ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির জেমস পি গ্র্যান্ট স্কুল অফ পাবলিক হেলথের সহকারী গবেষক আসরিফা জিহান সায়মার নগদ টাকা ও মোবাইল ফোন ছিনতাই করে তার ফেসবুকের প্রোফাইল পিকচার ও কাভার ফটো বদলে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা।
আসরিফা জিহান সায়মা নিউজবাংলাকে জানান, বুধবার চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা আসার পথে টঙ্গী রেলস্টেশনের কাছে ছিনতাইয়ের শিকার হন তিনি। এ সময় মহানগর গোধূলী ট্রেনের দ্বিতীয় বগিতে স্বামীর সঙ্গে জানালার পাশে বসা ছিলেন তিনি।
এই গবেষক জানান, সন্ধ্যায় টঙ্গী স্টেশনের কাছাকাছি এলে ট্রেনের ছাদে থাকা এক ছিনতাইকারী হঠাৎ জানালার দিকে ঝুঁকে তার হাত থেকে হ্যান্ডব্যাগ নিয়ে নেয়। ব্যাগে নতুন একটি স্মার্টফোন ও ১৩ হাজার টাকা ছিল।
সায়মার অভিযোগ, তাৎক্ষণিকভাবে তারা বিষয়টি রেলের নিরাপত্তাকর্মী ও পুলিশ সদস্যদের জানান। বিভিন্ন বগিতে ছোটাছুটি ও চিৎকার করে ছাদে থাকা ছিনতাইকারীদের ধরার সহযোগিতা চান, কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি।
জরুরি সেবার হটলাইন ৯৯৯-এ ফোন করেও কোনো সহায়তা পাননি। প্রায় আধা ঘণ্টা পর ফোন ও টাকা রেখে তাদেরই জানালার পাশে ঝুলিয়ে রাখা হয় ব্যাগটি। এ কারণে তাদের সন্দেহ, এই ছিনতাই চক্রের সদস্যরা একই বগিতে ছিল।
চলন্ত ট্রেনে ছিনতাইয়ের শিকার হওয়ার পর সায়মার কোনো সহযোগিতা না পাওয়ার অভিযোগের বিষয়ে সোমবার নিউজবাংলা কথা বলেছে কমলাপুর রেলওয়ে থানার ওসি মো. মাজহারুল হকের সঙ্গে।
তিনি বলেন, ‘ট্রেনের মধ্যে এমন ঘটনা ঘটেছে, কেউ তো আমাকে অবহিত করেননি। ৯৯৯-এ ফোন করলেও তো পুলিশ সদরদপ্তরের হটলাইনের মাধ্যমে আমাকে জানানোর কথা।’
কমলাপুর রেলওয়ে থানার ওসি বলেন, ‘চলন্ত ট্রেনে এমন কমান্ডো স্টাইলে ছিনতাইয়ের কথা তো শুনি নাই। এ বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
ভুক্তভোগী এই দম্পতি জানান, তারা দুজনই রাজধানী মহাখালীর ব্র্যাক জেমস পি গ্র্যান্ট স্কুল অফ পাবলিক হেলথের সহকারী গবেষক। তাদের বাড়ি চট্টগ্রামে, ঢাকায় থাকেন মহাখালী এলাকায়ই।
সায়মা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমার ব্যাগে ১৩ হাজার টাকা ছিল। আমি কয়েকবার শুধু নতুন কেনা মোবাইল ফোন ব্যাগ থেকে বের করেছি, ব্যাগে রেখেছি। তারপরই আমার কোলের ওপর থেকে ব্যাগটি টান মেরে ছাদে নিয়ে গেল।
‘ছাদের ওপর থেকে তাদের ধরতে নিরাপত্তাকর্মী-পুলিশকে বলেছি, তারা কোনো উদ্যোগই নেননি। চাইলে তারা তখনই ধরতে পারতেন। কারণ ট্রেনটি দ্রুতগতিতে চলছিল। এর কিছুক্ষণ পর ছিনতাইকারীরা ছাদের ওপর থেকে ব্যাগটি সিটের জানালা বরাবর ঝুলিয়ে দেয়। তখন ব্যাগটি টেনে নিয়ে দেখি নতুন মোবাইল ও ১৩ হাজার টাকা নিয়ে গেছে। হ্যান্ডব্যাগে থাকা ব্যাংকের কার্ড ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের কিছুই নেয়নি।’
তিনি জানান, ব্যাগ ছিনতাই থেকে শুরু করে জানালার সামনে ঝুলিয়ে রাখার পুরো ঘটনা ঘটে আধা ঘণ্টা ধরে।
তাদের অভিযোগ, কেউ কোনো সহযোগিতা না করায় তারা ফের সিটে গিয়ে বসেন। তখনই জানালা বরাবর ব্যাগটি ঝুলিয়ে রাখা হয়। এ থেকে তাদের সন্দেহ, ছিনতাই চক্রের সদস্যরা তাদের বগিতেই ছিল। তাদের তথ্য ছাড়া এভাবে ওপর থেকে ব্যাগ টেনে নিয়ে আবার ফেরত দেয়া সম্ভব নয়।
আসরিফা জিহান সায়মা বলেন, ‘শুধু তাই নয়, মোবাইল ফোন চালু করে তারা আমার ফেসবুকে ঢুকে কাভার ও প্রোফাইল পিকচার চেঞ্জ করে দেয়। ফটোগ্যালারি থেকে আমার অন্য ফটো আপ করে। আমার স্বজনদের ফোন দিচ্ছে ইমো আইডি দিয়ে।’
তিনি জানান, ছিনতাইয়ের সময় ফোনের মধ্যে গ্রামীণ ও বাংলা লিংকের দুটি সিম কার্ড ছিল। জিপি নম্বর ব্লক করে দিতে পারলেও বাংলা লিংকের সিম খোলা রয়েছে।
আসরিফা জিহান সায়মা বলেন, ‘বুধবার রাত থেকে এখন পর্যন্ত (সোমবার বিকেল) ছিনতাইকারীরা আমার ইন্টারনেট ব্যবহার করে আমার মোবাইল ফোনের ইমো আইডি দিয়ে আমারই আত্মীয়স্বজনদের ফোন করছে। আমার ছবি পাঠাচ্ছে। তবে ফোন রিসিভ করলেও কোনো কথা বলছে না।
‘যেদিন ছিনতাই করেছে, সেই দিনগত রাত ৪টার দিকে ফেসবুকের কাভার ফটো ও প্রোফাইল পিকচার বদলে দেয় দুর্বৃত্তরা। এ ছাড়া রাত সাড়ে ৩টার দিকে হোয়াটসঅ্যাপ স্টোরিতে আমার আরেকটি ছবি আপ করে।’
১৫ আগস্ট রাজধানীর কমলাপুর রেলওয়ে থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন বলে জানান তিনি। তবে জিডিতে ছিনতাইয়ের ঘটনা উল্লেখ না করে মোবাইল ফোন হারানোর কথা বলেছেন।
এর কারণ হিসেবে আসরিফা জিহান সায়মা বলেন, ‘পুলিশ বলেছে, যে ঘটনা ঘটেছে, তাতে মামলা হয়। আর মামলা করতে গেলে আসামির নাম লাগবে। আসামির নাম যেহেতু জানেন না, হারানোর জিডি করেন।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কমলাপুর রেলওয়ে থানার ওসি মাজহারুল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘জিডির সূত্র ধরে মোবাইল ফোনটি উদ্ধার ও ছিনতাইকারীদের শনাক্তের চেষ্টা চলছে। ছিনতাইকারীরা গ্রেপ্তার হওয়ার পর মামলা নেয়া হবে।’
আখাউড়ার পরই সক্রিয় ছিনতাইকারীরা
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক পুলিশ ও ভুক্তভোগী নিউজবাংলাকে জানান, মহানগর গোধূলী ট্রেনে প্রায় প্রতিদিনই সন্ধ্যার পর ছিনতাই হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া রেলস্টেশন পার হওয়ার পরপরই চলন্ত ট্রেনে এ ধরনের ঘটনা ঘটে। ছিনতাই শেষে টঙ্গী স্টেশনে নেমে যায় তারা।
এই ছিনতাই চক্রের সদস্যরা ট্রেনের ছাদে ও বগিতে থাকে। বগিতে থাকা সদস্যরা জানালার পাশে থাকা যাত্রীদের তথ্য ট্রেনের ছাদে থাকা সদস্যদের জানিয়ে দেয়। পরে ছাদে থাকা চক্রের এক সদস্যের পা ধরে তাকে ঝুলিয়ে দেয় অন্য সদস্যরা। ঝুলে থাকা এই সদস্য হঠাৎ বগির ভেতরে জানালার পাশে থাকা যাত্রীদের ব্যাগ ও মোবাইল ফোন টান মেরে নিয়ে নেয়। এরপর কখনও কখনও শুধু টাকা বা মোবাইল ফোন রেখে ব্যাগ ফেরত দিয়ে দেয় চক্রটি।
‘এটা নতুন চক্র’
ঢাকা রেলওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. বদরুদ্দোজা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘চলন্ত ট্রেনে ছিনতাইয়ে জড়িত আগের প্রায় সব গ্রুপের সদস্যই পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে। তবে আখাউড়া থেকে টঙ্গী স্টেশন পর্যন্ত যে গ্রুপের কথা বলছেন, এটি নতুন চক্র। ছিনতাইয়ের ধরন শুনে মনে হচ্ছে, এরা দুর্ধর্ষ ও বেপরোয়া প্রকৃতির। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের জানিয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হবে।’