‘আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির তীরে— এই বাংলায়,হয়তো মানুষ নয়— হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে।’
এই রূপসী বাংলার নদী-মাঠ-ক্ষেত ভালোবেসে বারবার বহুরূপে ফেরার বাসনায় যিনি ব্যাকুল ছিলেন, আজ তার চলে যাওয়ার ৬৬তম বার্ষিকী।
আজ বাংলা ভাষার শুদ্ধতম কবি হিসেবে পরিচিত জীবনানন্দ দাশের প্রয়াণ দিবস।
১৮৯৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি বরিশাল শহরে জন্মগ্রহণ করেন জীবনানন্দ। বাবা সত্যানন্দ দাশ ছিলেন মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক। মা কুসুমকুমারী দাশ ছিলেন গৃহিনী। কিন্তু সংসারের কাজের ফাঁকে লিখতেন কবিতা।
কুসুমকুমারী দাশের সবচেয়ে সুপরিচিত ‘আদর্শ ছেলে’ (আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে/কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে)। কবিতাটি আজও শিশুশ্রেণির পাঠ্য।
মায়ের কাছ থেকেই সাহিত্যচর্চা ও কবিতা লেখার প্রেরণা পান জীবনানন্দ। বাবা কম বয়সে স্কুলে ভর্তির বিরোধী ছিলেন। এ কারণে বাড়িতে মায়ের কাছেই জীবনানন্দের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু।
১৯০৮ সালের জানুয়ারিতে আট বছরের জীবনানন্দকে ব্রজমোহন বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি করানো হয়। সেখান থেকে ১৯১৫ সালে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ১৯১৭ সালে ইন্টারমিডিয়েট প্রথম বিভাগে পাস করেন।
১৯১৯ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজিতে অনার্সসহ বিএ ডিগ্রি এবং ১৯২১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে দ্বিতীয় শ্রেণিতে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর আইন বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করলেও তা আর শেষ করেননি তিনি।
পেশাগত জীবনে শিক্ষকতা করলেও স্থায়ী হননি কোথাও। অধ্যাপনা করেছেন বাংলাদেশ ও ভারতের অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। শিক্ষকতার বাইরে জীবনের প্রয়োজনে তিনি ইনস্যুরেন্স কোম্পানির এজেন্ট হিসেবেও কাজ করেছেন।
অভাব অনটন ছিল তার নিত্যসঙ্গী। জীবনের অধিকাংশ সময় গৃহশিক্ষকতা করে চালিয়েছেন সংসার।
১৯২৫ সালের জুনে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ মৃত্যুবরণ করলে জীবনানন্দ তার স্মরণে ‘দেশবন্ধুর প্রয়াণে’ নামক একটি কবিতা লিখেন। এটি ‘বঙ্গবাণী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
পরবর্তী সময়ে ১৯২৭ সালে কবিতাটি তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ঝরা পালকে স্থান করে নেয়। ওই বছরেই সেই সময়ের নামী ‘কল্লোল’ পত্রিকায় প্রকাশ হয় ‘নীলিমা’ কবিতাটি। পরে কালি ও কলম, প্রগতিসহ কলকাতা, ঢাকা ও অন্যান্য জায়গার বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকায় তার লেখা ছাপা হতে থাকে।
১৯৩৬ সালে প্রকাশিত হয় ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’। ১৯৪২ সালে ‘বনলতা সেন’, ১৯৪৪ সালে ‘মহাপৃথিবী’, ১৯৪৮ সালে ‘সাতটি তারার তিমির’ এবং ১৯৫৪ সালে মৃত্যুর কিছুদিন আগে প্রকাশিত হয় ‘জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা’।
তার মৃত্যুর পর ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত হয় ‘রূপসী বাংলা’। ১৯৬১ সালে প্রকাশ হয় ‘বেলা অবেলা কালবেলা’।
জীবনানন্দ দাশ ‘রূপসী বাংলা’র পাণ্ডুলিপি তৈরি করলেও জীবদ্দশায় সেটি প্রকাশের উদ্যোগ নেননি।
১৯৫৪ সালের ১৪ অক্টোবর কলকাতার বালিগঞ্জে এক ট্রাম দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত হন কবি। এ অবস্থায় তাকে ভর্তি করা হয় শম্ভূনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে। তবে চিকিৎসার তেমন উন্নতি হয়নি।
অবস্থা ক্রমশ জটিল হতে থাকে। অবশেষে চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে ২২ অক্টোবর রাত ১১টা ৩৫ মিনিটে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।