এক সময় পট (ছবি) দেখিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে পটের গান শোনাতেন পটুয়ারা। কালের বিবর্তনে প্রায় হারাতে বসা সেই গীতিকারদের খোঁজে বন্ধু অমলের নেতৃত্বে কোভিড ঝুঁকি মাথায় নিয়েই আমাদের যাত্রা শুরু।
গুলিস্তান থেকে টুঙ্গীপাড়া এক্সপ্রেসে মাওয়া হয়ে কাটাখালি পাঁচ ঘণ্টায়। কাটাখালি থেকে মাহেন্দ্র (এক ধরনের ত্রিচক্রযান) করে মোংলা রোডে দিগরাজ বাজার। দিগরাজের স্বল্প দূরত্বে পশুর নদীর খেয়াঘাট, ওপাড়ে বাজুয়া বাজার। খেয়া পারাপারে হাদিয়া জনপ্রতি ১০ টাকা। বাজুয়া থেকে কৈলাশগঞ্জের বুড়ির ডাবুর বাজার অটোরিক্সায় ৩০ টাকা প্রতিজন। জার্নি বাই লঞ্চ ইন সুন্দরবন-এ অভ্যস্ত আয়েশি পর্যটকদের কাছে যদিও এই যাত্রা দীর্ঘ প্যারা; আমাদের কাছে ওটা আনন্দ, খোঁজার-শেখার-জানার!
বুড়ির ডাবুর বাজার থেকে হাঁটা দূরত্বে শর্মিলা ইকো কটেজ। সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের কৈলাশগঞ্জের এই ইকো কটেজটি ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও আনুষ্ঠানিকভাবে অনুসন্ধিৎসু পর্যটকের জন্য চালু হয় ২০১৮ সালের শুরুর দিকে। মূলত, কমিউনিটি ইকো ট্যুরিজমকে প্রমোট করা এবং সুন্দরবনের বনজীবী মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের জন্যই এই কার্যক্রম।
আমরা একই দল এর আগে সাতক্ষীরার শ্যামনগরে সুন্দরবনের প্রত্যন্ত গ্রামে গোপাল মুণ্ডার ইকো কটেজেও রাত্রিযাপন করেছি। সে গল্প অন্যদিন!
গুলিস্তান থেকে সকাল ৮টায় রওয়ানা দিয়ে বিকেল ৪টার দিকে শর্মিলাদির কটেজে।
ছিমছাম ছায়ানীড়। গোলপাতার ছাউনি ঘেরা দুটো ঘর, সংযুক্ত প্রক্ষালনকক্ষ। প্রত্যন্ত সুন্দরবনেও বিদ্যুৎ সুবিধা বিদ্যমান। সামনে একটা পুকুর, পুকুরের ওপর বসার জন্য একটা গোলঘর, কিছু হেমক রয়েছে নারকেল গাছ ঘিরে। বাড়ির পাশে সবজি বাগান। আগত অতিথিদের আপ্যায়নের জন্য অন্যান্য সামগ্রীর সঙ্গে ক্ষেতের এই সতেজ সবজি খাবার টেবিলে রাজত্ব করে বলে জানালেন কটেজের স্বত্বাধিকারী শর্মিলা সরকারের স্বামী তপন সরকার।
স্নান ও জলযোগ সেরে বেরিয়ে পড়া। সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে বেড়ে ওঠা এই জনপদের মানুষেরা বনের মতোই উদার, লম্বাটে গাছের মতোই বিনয়ী। আশপাশ ঘুরে দেখলাম। পুরুষেরা ধানের কাজে ব্যস্ত, নারীরা পাটখড়িতে গোবর দিয়ে একধরনের জ্বালানি তৈরি করছে। একদম স্বচ্ছল না হলেও মোটামুটি সমৃদ্ধ গ্রাম।
সেদিন অষ্টমীর চাঁদ। দূর আকাশে কাস্তের মতো ওই চাঁদ মাঝনদীর আয়নায় নিজের মুখ দেখছিল, সেই ছবি আমাদের চোখে লেগে আছে এখনও।
সুন্দরবনের এক কোণে রাত্রিপ্রহরে নিঃস্তব্ধ অচেনা গ্রামে আরাম শীতনিদ্রা সারাদিনের ক্লান্তিকে বিদায় জানাতে যথেষ্ট।
পরের দিন সকালবেলা প্রাতঃরাশ সেরে ডিঙি নৌকায় সুন্দরবন ভ্রমণ। চাঁদপাই রেঞ্জের লাউডোবে ইঞ্জিনছাড়া নৌকায় আমরা ছয় জন।
মানিক, মাজেদ, বিজয়, অমল, ভিস্ম আর আমি। মাঝি অমিত জানাচ্ছিলেন, বছর দুয়েক আগে এই নদী পার হয়ে বাঘমামা লোকালয়ে উঠিছিল। বন্ধু অমল সাহস দিচ্ছিল- দুপুর বেলা নাকি বাঘ বেরোয় না! সত্য-মিথ্যা জানি না, তবে সেদিন দুপুরে অমলের কথা অক্ষরে অক্ষরে ফলেছিল।
সারা বিকেল পুকুরে মাছ ধরে সন্ধ্যায় কাঙ্ক্ষিত পটের গান।
শর্মিলাদির নেতৃত্বে আনন্দময়ী শিল্পী গোষ্ঠীর আয়োজনে সুন্দরবন নিয়ে পটের গান।
শর্মিলার পটের গানের দলের সঙ্গে লেখকসহ 'ভবঘুরে শাস্ত্র' ভ্রমণ দলের সদস্যরাপটের গানের উৎপত্তি পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমে। পশ্চিম মেদিনীপুর, বর্ধমান, মুর্শিদাবাদেও এই গানের প্রচলন রয়েছে। বাংলাদেশে এক সময় পটচিত্র দেখিয়ে ধানের বিনিময়ে গাজীর গান গেয়ে বেড়াত বেদে সম্প্রদায়ের মানুষ। মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা এবং তার আশপাশের অঞ্চলে পটুয়া বেদেদের বিচরণ ছিল।
শর্মিলাদির পটের গান সম্পূর্ণ সুন্দরবনকেন্দ্রিক। মায়ের মতো সুন্দরবনের আগলে রাখা, বাবার দৃঢ়তায় ঝড়ের হাত থেকে রক্ষা করা, বনে গাছ কাটা কিংবা হরিণ শিকার, চোরাকারবারির শাস্তি, পর্যটন, সুন্দরবন রক্ষায় পর্যটকদের করণীয়- কী নেই এই পটের গানে! শুরুটা এভাবে-
সুন্দর সুন্দরী আমার-
ওই না সুন্দরবন,
বাঘ রক্ষা করতে হবে-
মোদের সুন্দরবন!
ক্রমান্বয়ে ছবিতে ছবিতে গোলপাতার উপকারিতা, বনের সৌন্দর্য, প্রাণীকুল, নদী, মৎস্য গুছিয়ে গুছিয়ে বর্ণিত হয়েছে ওই পটের গানে।
শেষটায় নিবিড় আহ্বান পটের গানে-
সুন্দরবন আমাদের সকলের,
একে ধ্বংসের হাত থেকে
রক্ষার দায়িত্বও আমাদের।
এক সময় গভীর রাত ঘন হয়ে নেমে আসে কৈলাশগঞ্জে শর্মিলাদির কুটিরে। রাতভর কটেজ জুড়ে রেশ থেকে যায় পটের গানের। সকালে ঘুম ভাঙে তপনদার ডাকে। ফিরতে হবে। ফেরার পথে খাঁটি মধু সাতশ টাকা কেজি আর গোল পাতার গুড় শ টাকায়। সঙ্গে নিয়ে আসি স্মৃতিময় শর্মিলাদির দলের পটের গান। ফেরার আগে দিদি এগিয়ে দেন পরিদর্শন বহি।
কলম চলে-
এখানে এই শান্তিনীড়ে
মননের চিত্তাকাশে
শয়ন করে নিদ্রিত ক্লান্তি,
জাগ্রত চিবুকে শিস দেয়
রঙিন মাছরাঙা।
জমে থাকা আসুখেরা
বনের ওষুধে টনিকে ভাসে,
জঙ্গলরাত্রি জানান দেয়-
দিনশেষে প্রকৃতি তোমার সবচে আপন!
হিমাংশু পাল: শিক্ষক, ভ্রমণপিয়াসী