বাড়িটিকে সবাই ডাকে ‘মৌবাড়ি’ বলে। আর ডাকবেই-বা না কেন। দোতলা বাড়িটির কক্ষে কক্ষে, ব্যালকনিতে, রান্নাঘরের পাশে, চিলেকোঠায়- সবখানেই মৌচাক। এই মৌচাক দেখতে প্রতিদিনই সেখানে ভিড় জমান অনেক মানুষ।
বাড়িটির অবস্থান সাতক্ষীরা শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে দেবহাটা উপজেলার সখিপুর ইউনিয়নের কোড়া গ্রামে। গ্রামের চিংড়িঘের ব্যবসায়ী শেখ আবু সাঈদ বাড়িটির মালিক।
আবু সাঈদ মৌমাছি পালন করেননি। মৌমাছিরাই তার বাড়ি দখল করে এসব চাক গড়ে তুলেছে।
মৌমাছির দল মোট ২৬টি মৌচাক বেঁধেছে বাড়িটিতে। সারা দিন মৌমাছির গুঞ্জন শোনা যায় সেখানে। কয়েক লাখ মৌমাছির বাস সেখানে। তারা যেন আবু সাঈদের পরিবারের সদস্য হয়ে গেছে। বাড়ির লোকজন মৌমাছিদের দেখাশোনা করেন। তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন।
সাত-আট বছর আগের কথা। একদিন সকালে উঠেই আবু সাঈদ পরিবারের লোকজন দেখতে পান রাতারাতি তাদের বাড়িঘরের এখানে-ওখানে অনেক মৌচাক। এরপর সেখানে পর্যায়ক্রমে মৌমাছি আসতেই থাকে। প্রথমে ভয় পেয়েছিলেন আবু সাঈদ ও তার পরিবারের সদস্যরা। মৌমাছির কামড়ের কথা মাথায় রেখে এই চাক ভাঙতেও পারেননি, আবার রাখতেও ভয় পাচ্ছিলেন।
আবু সাঈদ বলেন, ‘আস্তে আস্তে দেখলাম তারা কারও ক্ষতি করছে না। আসলে মানুষ আঘাত না করলে মৌমাছিরা কামড়ায় না।’
তিনি জানান, বছরের সাত থেকে আট মাস তার বাড়িতে চাকগুলো থাকে। এখন তার বাড়িতে রয়েছে ২৬টি চাক। কার্তিক থেকে জ্যৈষ্ঠ- এই কয়টা মাস তারা তার বাড়িতে বাস করে। এরপর সব মৌমাছি উধাও হয়ে যায়। কোথায় চলে যায় সে খবর জানা যায় না। কয়েক মাস পর ফের সরিষা ফুলের সময় চলে আসে মৌমাছিরা।
তিনি বলেন, এখন ফুলের মৌসুম নয়। ওরা সরিষা, আমের মুকুল, সফেদা ও লিচুর ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে। ফুলের মধুর সংস্থান কমে গেলে ওরা উড়াল দেয় ঝাঁকে ঝাঁকে। এদের কোনো খাবার দিতে হয় না। প্রাকৃতিকভাবে তারা ফুলের মধু সংগ্রহ করে চাকে মধুর ভাণ্ডার গড়ে তোলে। চাকের ১০০ ভাগ মধুর মধ্যে তিনি নেন ৭৫ ভাগ। বাকি ২৫ ভাগ মৌমাছিদের খাওয়ার জন্য রেখে দেয়া হয়।
আবু সাঈদ প্রতিবছর ৫০ হাজার টাকার মধু বিক্রি করে থাকেন। আর এই খাঁটি মধুর খবর শুনে তার বাড়িতে যেমন মৌচাক দেখতে মানুষ যেমন ভিড় করেন, তেমনি তারা মধুও কিনে নেন। প্রতি কেজি মধু বিক্রি হয় ৫০০ টাকায়।
আবু সাঈদ জানান, মৌমাছিগুলো তাদের পরিবারের সদস্যের মতো। যখন ঝড়বৃষ্টি হয়, তখন তাদের জন্য চিন্তা হয়। ওদের নিরাপত্তার জন্য জানালা-দরজা বন্ধ করে রাখা হয়। তার স্ত্রী রঞ্জিলা বেগম সব সময় মৌচাকগুলো দেখভাল করে থাকেন। বাড়ির রান্নাঘরের পাশেই রয়েছে মৌচাক। বছরে আট মাস মৌমাছিগুলো বাড়িতে থাকে। নিজে থেকে আসে, আবার নিজে থেকে চলে যায়।
আবু সাঈদের স্ত্রী রঞ্জিলা বেগম বলেন, কোনো দিন কোনো মৌমাছি তার পরিবারের কাউকে কামড়ায়নি। আবার তারাও মৌমাছিকে কোনোভাবে আঘাত করেননি। তবে আমগাছে কীটনাশক স্প্রে করার সময় একবার বেশ কিছু মৌমাছি মারা যায়। তখন মনে হয়েছিল ওরা বুঝি আর আসবে না। তা কিন্তু হয়নি। ঝাঁকে ঝাঁকে মৌমাছি আবারও প্রাকৃতিক নিয়মেই আসে প্রতিবছর।
আবু সাঈদ দম্পতির মেয়ে সখীপুর আহছানিয়া ডিগ্রি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী ফতেমা খাতুন বৃষ্টি বলেন, তাল, কুল, পেয়ারা, সরিষা, আমসহ বিভিন্ন ফুলের মধু সংগ্রহ করতে মৌমাছিরা নিরিবিলি পরিবেশে তাদের বাড়িতে আসছে আট বছর ধরে। মানুষ ও মৌমাছির নিবিড় মেলবন্ধনের বিষয়টি তাদের বাড়িতে না এলে কেউ বুঝতে পারবে না। সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা ছাড়া এমনটি হওয়া সম্ভব নয়।
আবু সাঈদের শিশুসন্তান শেখ ইসমাইল হোসেন বলে, ওরা আমাদের পরিবারের সদস্য। সহপাঠীরা তাদের বাড়ির মৌচাকের খবর জানতে চাইলে মোবাইল ফোনে তোলা ছবি দেখিয়ে দেয়।
প্রতিবেশীরা জানান, এই মৌবাড়ির খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। এ খবর সত্য কি না, তা জানার জন্য বহু মানুষ প্রতিদিন এখানে আসেন। খুব ভালো লাগে।
দেবহাটা উপজেলার সখিপুর ইউপির চেয়ারম্যান ফারুক হোসেন রতন বলেন, ‘আমি যখনই কোড়া গ্রামে আসি, তখনই মৌচাকগুলো দেখে যাই। মানুষ ও মৌমাছি কী সুন্দরভাবে একসঙ্গে বসবাস করছে। দেখে খুব ভালো লাগে।’
সাতক্ষীরা খামার বাড়ির উপপরিচালক মো. নুরুল ইসলাম জানান, এপিস ডরসাটা জাতের মৌমাছি এগুলো। এই জাতের মৌমাছি সুন্দরবনে থাকে। বনে অনুকূল পরিবেশ না পেলে তারা হঠাৎ লোকালয়ে চলে আসে। লোকালয়ে কিছুদিন বসবাসের পর আবারও ফিরে যায় সুন্দরবনে। মৌমাছিকে বিরক্ত না করলে তারা কারোর ক্ষতি করে না।
তিনি বলেন, ‘সুস্থ পরিবেশ পাওয়ায় সুন্দরবনের মৌমাছিরা আট মাস ধরে কোড়া গ্রামের আবু সাঈদের বাড়িতে অবস্থান করে। একটি চাকের মৌমাছি অপরটিতে যায় না। প্রতিকূল অবস্থা সৃষ্টি হলে তারা নতুন আবাস না খুঁজে পুরোনো আবাসেই ফিরে আসে। এটাই মৌমাছির স্বভাব। আবু সাঈদের বাড়িতে এভাবেই মৌমাছির ২৬টি দল চাক বেঁধেছে। আর তাই বাড়িটির নামও হয়ে উঠেছে মৌবাড়ি।’