চল্লিশ বছরের বেশি সময় ধরে কার্টুন আঁকছি, প্রফেশনালি। কমিকস আঁকছি। যে কার্টুন আঁকে তাকে কি কমিকস আঁকতেই হবে? না ব্যাপারটা তা না; তবে তারা রিলেটেড। কার্টুন ক্যারেক্টার যদি ফ্রেমের ভিতর ঢুকে সংলাপ বলতেই থাকে তাহলেইতো দিব্যি কমিকস হয়ে উঠল।
‘ছেলেটা ভালো কমিক করে সবাইকে বেশ হাসায়।’ তবে ছেলেটা কমিকস হয়ত আঁকে না। কমিক আর কমিকসে এই পার্থক্য, এটাও এই ফাঁকে বলে ফেল্লাম।
বলতে যখন বসেছি সবই বলি না কেন? যা যা শিখেছি, প্রকৃতি আমাকে যা যা শিখিয়েছে সবই বলি, সঙ্গে নেওয়ারতো কিছু নেই...।
পদার্থবিদ ডিক ফাইনম্যান যিনি ম্যানহাটন প্রজেক্টের অন্যতম বিজ্ঞানী নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন।
তিনি বিজ্ঞান কি বলতে গিয়ে একবার বলেছিলেন, ‘প্রকৃতির চেতনা বুঝতে পারাই হচ্ছে বিজ্ঞান’ কার্টুন নিয়ে আমার এই হাবিজাবি লেখায় আবার ফাইনম্যানকে কেন টানাটানি?
আসলে মজার ব্যাপার হচ্ছে ফাইনম্যান খুব অদ্ভুত একটা মানুষ ছিলেন। তিনি যে কোনো তালা বা লক সে যত জটিলই হোক না কেন একবার দেখলেই বুঝে ফেলতেন এটা কীভাবে খুলতে হয়।
লক খোলা তার একটা নেশার মতো ছিল। বিখ্যাত ম্যানহাটন প্রজেক্টে বড় বড় বিজ্ঞানীরা যখন কাজ করছিলেন একসঙ্গে তখন প্রচণ্ড গোপনীয়ভাবে বিভিন্ন লকারে সব অতীব জরুরি কাগজপত্র ডকুমেন্টস লুকানো ছিল।
কিন্তু ফাইনম্যান তার যখন যে কাগজটা দরকার সেটা সেই লোকের রুমের লকার খুলে নিয়ে জেনে নিতেন। ব্যাপারটা এরকম- আরে ওকে বলে লকার খুলিয়ে কাগজ নেয়ার দরকার কি? আমিই খুলে বের করে নেই না কেন? পরে কাগজ আবার সেই লোকের হাতে হাতে ফেরত দিতেন। সেই লোক (হয়ত তিনিও কোনো বড় বিজ্ঞানী) হতভম্ব। এটা আপনার হাতে গেল কীভাবে? এটাতো আমার লকারেও ছিল।
ফাইনম্যান প্রসঙ্গ আনলাম অন্য কারণে। তিনি জীবনের একটা সময় হঠাৎ ছবি আঁকাআঁকি শুরু করে দিলেন। বেশ সিরিয়াসলি। তার ছবি বিক্রিও হতে শুরু করল।
তিনি আবিস্কার করলেন তিনি বিখ্যাত পদার্থবিদ নোবেল প্রাইজ পাওয়া- এ জন্য কি তার ছবি বিক্রি হচ্ছে? তিনি একটা ছদ্ম নাম নিয়ে ফেললেন ‘ও-ফে’। না; তারপরও তার ছবি বিক্রি হতো।
এই নিয়ে একটা মজার ঘটনা আছ- সেটা পরে বলছি। আগে বলি যে কারণে ফাইনম্যানকে আনলাম এখানে; ফাইনম্যান আর্ট আর বিজ্ঞানের একটা চমৎকার ব্যাখা দিয়েছেন; বা তিনি উপলদ্ধি করেছেন।
সেটা হচ্ছে একটা আর্ট একজনের ভালো লাগতে পারে। আবার দশজনের কাছে সেটা বাজে লাগতে পারে। আবার উল্টোটাও হতে পারে। একটা আর্ট দশজনের কাছে ভালো লাগতে পারে আবার একজনের কাছে জঘন্য লাগতে পারে। (সাহিত্যের ক্ষেত্রে মুভির ক্ষেত্রেও এটা হতে পারে) কিন্তু বিজ্ঞান? বিজ্ঞান একজন বা দশজনের ভালো লাগা মন্দ লাগার ব্যাপার না। বিজ্ঞান চিরন্তন শ্বাশত ...
তবে যেহেতু ‘আর্ট ইজ নট রিলেটেড টু সায়েন্স’ সেহেতু আপনি যেটাই আঁকেন সেটাই আর্ট। কেউ আপনাকে প্রশ্ন করতে আসবে না এটা কি ঘোড়ার ডিম এঁকেছ কাকের ট্যাং বকের ট্যাঙ! কিছুই হয়নি। কিন্তু কে জানে এই ঘোড়ার ডিম থেকে বের হওয়া কাকের ট্যাং বকের ঠ্যাং আরেকজনের অসম্ভব ভালো লেগে যেতে পারে।
সবচে বড় কথা আপনি যদি আর্টিস্ট হন কার্টুনিস্ট হন বা কমিকস আর্টিস্ট হন তাহলে কনফিডেন্স নিয়ে আঁকুন।
আবার সেই শুরুতে আসি। কার্টুন। কার্টুন কেন আঁকি? বরং একটা ঘটনা বলি। এই ঘটনা আমি বহু জায়গায় বলেছি, লিখেছিও। তারপরও আবার রিপ্লে করা যায়।
এক আর্কিটেক্ট হঠাৎ প্রফেশন বদলে কার্টুনিস্ট হয়ে গেলেন। পৃথিবীতে আর্কিটেক্টরা কার্টুনিস্ট হয়েছে এমন অনেক উদাহরণ আছে। তো একদিন এক সাংবাদিক তার ইন্টারভিউ নিতে এল
- আপনি আর্কিটেকচার পেশা ছেড়ে কেন কার্টুনিস্ট হলেন?
- আমি আসলে ঐ পেশায় সুবিধা করতে পারছিলাম না। বলতে পারেন ঐ পেশায় আমি মোটমুটি ব্যর্থ
- তাহলে কার্টুনিস্ট হয়ে কি সফল?
- না। এই লাইনেও ব্যর্থ
- তাহলে এখনো কার্টুন আঁকছেন কেন?
- কারণ বাই দিস টাইম আমি কার্টুনিস্ট হিসেবে বিখ্যাত।
এই গল্পটা কেন বললাম? আসলে কেউ বিখ্যাত হওয়ার জন্য কার্টুনিস্ট হয় না। সে যদি ভালো কাজ করে তাহলে বিখ্যাত তকমাটা তার পিছে ছুটবে।
আসলে যেটা বলতে চাচ্ছি কার্টুন এমন একটা পেশা যে কেউ যে কোনো সময় শুরু করতে পারে।
আমিতো বলি একটা কলম একটা সাদা কাগজ আর একটা পত্রিকা। ব্যাস আপনার কার্টুন আকার মাল মসলা হাতে চলে এসেছে।
এবার পত্রিকা পড়ুন, একটা নিউজ খুঁজে বের করুন- যেটা দিয়ে কার্টুন হতে পারে। তারপর এঁকে ফেলুন- দুজন মানুষ কথা বলছে ... ঐ বিষয়টা নিয়ে তির্যক দৃষ্টিকোণে। ব্যাস কার্টুন হয়ে গেল!
তবে যে জিনিষটা দরকার সেটা হচ্ছে সেন্স অফ হিউমার। এটা সবার ভিতরেই আছে, আমাদের বাঙালিদের ভিতরতো আছেই। চর্চা করলে আরো জোরেসোরে জিনিষটা বের হয়ে আসে।
জোকস পড়তে হবে বেশি বেশি; দশটা জোকস পড়লে একটা মৌলিক জোকস তৈরি করা যায়। আপনার তৈরি সেই জোকসটা নিয়ে হতে পারে একটা কার্টুন।
অনেকে বলে আমি মানুষ আঁকতে পারি না। যে মানুষ একবারেই আঁকতেই পারে না তার বিষয়টা ভিন্ন। সে অন্য কিছু আঁকতে পারে। দুইটা ভাইরাস কথা বলতে পারে, ঘরের চেয়ার টেবিলের সঙ্গে কথা বলছে, বাসার ফ্রিজ-টিভির সঙ্গে কথা বলছে। যে কোনো কিছুই কথা বলতে পারে; শুধু তাকে জীবন্ত করতে হলে তার কোনো জায়গায় দুটো চোখ বসিয়ে দিলেই হলো।
অনেক কার্টুনিস্ট আছেন তারা মানচিত্র দিয়ে কার্টুন আঁকেন। খুব ভালো করে খেয়াল করলে দেখা যাবে পৃথিবীর মানচিত্রে প্রতিটা দেশ একটা একটা চরিত্র যেন। শুধু চোখ বসানো বাকি। এটাইকে বোধহয় সিমুলাক্রা বলে! আজ এই পর্যন্ত।
লেখক: উন্মাদ সম্পাদক ও কার্টুনিস্ট