নদীপথের নাব্যতা বাড়াতে ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের পক্ষেই জোরালো মতামত এসেছে ‘টেকসই নদী খনন: চ্যালেঞ্জ ও প্রতিকার’ শীর্ষক ওয়েবিনারে।
বলা হয়েছে, নদী খনন প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু করার আগে দরকার যথাযথ পরিকল্পনা প্রণয়ন, নদী শাসন এবং নদী তীরবর্তী এলাকার সঠিক ব্যবহারে গুরুত্ব দেয়া। এর পাশাপাশি আহ্বান রাখা হয় বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের এই ক্যাপিটাল ড্রেজিং কার্যক্রমে সম্পৃক্ত হওয়ারও।
শনিবার ঢাকা চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত এই ওয়েবিনারের আরও জানানো হয়, ‘একটা সময় বর্ষা মৌসুমে নদীপথের দৈর্ঘ্য ছিল ২৪ হাজার বর্গমাইল। বর্তমানে তা কমে নেমে এসেছে মাত্র ৬ হাজার বর্গমাইলে। শুকনো মৌসুমে এই দৈর্ঘ্য আরও কমে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৬০০ বর্গমাইলে। নৌপথ অর্থনৈতিক উন্নয়নে অন্যতম চালিকাশক্তি বিবেচিত হলেও দেশে নেই টেকসই নদীখনন ও আধুনিক ব্যবস্থাপনা। এর ফলে এ খাতে সরকারের যে বিনিয়োগ তার থেকে চাহিদানুযায়ী সুফল আসছে না। কারণ নদীপথের এই নাব্যতা বাড়াতে প্রয়োজন ক্যাপিটাল ড্রেজিং। সেখানেও রয়েছে সমস্যা। সারাদেশে নদী খননে ড্রেজার দরকার অন্তত ৫০০টি, সেখানে রয়েছে মাত্র ১৫৬টি।’
সরকার আভ্যন্তরীণ নদীপথের প্রায় ১০ হাজার কিলোমিটার ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে ব্যবহার উপযোগী করার কার্যক্রম গ্রহণ করলেও তা থেকে আশানুরূপ সুফল পাওয়া যায়নি।
এ পরিস্থিতিতে অর্থনীতিতে নদীপথের অবদান বাড়ানোর লক্ষ্যে নদীপথের অভিগম্যতা বৃদ্ধি ও টেকসই নদী খনন কার্যক্রম সম্প্রসারণ, জাতীয় বাজেটে এখাতে বরাদ্দ বাড়ানোর পরামর্শ উঠে আসে। একই সঙ্গে ড্রেজিং কার্যক্রমে ব্যবহৃত ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানিতে আমদানি শুল্ক, ভ্যাট ও অগ্রীম কর হ্রাসকরণ, নদী খনন ও ব্যবস্থাপনা সংশ্লিষ্ট উন্নয়ন কার্যক্রমকে সরকারের ফাস্টট্রাকের আওতায় অন্তর্ভূক্তিকরণ, মানবসম্পদের দক্ষতা উন্নয়ন এবং দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে আর্থিক প্রণোদনা ও নীতি সহায়তা বাড়ানোরও তাগিদও দেন বক্তারা।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে ঢাকা চেম্বারের সভাপতি রিজওয়ান রাহমান দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নকে বেগবান করতে নদী পথে অভিগম্যতা বাড়াতে টেকসই নদী খনন ও ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতে পরামর্শ রাখেন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, সারাদেশে নদীগুলোর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে সরকার নদী ব্যবস্থাপনার প্রতি জোরারোপের পাশাপাশি আরও ৩৫টি ড্রেজার সংগ্রহে কাজ করে যাচ্ছে। প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনেও কাজ হচ্ছে, সামনের দিনগুলোতে যার ইতিবাচক প্রভাব পরীলক্ষিত হবে।
তিনি উল্লেখ করেন, ইতোমধ্যে মংলা বন্দরের স্বক্ষমতা চট্টগ্রাম বন্দরের ন্যায় উন্নীত করা হয়েছে। দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে বেসরকারি খাতকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান মন্ত্রী।
তিনি বলেন, বিদ্যুৎখাতের সাফল্যকে উদাহরণ হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে, দেশের নদ-নদী খনন ও ব্যবস্থাপনা উন্নয়নে সরকার যুগোপযোগী ও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করছে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে কবির বিন আনোয়ার বলেন, যথাযথ নদী খনন কার্যক্রম বাস্তবায়নে মানব সম্পদ ও প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বৃদ্ধি এবং সমন্বিত নীতিমালা আবশ্যক এবং এ লক্ষ্যে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। তবে বেসরকারি খাতকে এ খাতে বিনিয়োগে এগিয়ে আসতে হবে।
ওয়েবিনারে মূল প্রবন্ধে অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত জানান, ড্রেজিং প্রধানত মেইট্যানেন্স ও ক্যাপিটাল দুই ধরনের হয়ে থাকে এবং এক্ষেত্রে নদীর চ্যানেল ব্যবস্থাপনা ও গভীরতা বৃদ্ধি, বন্দর উন্নয়ন, ভূমি ব্যবস্থাপনা ও ব্যবহার প্রভৃতি বিষয়সমূহ অতীব জরুরি।
তিনি জানান, টেকসই ড্রেজিং-এর ক্ষেত্রে সবসময়ই অর্থনীতি, সমাজ ও পরিবেশকে প্রধান্য দেয়া হয় এবং এ বিষয়ে আমাদের আরও সচেতন হতে হবে।
তিনি বলেন, ড্রেজিং’র ক্ষেত্রে টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা সম্ভব হলে, আমদের অর্থনীতি আরও উপকৃত হবে। বাংলাদেশের নদী ও খালসমূহের ড্রেজিং’র জন্য একটি মাষ্টার প্ল্যান প্রণয়ন এবং এজন্য বেসরকারি খাতকে সম্পৃক্ত করা আবশ্যক বলেও তিনি মত প্রকাশ করেন।
পিএসএ ইন্টারন্যাশনাল প্রাইভেট লিমিটেড’র সহ-সভাপতি রবার্ট হেনেসি বলেন, বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ হলেও এখন পর্যন্ত এ থেকে শতভাগ সুবিধা আদায় করতে পারেনি। বন্দরগুলোর সঙ্গে অন্যান্য স্থানের নদীপথের সংযোগ স্থাপন করা সম্ভব হলে স্বল্পমূল্যে পণ্য পরিবহনের সুবিধা নিশ্চিত হয়।
ইনস্টিটিউট অফ ওয়াটার মডেলিং-এর নির্বাহী পরিচালক আবু সালেহ খান বলেন, নদী ও খাল খননের সময় দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা প্রণয়ন, দক্ষ মানব সম্পদ উন্নয়ন এবং আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের ইস্যুগুলো খুবই জরুরি। আমাদেরকে এ সবে গুরুত্ব দিতে হবে।
বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়ারম্যান কমোডর গোলাম সাদেক বলেন, নদীপথের উন্নয়নে জিডিপির অন্তত দেড় শতাংশ বরাদ্দ দরকার, সেখানে বর্তমানে রয়েছে মাত্র ০.৪ শতাংশ। উন্নয়নের কাংখিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে এটিও একটি অন্যতম বাধা।