বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

জীবনানন্দকে নিয়ে কায়সুল হকের সঙ্গে একসন্ধ্যায় ও ৫টি চিঠি

  • মাসউদ আহমাদ, ঢাকা   
  • ২২ অক্টোবর, ২০২০ ১৮:৪৮

'খুব গম্ভীর আর গম্ভীর- তিনি তার স্বভাব অনুযায়ী সাধারণ মানুষ; যারা আমাদের পরিচিত তারা যেমন আচরণ করেন, তার চেয়ে ভিন্ন আচরণ তার ছিল না। স্বাভাবিক। তা না হলে পরে তিনি নিজের বই টই নিজেই বের করে যেতে পারতেন না। আসলে এখন আমরা আত্মগোপন করি, নানান ছুতো ধরে। তিনি কিন্তু আত্মগোপনকারী ছিলেন না।'

এক ছুটির দিনের বিকেলে কবি কায়সুল হকের ঢাকার বাসায় উপস্থিত হই, ২০১৫ সালের মে মাসের গোড়ায়। তার দেখা পেয়ে-ওঠা বা আলাপ করা অত সহজ ছিল না।

একে তো ঠিকানা অজানা, কোনোভাবে ল্যান্ডফোন নম্বরটি জোগাড় করে উঠেছি। কিন্তু তার ছেলে রবিউল হকের নিরন্তর নিরুৎসাহী মন্তব্য: ‘দেখা করে কোনো লাভ হবে না, ভাই। আব্বা কানে একদমই শোনে না। আপনি যে উদ্দেশ্য নিয়েই আসেন না কেন, আসাটা বৃথা হবে।’

আমি তবু নাছোড়বান্দার মতো বলি, ‘একবার তবু আসতে চাই।’এরসঙ্গে যোগ করি, ‘আমি আগেও একবার এসেছিলাম আপনাদের বাসায় ২০১১ সালে, পাক্ষিক অন্যদিন পত্রিকার ঈদসংখ্যার জন্য কবিতা নিতে।’

অগত্যা তিনি সম্মতি দেন, ‘আচ্ছা, আসেন।’

কবি ও সাংবাদিক কায়সুল হকের জন্ম ২৯ মার্চ ১৯৩৩-এ, অবিভক্ত বাংলার মালদহ জেলায় মাতুলালয়ে। শৈশব, কৈশোর ও যৌবন কেটেছে রংপুরে। তবে সুদীর্ঘ কর্মজীবন কাটে ঢাকায়।

তিনি জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের উপ-পরিচালক পদে কর্মরত ছিলেন। তার কাব্যগ্রন্থের মধ্যে ‘কলম দিয়ে কবিতা’ ও ‘শব্দের সাঁকো’ উল্লেখযোগ্য। প্রবন্ধগ্রন্থ: ‘আলোর দিকে যাত্রা’ ও ‘অনিন্দ্য চৈতন্য’। সম্পাদিত সাহিত্য পত্রিকা ‘অধুনা’, ‘সবার পত্রিকা’, ‘কালান্তর’ ও ‘শৈলী’। বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারসহ নানা পুরস্কার লাভ করেছেন।

কবি শামসুর রাহমান ছিলেন কায়সুল হকের প্রিয়তম বন্ধু। ১৯৫৩ সালে তারা একসঙ্গে শান্তিনিকেতন সাহিত্যমেলায় যোগ দিতে গিয়েছিলেন; ফেরার পথে দুজনেই কবি জীবনানন্দ দাশের বাসায় যান।

রাহমানের স্মৃতিকথা কালের ধুলোয় লেখাতে এর বিস্তারিত বিবরণ লিপিবদ্ধ আছে। বন্ধু শামসুর রাহমান যেদিন মারা যান, মৃত্যু-সংবাদটি কায়সুল হক টেলিফোনে শোনেন এবং প্রচণ্ড ধাক্কা খান; এবং সেদিনই তিনি শ্রবণশক্তি চিরতরে হারিয়ে ফেলেন। ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬-তে ৮৩ বছর বয়সে তিনি অনন্তের পথে পাড়ি দেন।

শুক্রবারের বিকেলে ঠিকানা খুঁজতে বেরিয়ে প্রথমে বাস থেকে নামি উত্তর ঢাকার মিরপুর ১০-এ। মিরপুর গোলচক্কর থেকে রিকশায় পুলিশ স্টাফ কোয়ার্টার কলেজ। এরপর রাস্তা পেরিয়ে উত্তর ইব্রাহিমপুর।

আমার পৌঁছানোর কথা সন্ধ্যা ছটায়। কিন্তু সময়ের বেশ আগেই আমি এসে পড়ি। কী আর করা। অচেনা পথের ধারে ছোট দোকানে বসে চা খাই। আকাশ দেখি। ঘনবসতি এলাকা। নানা পেশার নারী-পুরুষ, দোকানপাট, গ্রাম্য পরিবেশ। লুঙ্গি পরে মানুষ হাঁটছে, আড্ডা দিচ্ছে, কেউ সাইকেলের পেছনে বউ বা আত্মীয়াকে নিয়ে দূরে কোথাও যাচ্ছে; হয়ত বাসায় ফিরছে।

কিছুক্ষণ পর পর মুঠোফোনে সময় দেখি। সময় আর কাটে না। ঠিক ছটায় রবিউল সাহেবকে ফোন করি। ফোনের ওপাশে কল রিসিভ করলে বলতে যাব, আমি এসেছি; ওমা, ফোন বন্ধ। আবার ফোন করি। আরও একবার।

না, ফোন বন্ধ।

আমাকে আসতে বলে লোকটা কি সটকে পড়ল?

সাড়ে ছটায় সিটিসেল নম্বর থেকে একটা ফোন এল- আপনি কোথায়? মোড়ের ওপর চলে আসেন।

মোড়ের কাছে এসেই আমি তাকে খুঁজে পেলাম। রবিউল বললেন, ‘পেছনে ওঠেন।’

আমি উঠতেই, স্টার্ট দেওয়াই ছিল, তিনি মোটরসাইকেলে টান দিলেন।

বাসায় গিয়ে কবিকে দেখেই চিনতে পারলাম। আগের মতোই চেহারা ও স্নিগ্ধ হাসি। কিন্তু শরীর বেশ নুব্জ হয়েছে।

তার ছেলে বললেন, ‘আপনি যা-কিছু জানতে চান, লিখে তার সামনে ধরেন। তিনি বলবেন, আপনি প্রয়োজনে রেকর্ড করে নিতে পারেন।’

খুব কাজে দিলো রবিউলের তাৎক্ষণিক পরামর্শটি।

কায়সুল হকের সঙ্গে আলাপ শুরু করি:

মাসউদ আহমাদ: উপন্যাসের ক্যানভাসে মানুষ ও শিল্পী জীবনানন্দ দাশকে কি ধরা সম্ভব? এমনই একটা স্বপ্ন ও পরিকল্পনা নিয়ে তাকে অনুসন্ধানের চেষ্টা করে চলেছি। এই অভিপ্রায় মাথায় করে ঘুরছি অনেকদিন ধরে, ২০১৩-র শেষ থেকে। এর অংশ হিসেবে জীবনানন্দ-সম্পর্কিত বইপত্র ও তার স্মৃতিচিহ্ন আর তথ্য সংগ্রহ করছি। এই ধরেন, বরিশালে তার বাড়ি ও স্কুল-কলেজ-বগুড়া রোড, লাশকাটা ঘর, তার হেটে যাওয়া পথ, নদী ও জনপদ; পুরান ঢাকার পাটুয়াটুলির ব্রাহ্মসমাজ, ১৯৩০ সালে যেখানে তার বিয়ে হয়েছিল; বুদ্ধদেব বসুর ঠিকানা: ৪৭ পুরানা পল্টন; যেখানে জীবনানন্দ কবিতা পাঠাতেন- সেসব ঘুরে দেখা; খুব সম্প্রতি কলকাতায়ও যাচ্ছি, ভাবছি... এসব চলছে। আপনার সঙ্গে তো তার চিঠিপত্রের যোগাযোগ ছিল, এমনকি সরাসরি দেখা-সাক্ষাৎও হয়েছে। এ সম্পর্কে কিছু বলুন।

কায়সুল হক: প্রথমে যখন জীবনানন্দ দাশের বাসায় যাই, আমার সঙ্গে ছিলেন কবি শামসুর রাহমান এবং নরেশ গুহ। আরেকজন কে ছিলেন এই মুহূর্তে আমার ঠিক মনে নেই। জীবনানন্দকে তো কাছে পাওয়া মুশকিল। কারণ তিনি বেশিক্ষণ কোনো কথা বলতেন না। সামান্য কথা বলেই শেষ করে দিতেন। এবং পরবর্তী সময়ে তার কাছে গিয়ে দেখেছি যে, তিনি ঠিক মনে রেখেছেন। তার স্মৃতিশক্তি প্রখর ছিল। আমার সঙ্গে যে আলাপ হয়েছিল, তিনি ভুলে যাননি। হ্যাঁ, যার জন্য, আচ্ছা আপনি, জীবনানন্দের উপর যে একটা বই আছে, দেখেছেন কি?

মাসউদ: কোন বইটা?

কায়সুল হক:  আমার তো মনে নেই।

[তিনি কানে একদমই শুনতে পান না। কোন বই? কোন বইয়ের কথা বলছেন? না, তিনি বুঝতেই পারলেন না। রবিউল আর একবার আমাদের সামনে এলেন। বললেন, ওভাবে বলে লাভ হবে না ভাই, আপনি লিখে দেন। এরমধ্যে তিন রকম নাশতা ও গরুর দুধের চা চলে এল।]

মাসউদ: আপনি কোন বইটির কথা বলছেন, প্রভাতকুমার দাসের লেখা জীবনীটা?

কায়সুল হক:  আপনি প্রভাতকুমার দাসের লেখার কথা বলছেন? না, ওটা নয়। আমি বলছি, জীবনানন্দ দাশ নিজেই তার যেসব স্মৃতিকথা লিখেছেন, সেসব কি পড়েছেন? সেসব পড়ে থাকলে নতুন করে আর কিছু পড়া লাগবে না।

(তিনি, খুব ধীরে সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। পাশেই রাখা বইয়ের আলমারির উপর থেকে একটা ছবির ফ্রেম নিয়ে এলেন। ছবির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন) এই যে দেখেন, ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আমার ছবি। এই ছবির মানুষকে আর কোথাও খুঁজে পাব না। তাই না? কিন্তু তার স্মৃতিটা মনে থাকবে। এভাবে যদি জীবনানন্দের সমস্ত স্মৃতিকথা সংগ্রহ করেন, তাহলে খুব কাজের হয়। সত্যিকার অর্থে তিনি মাটির মানুষ। মাটি দিয়েই যেন তৈরি জীবনানন্দ দাশ। এমন মানুষ হয় না। অন্যের প্রতি যে তার ঘৃণা বা ক্রোধ, আমি দেখিনি। আর কবি হিসেবেও ছিলেন অসাধারণ। তার কথা ভোলা অত সহজ নয়। তার সঙ্গে আমার দু-তিনবারের মতো দেখা হয়েছে। তাকে একবার বাংলাদেশে আনতে চেয়েছিলাম, তার সঙ্গে আলাপ করে। সেটা অবশ্য আলাদা জিনিস। পরে আর সেটা হয়ে ওঠেনি।

মাসউদ: জীবনানন্দ দাশ দেখতে কেমন ছিলেন?

কায়সুল হক: তিনি দেখতে অতীব সাধারণ। কারণ সাধারণত্বটাই অসাধারণত্ব। অত বড় লেখক বা কবি হয়েও তার কোনো অহঙ্কার ছিল না। আমার কাছে একটা ছবি আছে। জীবনানন্দের আঁকা ছবি। দেখবেন, সেখানে তাঁর চেহারাটা হুবহু ফুটে উঠেছে- তার নিজস্ব রূপে।

(কিছুক্ষণ পর, তিনি, পরিবারের একজনের সহযোগিতায় জীবনানন্দের একটা ছবি দেখালেন। আঁকা ছবি। জীবনানন্দ দাশ একটা হাতলওয়ালা চেয়ারে আলিশান বসে আছেন, নিজস্ব ভঙিতে)। এ রকম ছবি পেয়েছেন, কোনো বইতে? এটাই আসল জীবনানন্দ দাশ। ...আচ্ছা, আপনার কাছে কি প্রভাতকুমার দাসের ওই বইটা আছে?

মাসউদ: জ্বি, তা আছে।

কায়সুল হক: আমাকে একটু দিয়ে যাবেন তো, আমি একঝলক দেখব, কী রকম। আমি ওই বই দেখিনি।

মাসউদ: জীবনানন্দ দাশ মানুষের সঙ্গে তেমন মিশতেন না। কথা বলতেন না। কম কথা বলতেন। পরিচিত মানুষকেও কি এড়িয়ে যেতেন?

কায়সুল হক: না, তিনি বরাবরই একটু লোকজনের ভিড় এড়িয়ে চলতেন। এমনিতেই। কোনো বিশেষ কারণে মানুষকে খারাপ মনে করা, তা নয়। তার স্বভাবই ছিল একা একা সময় কাটানো বা চিন্তাভাবনা করা। এটা আর্টিফিসিয়াল কিছু নয়। স্বভাবজাত ব্যাপার। যেমন মনে করেন, আমার সঙ্গে তার ঘনিষ্টতা কীভাবে হলো? আমার সঙ্গে তো ঘনিষ্টতা হওয়ার কথা না। আমি কোথায় রংপুরের লোক, আর উনি বরিশালের মানুষ। সুতরাং মানুষকে এড়িয়ে চলা- এটা তার তৈরি করা বিশেষ কোনো ব্যাপার নয়। স্বভাবজাত। তা না হলে আমার সঙ্গে তার আলাপ বা চিঠিপত্র বিনিময় হলো কেমন করে? তিনি মানুষের সঙ্গে মিশতেন। কথা বলতেন। মানুষ অনেক কিছু আরোপ করে। এর কোনো মানে নাই। জীবনানন্দ দাশ নামটা লিখতে বলেন- অনেকেই ভুল লিখবে। বুঝলেন তো! বাকিটা বুঝে নেন।

মাসউদ: শেষ বয়সে তার মাথায় নাকি টাক পড়ে গিয়েছিল? আপনি কি তা পর্যবেক্ষণ করতে পেরেছিলেন?

কায়সুল হক: তার মাথায় চুল সবসময়ই কম ছিল। আপনি বলছেন, শেষ বয়সে তার মাথায় টাক পড়ে গিয়েছিল কিনা? এই কথাটা, সব মানুষেরই শেষ বয়সে তাই হয়। তার, এমনিতেই চুল কম ছিল মাথায়। খুব ঘন চুলের ছবি পাবেন না। তার যে ছবি বাজারে চালু আছে বা পাওয়া যায়, সেটা তৈরি করা।

মাসউদ: আপনার সম্পাদিত ‘অধুনা’ পত্রিকায় কবিতা চেয়ে তাকে চিঠি লিখেছিলেন। এভাবেই কি প্রথম যোগাযোগ হয়েছিল?

কায়সুল হক: হ্যাঁ। জীবনানন্দ, তার বয়স যখন শেষের দিকে, তখনও কিন্তু মিশেছেন মানুষের সঙ্গে। আমার সঙ্গে তার যে পত্রালাপ এবং যোগাযোগ, তিনি যে নতুন কিছু বলেছেন, তা না। তিনি তার আমলের পরিবেশের কথা কখনো বলেছেন, কখনো- যেমন তার যে ট্রাম এক্সিডেন্ট হলো, এটা যারা একটু অন্যমনষ্ক পথেঘাটে, তাদের সঙ্গে এক্সিডেন্ট হতেই পারে। তবে তিনি রাস্তা সচেতন ছিলেন না আর কি। তা না হলে সাধারণত ট্রাম এক্সিডেন্ট হয় না। কারণ ট্রাম এত দ্রুত চলে না যে এক্সিডেন্ট হবে। যা ঘটবার ঘটে গেছে। এবং জীবনানন্দ দাশের খোঁজখবর বাঙালি লেখকরা রাখত না। আসল ব্যাপার হচ্ছে আমরা নিজের দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দেই। কবি-লেখকেরা সচেতন হলে তার সঙ্গে অনেক আলাপ আলোচনা হতে পারত। মনে করেন, আগ্রহটা বড় কথা। রংপুর একপ্রান্ত, বরিশাল আরেক প্রান্ত। তাই না? আমরা, কবি-সাহিত্যিকদের সত্যি কথা বলতে কী বেশি ভালোবাসি না।

মাসউদ: জীবনানন্দ যখন মারা গেলেন, তখন, তিনি যে অজস্র গল্প ও উপন্যাস লিখতেন, শুনেছিলেন কি? জীবনানন্দের প্রকাশিত গল্পের সংখ্যা ১২০টির বেশি এবং উপন্যাস কমপক্ষে ১৮টি। এছাড়াও আছে প্রবন্ধ, লিটারারি নোটস...

কায়সুল হক: জীবনানন্দ এত গল্প এবং উপন্যাস লিখেছেন? আপনার এই তথ্য সঠিক? তার কি গল্পের সংকলন বই আকারে বেরিয়েছে? উপন্যাসও? প্রথমদিকে এসব তো জানা যায়নি। তার গদ্য মৃত্যুর আগেই পড়েছি। গল্প পড়েছি কিনা, ঠিক মনে নেই। পরবর্তী সময়ে কিছু কিছু পড়েছি। খুব ভালো। কবিতার মতো গল্প পাঠেও নিজের ভেতরে একটা আলাদা চেতনা তৈরি হয়। মানুষ তো তাকে আত্মভোলা বলে। আমার তা মনে হয় না। আত্মভোলা হলে ওইরকম গল্প তিনি লিখতে পারতেন না।

মাসউদ: তিনি কি সত্যিই খুব গম্ভীর মানুষ ছিলেন? মজার কোনো কথা বলার সময়েও হাসতেন না?

কায়সুল হক:  খুব গম্ভীর আর গম্ভীর- তিনি তার স্বভাব অনুযায়ী সাধারণ মানুষ; যারা আমাদের পরিচিত তারা যেমন আচরণ করেন, তার চেয়ে ভিন্ন আচরণ তার ছিল না। স্বাভাবিক। তা না হলে পরে তিনি নিজের বই টই নিজেই বের করে যেতে পারতেন না। আসলে এখন আমরা আত্মগোপন করি, নানান ছুতো ধরে। তিনি কিন্তু আত্মগোপনকারী ছিলেন না। স্বাভাবিকভাবেই মেলামেশা করতেন। ভিন্ন আচরণ করতে দেখিনি। আর আমরা বাঙালি মুসলমানরা কোনোকালেই সাহিত্যপ্রেমী ছিলাম না। তা না হলে নজরুলের এই দশা হতো না। জীবনানন্দ দাশ না হয় আলাদা প্রকৃতির মানুষ ছিলেন, কিন্তু কাজী নজরুল ইসলাম তো তা ছিলেন না- হৈ হৈ করে চলে আসতেন, রৈ রৈ করে চলে যেতেন। তাকেই বা আমরা নিকটতর করিনি কেন? তাই না? আমরা সূক্ষ্মভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখি না।

মাসউদ: প্রথম যখন জীবনানন্দ দাশের চিঠি পেয়েছিলেন, কী অনুভূতি হয়েছিল?

কায়সুল হক: ব্যাপার হচ্ছে, আমাদের মানসিক গঠন ছিল অন্য রকমের। যেমন আমরা কবিদের ভালোবাসতাম। তাদের লেখার প্রতি মমত্ব বোধ করতাম। সত্যিকার ভালো লেখক তারা এবং বাংলা ভাষার সমৃদ্ধি এরা ঘটিয়েছেন। সুতরাং কোনো রকমের অত্যুক্তি ঘটেনি। আর আপনি যেটা জিজ্ঞেস করলেন, অনুভূতি, সেটা খুব আনন্দময় ব্যাপার ছিল। তখনকার বিবেচনায় সেটি ছিল শ্রেষ্ঠ অনুভূতি। কারণ আমাদের কাছে, যারা জীবনানন্দপ্রেমিক তাদের কাছে তো মনে হতো জীবনানন্দ সবচেয়ে বড় এবং শ্রেষ্ঠ। কবি হিসেবে তো বটেই, গদ্যকার হিসেবেও তাকে আমাদের কাছে অনেক বড় মনে হতো। আমি কোথাও লিখেও বলেছি এই কথাগুলো যে, তার মতো লেখক আর দ্বিতীয়টি নেই। তখনকার দিনে আমরা জীবনানন্দকে নিয়ে যে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছি, হৈ চৈ করেছি, সেই সময়ের প্রেক্ষিতে এবং রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিয়ে, তা বিচার্য। নতুন পাঠকদের কাছে জীবনানন্দকে নানাভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। জীবনানন্দ কবিতায় নতুন ধারার সৃষ্টি করেছেন, নতুন পাঠকের সামনে এসব তুলে ধরেছি। সেখানে কোনো মেকি ব্যাপার ছিল না। আমাদের মধ্যে ঈর্ষাও ছিল না। যদিও লেখকদের মধ্যে ঈর্ষাপরায়ণতা বেশি।

মাসউদ: আপনি তো কলকাতায় তার ল্যান্সডাউন রোডের বাসায় দেখা করেছিলেন? তার ঘরখানা দেখতে কেমন ছিল?

কায়সুল হক: হ্যাঁ, কলকাতাতে দেখা হয়েছে। খুব ভালো মানুষ ছিলেন। এমন মানুষ সচরাচর পাওয়া যায় না। ওই ঘর যেমন হয় আর কি, সাধারণত বৈঠকখানা বাইরের ঘর হিসেবে মানুষ ব্যবহার করে। হ্যাঁ। আমার অত কৌতূহলও ছিল না যে, তার ঘরটা তন্ন তন্ন করে দেখি। হা হা হা। এত বড় একজন কবি ভারতীয় ভাষায় হয়েছে বলে আমার মনে হয় না। এবং এটা আমার অকপট স্বীকার। তার লেখা যে পড়তাম, আমার ভাইবোনদের পাঠ করে শোনাতাম। কবিতা তো বটেই, তাঁর মতো গদ্যও তখন খুব কম মানুষই লিখেছেন। জানি না, আপনারা কী মনে করেন।

মাসউদ: আপনাকে তিনি চা-নাস্তা খেতে দিয়েছিলেন?

কায়সুল হক: এটা ঠিক আমার মনে নেই। অনেকদিন আগের কথা। সাদামাটা ব্যাপার তো। মনেও নেই। আমরা চাইতামও না। অমন আদিখ্যেতা ছিলও না আমাদের। আর অত টাকা পয়সাও তার ছিল না যে আমাদেরকে বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াবেন। হা হা। তবে খুব ভালো মানুষ ছিলেন। তার সঙ্গে যে পত্রালাপ, আমার দিক থেকেই উদ্যোগ গ্রহণ করা, তিনি যে জবাব দিয়েছেন, এটাই বড় কথা। কিন্তু তিনি উত্তর না দিলেও পারতেন। তাতে কিছু এসে যেত না। আবার বুদ্ধদেব বসুও ভালো মানুষ ছিলেন। প্রথম আলাপে বসু আমাদের সঙ্গে চার পাঁচ ঘণ্টা কাটিয়ে দিয়েছিলেন। সেটি খুব বিরল। কিন্তু জীবনানন্দ নিরিবিলি, নিরীহ- সবকিছু নিয়ে একটা আলাদা জগতে থাকতে পছন্দ করতেন।

মাসউদ: তিনি নিজের লেখা নিয়ে কোনো মন্তব্য করতেন কি?

কায়সুল হক: নিজের লেখা নিয়ে তিনি কোনো রকমের কথাবার্তা বলতেন না। এই যেমন ধরেন, জীবনানন্দ দাশ এবং বুদ্ধদেব বসু, লেখালেখির ক্ষেত্রে তারা আমাদের কাছে দেবতাতুল্য। তাদের মতো মানুষ জন্মেছিলেন বাংলায়, এ জন্য নিজেকে ধন্য মনে হয়। আর জীবনানন্দ? তিনি তো লিখতেনই সবসময়। এমন না যে হঠাৎ তাকে কেউ লিখতে বলেছে বলে লিখলেন। তার স্বভাবই ছিল ওই লেখা।

মাসউদ: আপনার অনেক সময় নষ্ট করলাম ভালো থাকবেন। আজ যাই।

কায়সুল হক: না। সেটা ঠিক আছে। আপনি কী করেন, অধ্যাপনা? না। ও আচ্ছা। হাতিরপুলে থাকেন? আমি চিনি ওই এলাকাটা। ভালো লাগলো, আপনি এসেছেন আমার কাছে। আপনার হাতের লেখা বেশ ভালো। সুন্দর। আবার আসবেন। আমার জন্য দোয়া করবেন।

                          •••

কায়সুল হককে লেখা জীবনানন্দ দাশের পাঁচটি চিঠি

১৮৩ ল্যান্সডাউন রোড

কলকাতা-২৬

১.৬.১৯৫২

প্রীতিভাজনেষু,

আপনার ২৮ তারিখের চিঠি কাল পেয়েছি। আপনারা একটা সাহিত্য সংকলন বের করবেন জেনে আনন্দিত হলাম। আপনাদের আদর্শের কল্যাণ ও উন্নতি কামনা করি।

সম্প্রতি কোনো নতুন কবিতা তো আমার হাতে নেই, সেজন্যে আমি দুঃখিত। লিখে উঠতে পারলে আপনাকে পাঠিয়ে দেব। সাতদিনের মধ্যে সম্ভব হবে না, সময় লাগবে। আশা করি কিছু মনে করবেন না। কুশল প্রার্থনীয়। প্রীতি নমস্কার। ইতি

জীবনানন্দ দাশ

১৮৩ ল্যান্সডাউন রোড

কলকাতা-২৬

২৬.৬.১৯৫২

প্রীতিভাজনেষু,

আপনার দুটো চিঠিই যথাসময়ে পেয়েছি। আমার জ্বর হয়েছিল, অনেক দিন ভুগলাম। উত্তর দিতে তাই দেরী হ’য়ে গেল। ক্ষমা করুন।

নরেন মিত্রের ঠিকানা আমার জানা নেই। যদি জানতে পারি, তাহ’লে আপনাকে জানাব। নানা কারণে মন এত চিন্তিত আছে, শরীরও এত অসুস্থ যে অনেকদিন থেকেই কিছু লিখতে পারছি না।

আপনাদের পত্রিকার জন্য এই সঙ্গে একটি কবিতা পাঠালাম। কোনো রকমে লিখে দিলাম; মোটেই ভালো হ’ল না। ত্রুটি মার্জনা করবেন- এই অনুরোধ। আশা করি ভালো আছেন। প্রীতি নমস্কার। ইতি

জীবনানন্দ দাশ

১৮৩ ল্যান্সডাউন রোড

কলকাতা-২৬

২৫.৮.১৯৫২

প্রীতিভাজনেষু,

আপনার চিঠি পেয়েছি। আপনার জ্বর হয়েছিল খবর পেলাম। আশা করি এখন ভালো আছেন।

জনাব আবু সয়ীদ আইয়ুবের ঠিবানা আমি জানি না; সমর সেন Stateman-এ কাজ করে শুনেছিলাম। অন্নদাশংকর বা বুদ্ধদেব বসু এঁদের ঠিকানা জানেন বলে মনে হয়। কারো সঙ্গেই আমার দীর্ঘকালের মধ্যে দেখা হয়নি।

আপনাদের সংকলন শীগগিরই বেরুবে হয়তো?

আপনার কুশল প্রার্থনা করি। আমার প্রীতি নমস্কার জানাচ্ছি।

জীবনানন্দ দাশ

১৮৩ ল্যান্সডাউন রোড

কলকাতা-২৬

২২.১.১৯৫৩

প্রীতিভাজনেষু,

আপনার সব চিঠি যথাসময়ে পেয়েছি, ধন্যবাদ। শরীর অসুস্থ; নানা কারণে অত্যন্ত বিব্রত আছি; কাজেই চিঠির উত্তর দিতে বড় দেরি হয়ে গেল, কবিতাও এখন আর পাঠাতে পারলাম না; খুবই লজ্জিত ও দুঃখিত বোধ করছি। কবিতা এখন আমার হাতে কিছুই প্রায় নেই। নতুন কিছুও লেখা হয়ে উঠছে না। যাহোক- সময় করে কিছু লিখে পাঠাতে চেষ্টা করব। আপনাদের সংকলন কি শীগগির বেরুবে?

ফোটো পাঠাতেও একটু সময় লাগবে- ক্ষমা করুন। আশা করি ভালো আছেন। আপনাদের প্রচেষ্টা জয়যুক্ত হোক। শুভাকাঙ্ক্ষা জানাচ্ছি। 

জীবনানন্দ দাশ

১৮৩ ল্যান্সডাউন রোড

কলকাতা-২৬

২৩.৪.১৯৫৩

প্রীতিভাজনেষু,

তোমার চিঠি পেয়ে খুশি হয়েছি।

তোমাদের সংকলন তো আর বের করলে না। সংকল্প ছেড়ে দিয়েছ নাকি? কবিতা ও ছবি পাঠাতে দেরি হচ্ছে। আমি বড্ড অলস, শরীরও অসুস্থ, মনও নানা কারণে ভেঙে পড়েছে। পূর্ব পাকিস্তান নিজের জন্মস্থান; সেখানে যেতে আমি অনেকদিন থেকেই ব্যাকুল; কিন্তু পাসপোর্ট ইত্যাদি কবে জোগাড় করে উঠতে পারব বলতে পারছি না।

আশা করি ভালো আছ। প্রীতি নমস্কার।

জীবনানন্দ দাশ

মাসউদ আহমাদ, সাংবাদিক ও গল্পকার

 

এ বিভাগের আরো খবর