বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

৯০ বছর আগেই কি ফুটল ‘মারণ ফুল’

  •    
  • ৪ আগস্ট, ২০২১ ০০:১৪

তালিপাম গাছের ‘অনন্য বৈশিষ্ট্য’, প্রায় শত বছর পর মাত্র একবারই ফুল-ফল দিয়ে মারা যায় অর্থ্যাৎ জীবনচক্র শেষ হয়। তবে টাঙ্গাইলের সার্কিট হাউজে রোপন করা বিরল প্রজাতির গাছটির ‘মারণ ফুল’ ফুটেছে ৯ বছরেই।

বিশ্বের মহাবিপন্ন বৃক্ষের তালিকাভূক্ত তালিপামে ফুল ও ফল হওয়ার সবশেষ নমুনাটি ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ফুলার রোড সংলগ্ন উপ-উপাচার্যের বাসবভন চত্বরে।

এই গাছের ‘অনন্য বৈশিষ্ট্য’, প্রায় শত বছর পর মাত্র একবারই ফুল-ফল দিয়ে মারা যায় অর্থ্যাৎ জীবনচক্র শেষ হয়। তবে টাঙ্গাইলের সার্কিট হাউজে রোপন করা বিরল প্রজাতির গাছটির ‘মারণ ফুল’ ফুটেছে ৯ বছরেই।

গাছটি ২০১২ সালের ১৮ জুন তৎকালীন জেলা প্রশাসক এম বজলুল করিম চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্যের বাসা থেকে এনে রোপণ করেছিলেন। মাত্র ৯ বছরে ফুল ফোটার খবরে মঙ্গলবার সকালে টাঙ্গাইল সার্কিট হাউজে যান একদল উদ্ভিদ গবেষক।

তালিপাম গাছের গবেষক ও সরকারি বাঙলা কলেজের রসায়ন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান চৌধুরীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ রেফারেন্স ইনস্টিটিউট ফর কেমিক্যাল মেজারমেন্টের মহাপরিচালক অমি ড. মালা খান, হেলথ ইন হাসপাতালের গাইনি চিকিৎসক শারমিন সুলতানা।

এ সময় টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক ড. আতাউল গনিসহ প্রশাসনের অন্যান্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। উদ্ভিদ গবেষকরা গাছটি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি ফুল, পাতা, শেকড়, ডালসহ বিভিন্ন উপকরণ গবেষণার জন্য সংগ্রহ করেন।

ড. আখতারুজ্জামান চৌধুরী জানান, তালিপামের ফুল-ফল থেকে এখন পর্যন্ত তিনি ৯টি সক্রিয় রাসায়নিক উপাদান সংশ্লেষণ করতে সক্ষম হয়েছেন। যার কিছু উপাদান অণুজীব ধ্বংসকারী, বার্ধক্য ও ক্যান্সার প্রতিরোধক গুণাগুণ সম্পন্ন। এর মধ্যে বিটুলিনিক এসিড ক্যান্সার প্রতিরোধে কাজ করে।

জানা যায়, ১৭৯৯ সালে সর্ব ভারতের পূর্বাঞ্চলে তালিপাম প্রজাতির সন্ধান পান যুক্তরাজ্যের উদ্ভিদবিজ্ঞানী উইলিয়াম রক্রবার্গ। স্থানীয়ভাবে যা ‘বুনো তাল’ নামে পরিচিত ছিল।

তিনি জানিয়েছিলেন, বুনো তাল পূর্ববাংলার এনডেমিক উদ্ভিদ অর্থ্যাৎ এটি এমন উদ্ভিদ, যা শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে জন্মায়।

এরপর পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার শান্তি নিকেতন এলাকায় আরেকটি তালিপাম বৃক্ষের তথ্য পাওয়া যায়। তবে বৃক্ষটিতে ফুল আসার পরপরই স্থানীয় অধিবাসীরা তা কেটে ফেলেন।

কথিত আছে, ১৯৭৯ সালে ওই গাছে যখন ফুল আসে। তখন সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মানুষ অশুভ মনে করে সেটি কেটে ফেলেন।

তালিপামের ফুল পরীক্ষা করছেন গবেষকরা। ছবি: নিউজবাংলা

এর আগে অবশ্য ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এম সালার খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি তালিপাম গাছ চিহ্নিত করেন। ১৯৭৯ সালের পর পৃথিবীর অন্য কোথাও এ প্রজাতির সন্ধান না পাওয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদটিকেই বিশ্বের একমাত্র বন্যতাল প্রজাতির নমুনা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

১৯৯৮ সালে আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (আইইউসিএন) তালিপামকে বিশ্বের মহাবিপন্ন উদ্ভিদ হিসেবে ঘোষণা করে।

তালিপাম গাছের গবেষক ড. আখতারুজ্জামান চৌধুরী জানান, তালিপামের ফুল-ফল থেকে সক্রিয় রাসায়নিক উপাদান সংশ্লেষণ নিয়ে গবেষণা করছেন। এটি রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. আশরাফুল আলম সুপারভাইজার এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের অধ্যাপক ড. আব্দুর রশীদ কো-সুপারভাইজার হিসেবে তত্ত্বাবধান করছেন।

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ন্যাশনাল হারবেরিয়াম থেকে ২০০১ সালে জানতে পারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তালিপাম নামে একটি গাছ আছে। বৃক্ষটি ১০০ বছর পর মাত্র একবারই ফুল-ফল দিয়ে মারা যাবে। এরপর ২০০৮ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বরের মধ্যে বৃক্ষটিতে মুঞ্জরী বের হয়।

‘বাংলাদেশসহ বিশ্বের বৃক্ষপ্রেমী মানুষের মধ্যে এটি ভালো আগ্রহের সৃষ্টি করে। পত্র-পত্রিকায় ব্যাপকভাবে লেখালেখি হতে থাকে। এই সময় প্রচলিত চিকিৎসার একটি কথা আমার মনে পড়ে যায়, যে গাছ একবার ফুল-ফল দিয়ে মরে যায়, সে গাছ ঔষধি।

‘তখন মনে হয়, যেহেতু বৃক্ষটি ১০০ বছর পর একবার ফুল-ফল দিয়ে মরে যাবে, নিশ্চয় এর ফুল-ফল থেকে গুরুত্বপূর্ণ ঔষধি উপাদান পাওয়া যাবে। এরপরই তালিপাম নিয়েই পিএইচডি কোর্সের গবেষণা করার সিদ্ধান্ত নিই।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমার সুপারভাইজার অধ্যাপক ড. আশরাফুল আলম ও কো-সুপারভাইজার অধ্যাপক ড. আব্দুর রশীদকে জানালে তারা সানন্দে রাজি হন। কারণ ইতোমধ্যে গাছটি সম্পর্কে তারাও জেনেছেন।

কো-সুপারভাইজার থাকতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টাওয়ার ভবনের একটি ফ্ল্যাটে, গাছটি থেকে মাত্র কয়েক মিটার দূরে। এরপর শুরু হয় তালিপামের ফুল, অপরিপক্ক ও পরিণত ফল নিয়ে পিএইচডি কোর্সের গবেষণার কাজ।’

ড. আখতারুজ্জামান জানান, গবেষণার জন্য প্রতি সপ্তাহে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গাছটি কাছে গিয়ে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতেন। ২০১০ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসের দিকে একদিন ভোরে গাছের নিচে গিয়ে দেখেন চার-পাঁচটার মতো বীজ পড়েছে মাটিতে। সেগুলো অঙ্কুরোদগমের জন্য বাসার বারান্দায় টবে রোপন করেন।

তিনি আরও জানান, এরপর থেকে প্রায় এক হাজারের মতো বীজ সংগ্রহ করে ৫০০ বীজ রেখে দেন গবেষণার জন্য। এ ছাড়া অঙ্কুরোদগমের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের মেডিসিনাল প্ল্যান্ট গার্ডেনে ৩০০ এবং বাকি ২০০ বীজ দেন আজিমপুর কোয়ার্টারের নিচে। টবে দেয়ার দুই-আড়াই মাসের মধ্যে বীজগুলো থেকে অঙ্কুরোদগম হয়।

চারাগুলো আট-দশ ইঞ্চি হয়ে গেলে সিদ্ধান্ত নেন সেগুলো দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেবেন, যাতে বৃক্ষটি যথাযথ সংরক্ষিত হয় এবং শত বছর পর ২১১০ সালের দিকে যখন ফুল-ফল আসবে তখন ভবিষ্যৎ গবেষকরা যেন বৃক্ষটি নিয়ে ব্যাপকভাবে গবেষণা করতে পারেন।

বাংলাদেশ রেফারেন্স ইনস্টিটিউট ফর কেমিক্যাল মেজারমেন্টের মহাপরিচালক আমি ড. মালা খান বলেন, ‘উদ্ভিদ বিজ্ঞান অনুযায়ী, তালিপাম গাছে ১০০ বছর পরে ফুল আসবে, ফল হবে এবং তারপর গাছটি মরে যাবে। এটাই হল তালিপামের চরিত্র সম্পর্কে এ পর্যন্ত মানুষের কাছে জানা তথ্য। অথচ অত্যন্ত আশ্চর্যের সাথে আমরা লক্ষ্য করছি যে ১০ থেকে ১১ বছরের মাঝামাঝি সময়ে এ গাছে ফুল ফুটেছে। আমরা আশা করব, আগামী এক বছরের মধ্যে এটাতে নিয়ম অনুযায়ী ফলও আসবে।

‘এই আশ্চর্যজনক ঘটনার কারণেই বাংলাদেশ বিজ্ঞান গবেষণা প্রতিষ্ঠান এখানে এসেছে। সাধারণ তালিপামের বৈশিষ্ট্য থেকে বের হয়ে এসে ১০০ বছরের আগে এটিতে ইমম্যাচিউর অবস্থায় কেন ফুল আসল; এর পরিণতি কোন দিকে যাচ্ছে?’

তিনি আরও বলেন, ‘আমি এবং বায়োটেকনোলজি ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের প্রণব চক্রবর্তীসহ বিজ্ঞানীদের যে দল এই মুহূর্তে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম তালিপামের জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের জন্য। এটি হলে আমরা জানতে পারতাম, সাধারণ তালগাছের সাথে এই তালিপামের পার্থক্যটা কোথায়।

‘কেন এটা ১০০ বছর পরে ফুল দিচ্ছে, কেন ১০০ বছর পরে ফুল-ফল দেয়ার পরে সেটা আবার মরেও যাচ্ছে। এই গবেষণার মাঠ পর্যায়ে এসে আমরা এ রকম একটি তথ্য পেলাম, এখন আমাদের গবেষণার মাত্রাটা আরও গভীর হবে।’

সারা দেশে এখন ১০০টি তালিপাম গাছ আছে জানিয়ে তিনি বলেন, সাধারণ পামের সাথে তালিপামের পার্থক্য জানতে বাকি ৯৯টা গাছ পর্যবেক্ষণে রাখা প্রয়োজন। একটা গাছের মধ্যে পরিবর্তন দেখা গেছে, এখন বাকি ৯৯টা গাছের মধ্যে এ ধরনের পরিবর্তন আসছে কি না।

টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক ড. আতাউল গনি বলেন, ‘তালিপাম বৃক্ষ আমাদের পূর্ববর্তী জেলা প্রশাসক মরহুম এম বজলুল করিম চৌধুরী এখানে রোপন করেছিলেন। আমরা এ গাছটি দেখাশোনা করছি। শত বৎসর পরে এই গাছে ফুল ফুটে গাছটি মারা যাওয়ার কথা। কিন্তু এখানে দেখা যাচ্ছে কয়েক বছরের মধ্যেই ফুল ফুটেছে।’

এ বিভাগের আরো খবর