্নান হীরা বাংলাদেশের পথনাটক অঙ্গনে এক অনন্য নাম। যে কজন নাট্যকার বা নাট্যব্যক্তিত্ব এ দেশের পথনাটককে সমৃদ্ধ করেছেন, মান্নান হীরা তাদের অন্যতম।

বাংলাদেশে পথনাটক আন্দোলনকে গতিশীল করতে তিনি একাধারে নাটক লিখেছেন, নির্দেশনা দিয়েছেন। ১৯৯৯ সাল থেকে আমৃত্যু পথনাটক নিয়ে চর্চারত দলসমূহের মোর্চা ‘বাংলাদেশ পথনাটক পরিষদের’ সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনিই পথনাটক পরিষদের প্রথম সভাপতি নির্বাচিত হন।

২০০১ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত পথনাটক পরিষদের বিভিন্ন পদে থেকে তার সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়েছে। এ সময় দেখেছি এক অসাধারণ ধীশক্তি সম্পন্ন মানুষ তিনি। পথনাটক পরিষদের সমবেত বিভিন্ন চিন্তার মানুষদের মতামতকে ধারণ করে সময়ের বিবেচনায় অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে তাকে সিদ্ধান্ত নিতে দেখেছি। অনেকেই সরকারের সঙ্গে থাকতে চেয়েছেন, অনেকে বিপক্ষে যেতে চেয়েছেন, কেউ রেখে-ঢেকে বলতে চেয়েছেন। কিন্তু হীরা ভাই টলে যান নি কখনো। যেটা বলা সমীচীন সেটাই বলেছেন।

হীরা ভাই শুধু নিজের দলে নাটক করে বা দলের কর্মীদের প্রশিক্ষিত করে থেমে থাকেন নি। অন্যদের গড়ে তুলতে বা পথনাটক আন্দোলনে সম্পৃক্ত করতে যা যা করা দরকার তাই করেছেন।

উদীচীর প্রয়োজনে যখনই বলেছি হীরা ভাই আপনার নেতৃত্বে একটি প্রশিক্ষণ আয়োজন করতে চাই বা অমুক জেলায় উদীচীর সম্মেলন আছে আপনাকে অতিথি হিসেবে যেতে হবে। সাধারণত উনি ফিরিয়ে দেন নি। মাটির মানুষের জন্য মাটি কামড়ে থাকা এই মানুষটি ২০০৬ সালে নাটক শ্রেণিতে ‘বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার’ লাভ করেন।

চাকরি, উদীচী সব দায়িত্ব মিলিয়ে ২০১৬ থেকে আমি পথনাটক পরিষদ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেই। কিন্তু হীরা ভাই তাতে খুশী হতে পারেন নি। দেখা হলেই তার কথায় সেটা প্রকাশ পেত। এই গতবছরও পানুপালের জন্ম শতবার্ষিকীতে তার নাতনী মধুমিতা পাল আসলে তার সামনে শিল্পকলা একাডেমির ভিতরে স্বভাবসুলভ ভাবেই তার বহি:প্রকাশ ঘটালেন।

বৈশ্বিক মহামারি করোনা ভাইরাসের দৌরাত্বে গত কয়েকমাস কারোর সঙ্গেই তেমন দেখা সাক্ষাৎ হয় না। সবশেষ দেখা হলো ২৪ অক্টোবর পিআইবি’র অডিটোরিয়ামে। সেখানে প্রদীপ ঘোষ পরিচালিত ‘ভালোবাসা প্রীতিলতা’ ছবির মহরত অনুষ্ঠানে। কথা ছিল আমরা দুজনেই প্রীতিলতা চলচ্চিত্রে অভিনয় করব। কিন্তু তা হলো না। যেন অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো সে প্রত্যশা।

অসম্ভব মেধা আর সৃজনে সমৃদ্ধ। মৃত্যুর আগে বাংলাদেশ টেলিভিশনে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর জিয়াউর রহমানের শাসন আমলে বিচারপতি আবু সায়েম যে ইনডেমনিটি বিল পাশ করে তা নিয়ে নাটক ‘ইনডেমিনিটি’ করলে তিনি মামলার শিকার হন। বিএনপি তার নামে মামলা করে। কিন্তু তিনি তার প্রত্যয়ে অনড় ছিলেন। বলতেন, এসব মামলা দিয়ে আমাদের কেউ থামাতে পারবে না। আমরা রাজপথে লড়াই করে বেঁচে থাকি। মহামান্য আদালত তার নামে মামলা খারিজ করে দেয়। সময়ে এই দুঃসাহসী মানুষটির প্রতি আনত শ্রদ্ধা।

লেখক: সহ-সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী।

এ বিভাগের আরো খবর