‘আমি প্রতি মুহূর্তে আপনাকে ধাক্কা দিয়ে বোঝাব যে…আমি আপনাকে সস্তা আনন্দ দিতে আসিনি। প্রতি মুহূর্তে আপনাকে হ্যামার (হাতুড়ি) করে বোঝাব যে, যা দেখছেন তা একটা কল্পিত ঘটনা। কিন্তু এর মধ্যে দিয়ে যেটা বোঝাতে চাইছি আমার সেই থিসিসটা বুঝুন, সেটা সম্পূর্ণ সত্যি। সেটার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যই আমি আপনাকে এলিয়েনেট (আলাদা) করব প্রতি মুহূর্তে।
‘যদি আপনি সচেতন হয়ে ওঠেন, ছবি দেখে বেরিয়ে এসে বাইরের সেই সামাজিক বাধা বা দুর্নীতি বদলের কাজে লিপ্ত হয়ে ওঠেন, আমার প্রটেস্টকে (প্রতিবাদ) যদি আপনার মধ্যে চাড়িয়ে (চাপানো) দিতে পারি, তবেই শিল্পী হিসেবে আমার সার্থকতা।’
চলচ্চিত্র নিয়ে এভাবেই নিজের কথাগুলো বলেছিলেন কিংবদন্তি নির্মাতা ঋত্বিক ঘটক।
চলচ্চিত্রগুলোতে তিনি পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় মানুষের শ্রেণিগত লড়াইয়ের গল্পগুলো ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন।
চলচ্চিত্রকে তিনি এক ধরনের সংগ্রামের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছেন। শুরুর দিকে কবিতা, গল্প, নাটক লিখলেও মানুষের কাছে পৌঁছানোর সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে চলচ্চিত্রকেই বেছে নিয়েছিলেন তিনি।
১৯২৫ সালের এই দিনে (৪ নভেম্বর) ঢাকার জিন্দাবাজারে হৃষিকেশ দাশ লেনের বাসায় জন্মগ্রহণ করেন ঋত্বিক ঘটক।
বাংলাদেশে জন্ম ও বেড়ে ওঠা হলেও দেশভাগের সময় কলকাতায় চলে যায় ঋত্বিকের পরিবার। জন্মভূমি ত্যাগ করে শরণার্থী হওয়ার যাতনা তিনি কোনোদিন ভুলতে পারেননি। আমৃত্যু এই যাতনা বয়ে বেরিয়েছেন। সেই ছাপ পড়েছে তার সৃষ্টিতেও।
মাত্র ৫১ বছরের জীবনে ঋত্বিক ঘটক পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন আটটি।
ঋত্বিক ঘটক নির্মিত প্রথম সিনেমা ‘নাগরিক’। এর পাঁচ বছর পর ১৯৫৭ সালে তিনি নির্মাণ করেন দ্বিতীয় সিনেমা ‘অযান্ত্রিক’। এটি মুক্তি পাওয়ার পর থেকেই সফল চলচ্চিত্রকার হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন তিনি।
এরপর ১৯৬০ সালে ঋত্বিক নির্মাণ করেন তার বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘মেঘে ঢাকা তারা’।
বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ প্রযোজনায় ১৯৭২ সালে নির্মাণ করেন ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। অদ্বৈত মল্লবর্মণের উপন্যাস থেকে নেয়া এ সিনেমাটি সে সময় ব্যাপক প্রশংসিত হয়। ১৯৭৪ সালে মুক্তি পায় শেষ সিনেমা ‘যুক্তি তক্ক আর গপ্পো’।
ঋত্বিক ঘটক তার অল্প কয়েকটি নির্মাণের মাধ্যমেই স্থান করে নিয়েছিলেন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্মাতাদের কাতারে।
এই সিনেমাগুলোর বাইরেও ১০টির মতো স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র, তথ্যচিত্র ও প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছিলেন তিনি। এ ছাড়াও অনেকগুলো কাহিনিচিত্র, তথ্যচিত্রের কাজে হাত দিয়েও শেষ করতে পারেননি।
মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। প্রায় তিন বছর মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন।
মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায় ১৯৭৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি মাত্র ৫১ বছর বয়সে মারা যান বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি এ নির্মাতা।
এর আগের দশকে ১৯৬৯ সালে ভারত সরকার তাকে শিল্পকলায় ‘পদ্মশ্রী’ পদক দেয়। ১৯৭৫ সালে ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’ চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ কাহিনিকার হিসেবে ভারতের ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার’ পান তিনি।