বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

কত বাঘ থাকা উচিত সুন্দরবনে?

  •    
  • ২৯ জুলাই, ২০২১ ১৩:৪৮

ক্যামেরা ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে ২০১৫ সালের বাঘ শুমারি অনুযায়ী, বাংলাদেশের সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ছিল ১০৬টি। ২০১৮ সালের শুমারিতে এই সংখ্যা ১১৪টি পাওয়া যায়।

বাংলাদেশের সুন্দরবনে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা জানতে বিভিন্ন সময়ে জরিপ চালানো হলেও প্রকৃত চিত্র নিয়ে বিতর্ক শেষ হয়নি। আবার আয়তন অনুযায়ী, এই বনে কতগুলো বাঘ থাকা দরকার সেটিও স্পষ্ট নয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে পদ্ধতি ব্যবহার করে বাঘের সংখ্যা বের করা হয় সেটি পুরোপুরি সঠিক নয়। আবার সুন্দরবনে কতসংখ্যক বাঘ থাকা উচিত, তা নিয়েও বিভ্রান্তি রয়েছে।

বন বিভাগ বলছে, সুন্দরবনে ছেলে বাঘ বা মেয়ে বাঘের সংখ্যা নির্দিষ্ট করে তাদের জানা নেই। সাধারণত একটি বনে মোট বাঘের সংখ্যার মধ্যে ছেলে বাঘ থাকে এক চতুর্থাংশ। সবশেষ বাঘ শুমারি অনুযায়ী, সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে বাঘের সংখ্যা ১১৪টি, ফলে এই বনে ৩০টির মতো পুরুষ বাঘ থাকার কথা।

২০১০ সালের জানুয়ারিতে থাইল্যান্ডের হুয়ানে অনুষ্ঠিত হয় টাইগার রেঞ্জ দেশগুলোর মন্ত্রিপর্যায়ের সম্মেলন। সেই সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রতিবছর ২৯ জুলাই বিশ্ব বাঘ দিবস পালিত হচ্ছে। সম্মেলনে বাঘ সংরক্ষণে ৯ দফা পরিকল্পনা গৃহীত হয়। ওই পরিকল্পনার একটি লক্ষ্য ছিল, ২০২০ সালের মধ্যে বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করা হবে।

তবে বাংলাদেশ ও ভারতের সুন্দরবনের মোট আয়তন এবং খাদ্যের জোগান বিবেচনায়, সেখানে বাঘের সংখ্যা এতটা বাড়ানো সম্ভব নয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

২০১৪ সালে ঢাকায় বাঘ সম্মেলনে, বাংলাদেশ ও ভারতের সুন্দরবনে ২০০৪ সালে পাগমার্ক পদ্ধতিতে (বাঘের পায়ের চিহ্ন গণনা ও বিশ্লেষণ) বাঘের সংখ্যা উপস্থাপন করা হয়। সে অনুযায়ী, বাংলাদেশ ও ভারতের সুন্দরবনে সব মিলিয়ে বাঘ ছিল ৪৪০টি। তবে পরে ক্যামেরা ট্র্যাকিংয়ে এই সংখ্যা অনেক কম এসেছে।

বাংলাদেশ ও ভারতের অংশে থাকা সুন্দরবনের আয়তন প্রায় ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার। এর মধ্যে বাংলাদেশ অংশে বনের আয়তন ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার। এই বনে যতসংখ্যক বাঘ এখন রয়েছে, তা ধরে রাখার ওপর জোর দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।

বাঘের বিচরণের জন্য কত এলাকা প্রয়োজন

বন্য প্রাণীবিষয়ক ওয়েবসাইট লায়ন্স ডটওআরজি-তে বলা হয়েছে একটি পুরুষ বাঘের জন্য কমপক্ষে ৬০ থেকে ১০০ বর্গকিলোমিটার বনভূমি প্রয়োজন। অন্যদিকে নারী বাঘের জন্য দরকার ২৯ বর্গকিলোমিটার। বাঘবিষয়ক আরও কিছু গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটেও একই ধরনের তথ্য রয়েছে।

বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের আয়তন প্রায় ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার এবং ভারতের অংশে আয়তন প্রায় ৪ হাজার বর্গকিলোমিটার। এই বনের বিস্তার বাংলাদেশে সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট ও পটুয়াখালী এবং পশ্চিমবঙ্গে উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা পর্যন্ত। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমে ও ভারতে দক্ষিণ-পূর্বে সুন্দরবনের অবস্থান।

২০০৪ সালের পর সুন্দরবনে বাঘের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য দু-একটি যৌথ শুমারি করে। এরপর ক্যামেরায় ছবি তোলার মাধ্যমে ২০১৫ সালে ও ২০১৮ সালে বাংলাদেশের সুন্দরবনে বাঘ শুমারি হয়।

ক্যামেরা ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে ২০১৫ সালের বাঘ শুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশের সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ছিল ১০৬টি। ২০১৮ সালের শুমারিতে এই সংখ্যা ১১৪টি পাওয়া যায়।

বাংলাদেশের গবেষকেরা বলছেন, একটি পূর্ণবয়স্ক ছেলে ও তিনটি মেয়ে বাঘের স্বাভাবিক বিচরণের জন্য ৬০ বর্গকিলোমিটার জায়গা প্রয়োজন। তবে এটি ৫২ কিলোমিটারও হতে পারে। সে হিসেবে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে বাঘ ধারণক্ষমতা হতে পারে ২২০ থেকে ২৫০টি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ফিরোজ জামান এর সঙ্গে খাদ্যের জোগানের ওপরেও গুরুত্ব দিচ্ছেন। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বাঘের নিয়মিত খাদ্য হচ্ছে হরিণ। যদি সুন্দরবনে পর্যাপ্ত হরিণ না থাকে তবে জায়গা থাকলেও বাঘ থাকবে না।’

তিনি বলেন, ‘বনে বাঘের সংখ্যা নির্ভর করবে খাদ্যের প্রতুলতার ওপর। বাঘের প্রধান খাদ্য হরিণ। এর পাশাপাশি শূকর ও অন্যান্য প্রাণী। তাই বাঘের সংখ্যা কত হবে তা চূড়ান্তভাবে খাদ্যের জোগানের ওপরে নির্ভরশীল।’

এই অধ্যাপক বলেন, ‘এখন বনে বাঘের যে পরিমাণ খাবার আছে, তাতে সর্বোচ্চ ১২০ থেকে ১৩০টি বাঘ থাকতে পারবে। কারণ জায়গা থাকলেও খাবার না থাকলে বাঘ থাকবে না। আমাদের এখানে বিলো ক্যারিং ক্যাপাসিটি রয়েছে। ফলে এমন না যে, ওখানে ২০০ বা ২৫০টি বাঘ থাকলে ভালো হবে। এটা থাকলে বাঘ কিন্তু খাবার পাবে না। তাই হরিণের মতো প্রাণী শিকার বন্ধ করতে হবে।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও বাঘ গবেষক অধ্যাপক মনিরুল এইচ খান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের বনের আয়তন অনুযায়ী বাঘের সংখ্যা অনেক বেশি হতে পারে। তবে শুধু জায়গার ওপর নির্ভর করলে হবে না। বাঘের খাবার থাকতে হবে যথেষ্ট পরিমাণে।

‘বাঘের জন্য খাদ্য একটা বড় বিষয়। বাসস্থানের সঙ্গে তার খাদ্য ও নিরাপত্তাও জরুরি।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানে বাঘ কমে যাওয়ার বড় কারণ শিকার। এ ছাড়া আর কোনো বড় সমস্যা নেই। তবে শুধু বাঘ শিকার নয়, এর সঙ্গে হরিণ যেটি বাঘের খাদ্য সেটিও শিকার হচ্ছে।’

বনের আয়তন নিয়ে তিনি বলেন, ‘যেখানে জায়গা ছোট সেখানে এটি ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে। তবে এটি সুন্দরবনের জন্য প্রযোজ্য নয়। পর্যাপ্ত জায়গা আছে সুন্দরবনে।’

কী বলছে বন বিভাগ

সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগ, খুলনা অঞ্চলের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ড. আবু নাসের মোহসিন হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সুন্দরবনে অবশ্যই ২৫০ থেকে ৩০০ বাঘ থাকা দরকার। তবে এটার জন্য বাঘের অভয়ারণ্য তৈরি করতে হবে। আগে ২৩ শতাংশ অভয়ারণ্য ছিল, যা এখন ৫২ শতাংশ করা হয়েছে। সেখানে কেউ যেতে পারে না।’

বন বিভাগের কর্মকর্তারা মনে করছেন, সমস্ত সুন্দরবনকে অভয়ারণ্য করা গেলে এবং সম্পদ আহরণ বন্ধ হলে বনে বাঘের সংখ্যা বাড়বে।

বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০০১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সুন্দরবন পূর্ব বিভাগে ২২টি এবং পশ্চিম বিভাগে ১৬টি বাঘের মৃত্যু হয়েছে। চোরাশিকার, বন থেকে লোকালয়ে আসার পর গণপিটুনি, ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের আঘাত, অসুস্থতা এবং বার্ধক্যজনিত কারণে বাঘ মারা যাচ্ছে।

আবু নাসের মোহসিন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এই মুহূর্তে আমরা কোনো ধরনের মাছ ধরার নৌকা বা পর্যটনের পাস দিচ্ছি না। এমন পরিবেশ ধরে রাখা গেলে বাঘের সংখ্যা বেড়ে যাবে। এখনই বাড়ছে।’

পায়ের ছাপের ভিত্তিতে বাঘ গণনার পদ্ধতি ভুল ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা ২০০৪ সালে যখন জয়েন্ট টাইগার শুমারি করেছি তখন ৪৪০টা পেয়েছি। সেটি একটা ভুল মেথড ছিল। এটাকে প্যারিস প্লাস্টার বলা হয়ে থাকে। আমরা বনের মধ্যে ৩২টা দলে ভাগ হয়ে পায়ের ছাপ খুঁজেছি। সবার কাছেই পাউডার ছিল। যেখানে বাঘের ছাপ ছিল, সেখানে প্যারিস প্লাস্টারের মাধ্যমে আমরা পায়ের ছাপ কালেক্ট করেছি। তখন ২০০০-এর মতো প্লেট সংগ্রহ করে পরে তা যাচাইয়ের মাধ্যমে ৪৪০টি সংখ্যা পাওয়া যায়।’

এই পদ্ধতির ত্রুটি ব্যাখ্যা করে আবু নাসের মোহসিন বলেন, ‘একই বাঘ একেক মিডিয়ামে হাটে। সেই কারণে এভাবে গণনায় ভুল ছিল। তবে ক্যামেরা ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে মোটামুটি নির্ভুলভাবে বাঘের সংখ্যা নির্ণয় করা যায়। ক্যামেরার সামনে দিয়ে বাঘ চলাচল করলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে তার ছবি পাওয়া যায়।’

আবু নাসের মোহসিন বলেন, ‘২০০৫ সালে আমি বাঘ নিয়ে একটি গবেষণা করেছিলাম। সেখানে ইকোলজি ও বিহেভিয়ার নিয়ে স্টাডি করেছি। সে সময় দেখেছি, আমাদের সুন্দরবনে একটা বাঘিনী ১৫ থেকে ১৭ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে থাকে। যদি এটা ২০ কিলোমিটারও ধরা হয়, আর সেখানে সুন্দরবনের আয়তন ৬ হাজার বর্গকিলোমিটার হলে তাহলে ৩০০ বাঘ থাকবে।

‘তবে পুরুষ বাঘের টেরিটোরি আরও বড়। আর তার সঙ্গে বাঘিনীর সংখ্যা ওভারল্যাপ করে। তিনটা মেয়ে বাঘকে একটা পুরুষ বাঘ কন্ট্রোল করতে পারে। তাই পুরুষ বাঘের টেরিটোরি ৬০ কিলোমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। তবে বিভিন্ন সময়ে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ৪০০ থাকা উচিত যেটা বলা হয়, সেটা ওভাররেটেড।’

পশ্চিমবঙ্গ বন বিভাগের প্রকাশ করা ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের বাঘ গণনা জরিপে ভারতে সুন্দরবন অংশে বাঘের সংখ্যা ৯৬টি বলা হয়েছে।

এ বিভাগের আরো খবর