কুয়াকাটা সৈকতে একের পর এক ভেসে আসছে মৃত ডলফিন। গত দুই দিনে তিনটিসহ চলতি মাসেই মাটি চাপা দেয়া হয়েছে আটটি ডলফিন। এ নিয়ে চলতি বছর সৈকতে ভেসে এসেছে মোট ১১টি মৃত ডলফিন। বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন পরিবেশবিদরা।
বিশেষজ্ঞরা জানান, গভীর সাগরে জালে আটকে পড়ে মারা যেতে পারে এসব প্রাণী। জীববৈচিত্র্য রক্ষায় জেলেদের সচেতনতার পাশাপাশি সাগর দূষণমুক্ত রাখারও পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
স্থানীয় পর্যটন ব্যবসায়ী ও ডলফিন রক্ষা কমিটির সদস্য কে এম বাচ্চু মিয়া বলেন, ‘শনিবার দুপুরের দিকে কুয়াকাটা জিরো পয়েন্টের পশ্চিমে হোটেল সাগরকন্যার সামনে একটি মরা ডলফিন ভাসতে দেখি। মনে হয় জোয়ারের পানির সঙ্গে ডলফিনটি ভেসে আসছে।
‘প্রায় ছয়-সাত ফুট ডলফিনটির মুখ ছিল রক্তাক্ত। মাছটির মুখসহ বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। এ ছাড়া মুখমণ্ডল জালে প্যাঁচানো ছিল। ধারণা করা হচ্ছে, জেলেদের জালে প্যাঁচিয়ে মারা গেছে ডলফিনটি।’
সৈকতে প্রায়ই ভেসে আসছে মৃত ডলফিনতিনি জানান, এর আগের দিন শুক্রবারও সৈকত থেকে আরও দুটি মৃত ডলফিন ভেসে এসেছিল। স্থানীয়দের সহায়তায় সেগুলোকে মাটি চাপা দেয়া হয়েছে।
স্থানীয় জেলে আনেস মিয়া বলেন, ‘গভীর সাগরে মাছ শিকারের সময় জালে এসব ডলফিন জড়িয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে জালের প্যাঁচ না ছুটাতে পারলে সেখানেই মারা যায় তারা। আবার কখনও কখনও গভীর সাগরেও মৃত ডলফিন ভাসতে দেখা যায়।’
এদিকে স্থানীয় জেলেদের এই ধারণাই উঠে এসেছে জেলা প্রশাসনের গঠিত তদন্ত দলের প্রতিবেদনে। গত বছরে পাঁচটি মৃত ডলফিন সৈকতে ভেসে আসার পর ওই তদন্তদল গঠন করা হয়েছিল।
তদন্ত প্রতিবেদনে অন্যান্য কারণের মধ্যে প্রধান দুটি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রথমটি হলো গভীর সাগরে মাছ শিকারের জন্য পেতে রাখা জালে আটকা পড়ে মারা যায় এসব ডলফিন। আরেকটি কারণ বড় বড় জাহাজের পাখনায় ধাক্কা খেয়েও মারা যেতে পারে তারা।
পটুয়াখালীর তখনকার জেলা প্রশাসক মো. মতিউল ইসলাম চৌধুরীর নির্দেশে ওই তদন্ত কমিটিতে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, জেলা মৎস্য কর্মকর্তা, মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তা, বিভাগীয় বন কর্মকর্তা, জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার নাম রয়েছে। তদন্ত কমিটির সুপারিশে এসব মৃত ডলফিনের ময়নাতদন্তের কথা উল্লেখ থাকলেও এখন পর্যন্ত সেটি করা হয়নি।
এ বিষয়ে পটুয়াখালীর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোল্লা এমদাদুল্লাহ বলেন, ‘এসব ময়নাতদন্ত বন বিভাগ ও মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট মিলে করার কথা।’
পরে এ বিষয়ে বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ও মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তারা ফোন ধরেনি।
মৎস্য অধিদপ্তর বরিশালের সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রকল্পের উপপরিচালক মো. কামরুল ইসলাম বলেন, ‘ভেসে আসা এসব ডলফিন বঙ্গোপসাগরের অগভীর অঞ্চলে বাস করে। ২০-২৫ মিনিট পরপর এরা অক্সিজেন নেয়ার জন্য পানির ওপরে আসে। তখনও এরা দুর্ঘটনার শিকার হতে পারে।
তিনি জানান, বঙ্গোপসাগরে দুই প্রজাতির ডলফিন পাওয়া যায়। একটি হলো বটল নোজ (বোতলের মতো মুখ) এবং আরেকটি হলো হাম্পব্যাক ডলফিন (পিঠের দিকটা সামান্য ভাঁজ ও কুঁজো)।
কুয়াকাটা সৈকতে ভেসে আসা মৃত ডলফিনগুলো হলো হাম্পব্যাক ডলফিন। ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগরের অগভীর অঞ্চলে এই প্রজাতির ডলফিন বেশি রয়েছে। এর পিঠের অংশ সামান্য উঁচু হওয়ায় একে কুঁজো ডলফিন বলা হয়। এর সামনের চোয়াল বেশ লম্বা এবং ৩০-৩৪টি দাঁতযুক্ত।
ইকোফিশ-২ প্রকল্পের সহকারী গবেষক সাগরিকা স্মৃতি বলেন, ‘ডলফিনসহ এ অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় স্থানীয় জেলেদের ব্যাপকহারে গণসচেতন করতে হবে। পাশাপাশি সাগরকে দূষণমুক্ত রাখতে হবে। সাগরে মাছ শিকারের সময় জেলেরা এসব ডলফিনকে না বুঝে, ভয়ে বা আতঙ্কে আঘাত করতে পারে। সেটি যাতে না হয়, সে জন্য তাদের সচেতন করতে হবে।’