বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

করোনায় স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির ‘পৌষ মাস’ 

  •    
  • ১০ আগস্ট, ২০২১ ১৬:৪১

স্বাস্থ্য খাতে বিভিন্ন দুর্নীতি নিয়ে অভিযোগের পাহাড় জমেছে দুদকে। অনলাইন ও হটলাইনেও প্রতিনিয়ত আসছে অভিযোগ। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারি মেডিক্যাল কলেজ, হাসপাতাল ও সিভিল সার্জন কার্যালয়ে কেনাকাটায় দুর্নীতিতে জড়িত ১৫০ জনের তালিকা ধরে অনুসন্ধানে নেমেছে দুদক।

করোনাভাইরাসের মহামারিতে দেড় বছরের বেশি সময় ধরে বিপর্যস্ত দেশ। তবে এই পরিস্থিতির ‘সুযোগ নিয়ে’ স্বাস্থ্য খাতে লাগামহীন দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এ অবস্থা ঠেকাতে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বেশ কিছু সুপারিশ করলেও তা আমলে নেয়নি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

নিউজবাংলার অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দুর্নীতি করতে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে করোনা আতঙ্ককে। করোনায় ‘অগ্রধিকার খাত’ বা ফ্রন্টলাইন হিসেবে চিহ্নিত করে স্বাস্থ্য খাতে চলছে সীমাহীন অনিয়ম। কেবল সরকারি পর্যায়ে নয়, বেসরকারি পর্যায়েও চলছে নিয়ম লঙ্ঘনের প্রতিযোগিতা। বিভিন্ন অজুহাতে বেসরকারি হাসপাতালে করোনা চিকিৎসার নামে রোগী ও স্বজনের পকেট কাটা হচ্ছে।

এসব নিয়ে অভিযোগের পাহাড় জমেছে দুদকে। অনলাইন ও হটলাইনেও প্রতিনিয়ত আসছে অভিযোগ। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারি মেডিক্যাল কলেজ, হাসপাতাল ও সিভিল সার্জন কার্যালয়ে কেনাকাটায় দুর্নীতিতে জড়িত ১৫০ জনের তালিকা ধরে অনুসন্ধানে নেমেছে দুদক।

দুদকে জমা পড়া অভিযোগ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সরকারি মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে ওষুধ, চিকিৎসা সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতি কেনায় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে। এসব সিন্ডিকেট সরকারের দেয়া বাজেটের ৭০-৮০ ভাগই হাতিয়ে নিচ্ছে।

গত বছরের শেষ প্রান্তিকে দুদক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ৫৯ কর্মকর্তা-কর্মচারী ও তাদের স্ত্রীসহ মোট ১১৮ জনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানে মাঠে নামে। তাদের বিরুদ্ধে সিন্ডিকেট করে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ, বিদেশে অর্থ পাচার ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে।

করোনার মধ্যে দুদকে জমা পড়া অভিযোগের মধ্যে একটি হলো গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধুর মায়ের নামে নির্মিত শেখ সায়েরা খাতুন মেডিক্যাল কলেজের বাতি কেনায় দুর্নীতি।

এই অভিযোগ এসেছে খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ভাগনে রায়হান হামিদের প্রতিষ্ঠান ‘বিডি থাই কসমো লিমিটেড’-এর বিরুদ্ধে। যেখানে ৫৫০ টাকার ১৫ ওয়াটের বাথরুম লাইট কেনা হয়েছে ৩ হাজার ৮৪৩ টাকায়। ১৮ ওয়াটের ৮০০ টাকা দামের সারফেস ডাউন লাইট কেনা হয়েছে ৩ হাজার ৭৫১ টাকায়। এলইডি ওয়াল স্পট লাইট ৪০০ টাকার পরিবর্তে কেনা হয়েছে ১ হাজার ৫৫৬ টাকায়। এ রকম ২৪টি সরঞ্জাম সরবরাহের দায়িত্ব পেয়েছে তারা।

অভিযোগ রয়েছে, পিডব্লিউডির তালিকাভুক্ত না হয়েও এসব সরঞ্জাম সরবরাহ করছে প্রতিষ্ঠানটি। তবে রায়হান হামিদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘নিয়ম মেনেই সব হয়েছে।’

সিরাজগঞ্জের এম মনসুর আলী মেডিক্যাল কলেজ ও ৫০০ শয্যার হাসপাতাল রক্ত পরীক্ষায় ব্যবহৃত ছোট্ট একটি টিউবের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ২ হাজার টাকার জায়গায় দেখানো হয়েছে ১ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। এ হিসাবে ৫০টি টিউব কিনতে খরচ হয়েছে ৬৭ লাখ ৪০ হাজার টাকা। এ-সংক্রান্ত একটি অভিযোগও জমা পড়েছে দুদকে।

এই অভিযোগে দেখা গেছে, একটি ডিসেক্টিং টেবিলের দাম বাজারে ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা, কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এ ধরনের দুটি টেবিল কিনেছে ৬৯ লাখ ৯০ হাজার টাকায়। ফলে একটি টেবিলের দাম পড়েছে ৩৪ লাখ ৯৫ হাজার টাকা।

এরই মধ্যে শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ ও ৫০০ শয্যার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কেনাকাটায় দুর্নীতির অভিযোগে হাসপাতালের প্রকল্প পরিচালক ডা. কৃষ্ণ কুমার পালসহ দুজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক। তাদের বিরুদ্ধে ৩০ কোটি ৩ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে।

করোনাকালে সরকারের কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের (সিএমএসডি) ৯০০ কোটি টাকার কেনাকাটায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (পরিকল্পনা) অধ্যাপক ডা. ইকবাল কবিরের নাম উঠে আসে। তদন্তে তার সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়ার পর ডা. ইকবালকে দায়িত্ব থেকে সরানো হয়েছে, তবে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা হয়নি।

দুদক কমিশনার (তদন্ত ও অনুসন্ধান) মোজাম্মেল হক খান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘স্বাস্থ্য খাত আগে থেকেই অস্বাস্থ্যকর ছিল। করোনায় তাদের আরও সুবিধা হয়েছে।

‘তাড়াতাড়ি কিনতে হবে। মানুষকে বাঁচাতে হবে। ফ্রন্টলাইনার। এসব গল্পটল্প মেরে তারা এখন এমন পর্যায়ে গেছে যে, তাদের আমরা ধরতে গেলেও তারা বলছে, আমরা নাকি তাদের হতাশ করে ফেলছি। তারা কোনো কাজ করতে পারছে না।’

সরকারি-বেসরকারি সব ক্ষেত্রেই অনিয়মের অভিযোগ আছে জানিয়ে মোজাম্মেল হক খান বলেন, ‘কী আর বলব! এখন অনেক জায়গায় করোনার দোকান বসাইছে। অনেক হাসপাতালে। অনেক অভিযোগ আসছে। এমনও অভিযোগ আছে যাদের অক্সিজেন লাগত না, তাদেরও অক্সিজেন দেয়া হচ্ছে। যাদের আইসিইউ লাগত না তাদেরও আইসিইউতে ঢোকানো হয়।

‘বড় হাসপাতালগুলো যা আছে, তারা আগে পেশেন্টের আয়-ইনকাম, আর্থিক অবস্থা দেখে। ইনকাম ট্যাক্সের ফাইলটাইল দেখে, তারপর সেই রকম চিকিৎসা করে। এখন আমরা যাদের ফ্রন্টলাইনার বলি, তাদের সম্পর্কে এ ধরনের অভিযোগ! আমরা কোথায় যাব বলেন?’

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ‘নীরবতায়’ হতাশা জানিয়ে দুদকের এই কমিশনার বলেন, ‘আমরা সুপারিশ দিয়েছিলাম। এর কিছুও যদি মানা হতো, তাহলে দুর্নীতি কমে আসত। আমরা বলেছিলাম, নির্দিষ্ট লোকের কাছ থেকে, চিহ্নিত প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে মালামাল কেনা যাবে না। সব ক্রয়-প্রক্রিয়া হতে হবে ওপেন টেন্ডারের মাধ্যমে। এরপরেও তারা চিহ্নিত লোকের কাছ থেকেই সব কেনাকাটা করছে। তাহলে আপনি দুর্নীতিটা বন্ধ করবেন কী করে!’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগে পরিচালক হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে ডা. বে-নজীর আহমেদের। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘টাকা বানানোর টার্গেট করেই একটি গোষ্ঠী স্বাস্থ্য খাতে বিভিন্ন অফার নিয়ে আসে। তারা জানে এই খাত সরকারের অন্যতম টাকা খরচের খাত। তারা খুবই স্মার্ট এবং তাদের বড় বড় কানেকশন আছে। নানা পর্যায়ে তাদের পরিচিতি আছে।

‘আমাদের স্বাস্থ্য খাতও এই র‌্যাকেটকে সুযোগ দিতে প্রস্তুত। কারণ আমাদের কেনাকাটার পদ্ধতি দুর্বল এবং ত্রুটিপূর্ণ। এর সঙ্গে যুক্ত হন স্বাস্থ্য বিভাগের কেউ কেউ। তারা বছরের পর বছর এই লুটপাটের অংশীদার হওয়ার সুযোগ পান এবং কাজে লাগান। এই দুই মিলেই আজ স্বাস্থ্য খাতের এই চিত্র।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এবং সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কী বলব! স্বাস্থ্য খাত পরিচালনা নীতিতেই সমস্যা। যে কারণে কেনাকাটা বা হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা, সবখানেই চলে দুর্নীতি। এ ক্ষেত্রে বেনিফিশিয়ারির সংখ্যা অনেক। এই খাতকে ঢেলে সাজানো ছাড়া মুক্তি নাই।’

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক অবশ্য দাবি করছেন স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির মাত্রা অনেক কমেছে।

তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘স্বাস্থ্যে দুর্নীতির অবস্থা আগের চেয়ে কমে এসেছে। দুদকের সুপারিশগুলো পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। তবে করোনার কারণে সবকিছু শতভাগ বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি।’

করোনার সময়ে স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি বন্ধে সরকারের কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার ওপর জোর দিচ্ছেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান।

তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘স্বাস্থ্য খাতে লুটপাট বন্ধ করা কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে অনেক ধরনের সমীকরণ আছে। কারণ, লুটপাটের র‌্যাকেটটা বিস্তৃত। ধীরে ধীরে ডানা ছেঁটে একে কমিয়ে আনতে হবে। নিয়ন্ত্রণে এনে এরপর প্রতিরোধ করতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে সফলতা পেতে আইনের প্রয়োগ ও নীতিমালা বাস্তবায়নে ছাড় দেয়ার সুযোগ নেই। মূল কথা, যারা লুটপাটের গভীরে থেকে মূল ক্রীড়ানকের ভূমিকায় থাকে, তাদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনাই একমাত্র সমাধান।’

এ বিভাগের আরো খবর