বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

‘৩ ডোজ টিকা’ নেয়া সেই ওমর ফারুক কোথায়?

  •    
  • ২৮ জুলাই, ২০২১ ২১:১৮

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ মঙ্গলবার বিকেলে নিউজবাংলার কাছে ওমর ফারুককে তিন ডোজ টিকা দেয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন। তবে রাতেই তিনি বক্তব্য পরিবর্তন করেন। অন্যদিকে ফারুককে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ করেছে তার পরিবার।

করোনার তিন ডোজ টিকা নেয়ার অভিযোগ তোলা ওমর ফারুককে নিয়ে লুকোচুরি করছে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) কর্তৃপক্ষ। ফারুককে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ করেছে তার পরিবার। তবে তা অস্বীকার করছে বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষ।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ মঙ্গলবার বিকেলে নিউজবাংলার কাছে ওমর ফারুককে তিন ডোজ টিকা দেয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন। তিনি বলেন, এরপরও ফারুক সুস্থ আছেন এবং তাকে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। তার বক্তব্যের অডিও রেকর্ড নিউজবাংলার কাছে আছে।

তবে উপাচার্য মঙ্গলবার রাতেই তার বক্তব্য পরিবর্তন করে কয়েকটি সংবাদমাধ্যমকে জানান, তাদের প্রতিষ্ঠান থেকে কাউকে একসঙ্গে তিন ডোজ টিকা দেয়া হয়নি।

সৌদি আরবে যাওয়ার আগে করোনা প্রতিরোধী টিকা নিতে সোমবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দা ওমর ফারুক। তবে না বুঝেই তিনটি বুথ থেকে তিন ডোজ টিকা নেন তিনি।

টিকা নেয়ার পর ওমর ফারুক একটি বেসরকারি টেলিভিশনকে বলেন, ‘আমি যখন প্রথমে টিকাকেন্দ্র ঢুকলাম, তখন একজন ইশারা দিয়ে ডান সাইটে যেতে বললেন। ওখানে গিয়ে এক ডোজ টিকা নিলাম। টিকা দিয়ে উনি সামনের দিকে যেতে বললেন।

‘সামনের ব্যক্তি দ্বিতীয়বার টিকা দিয়ে বললেন, আপনি সামনে যান। আরও সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে একটি চেয়ারে বসলাম। উনি কিছু জিজ্ঞেস না করে আরও এক ডোজ টিকা আমাকে দিয়েছেন। পরে বাইরে এসে লোকদের জিজ্ঞেস করলাম আপনারা কয়বার টিকা দিয়েছেন, তারা বললেন, একবার।’

বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ মঙ্গলবার বিকেলে নিউজবাংলা বলেন, ‘ওমর ফারুক সুস্থ আছেন এবং তিনি সাত দিন পর্যবেক্ষণে থাকবেন।’

আরও পড়ুন: একসঙ্গে তিন ডোজ টিকা নেয়া ওমর ফারুক পর্যবেক্ষণে

তবে এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে উপাচার্য তার বক্তব্য পরিবর্তন করে দাবি করেন, একজনকে তিনবার টিকা দেয়ার কোনো ঘটনা ঘটেনি।

বিএসএমএমইউর লুকোচুরি

ঘটনাটি নিয়ে বুধবারও দিনভর অনুসন্ধান চালায় নিউজবাংলা। দুপুরে বিএসএমএমইউর উপাচার্যের কার্যালয়ে গিয়ে ওমর ফারুকের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হাসপাতালে এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। এ বিষয়ে সকালে একটি মিটিং হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ঘটনা ভাইরাল হয়েছে, যে কারণে অনেক সাংবাদিক আমাকে প্রশ্ন করছে। আমি তাদের বলেছি, এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে না। বাংলাদেশে এমন কোনো ব্যক্তি নেই, যিনি জানেন না এক দিনে একটার বেশি টিকা নেয়া যায় না।’

তিনি আরও বলেন, ‘ওই ব্যক্তিটি (টেলিভিশনের প্রতিবেদনে দেখানো ওমর ফারুক) পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা ছিল। তিনবার টিকা নিলে পাঞ্জাবির হাতা তিনবার ওঠানো লাগছে, কত সময় লাগছে। এ ছাড়া টিকা যারা দিচ্ছেন সেই নার্সরাও অনেক দক্ষ। একবার দেয়ার পর দ্বিতীয়বার দিলে টিকাদানের স্থান দেখলেই নার্সরা বুঝতে পারতেন। টিকা নেয়ার স্থান লাল হয়ে থাকত।’

তাহলে আগের দিন নিউজবাংলাকে তিনি কেন ওমর ফারুককে পর্যবেক্ষণে রাখার কথা বলেছিলেন, এমন প্রশ্ন করলে উপাচার্য শুরুতে বিষয়টি অস্বীকার করেন। তবে ফোন রেকর্ড থাকার কথা জানানোর পর তিনি বলেন, ‘আমরা ওই লোকটিকে পাইনি। আর ওই লোকটির যদি কিছু হতো তাহলে তো জানতেই পারতাম। আপনারাও জানতেন। তার মানে এই লোকটি এখনও বেঁচে আছেন। তিন ডোজ টিকা তিনি কীভাবে নিলেন, সেটি খোঁজার দায়িত্ব সহকারী পরিচালককে দিয়েছি।’

টিকাদানে অব্যবস্থাপনার অভিযোগ

ওমর ফারুকের ক্ষেত্রে তিনবার টিকা নেয়ার বিষয়টি কীভাবে ঘটতে পারে, সেটি বোঝার জন্য বিএসএমএমইউর টিকাদান কেন্দ্রের ব্যবস্থাপনা অনুসন্ধান করেছে নিউজবাংলা। তবে তথ্য দিতে অসহযোগিতামূলক আচরণ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

টিকাদান কেন্দ্রে গেলে গেটেই নিউজবাংলার প্রতিবেদককে আটকে দেন আনসার সদস্যরা। এরপর মোবাইল ফোনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের করোনা টিকাদান কার্যক্রমের সমন্বয়ক খোরশীদ আলম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সাংবাদিকদের টিকাকেন্দ্রের ভেতরে যেতে না দিতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মানা রয়েছে।’

এরপর টিকাকেন্দ্রের বাইরে এসে কথা বলেন খোরশীদ আলম। তিনি বলেন, ‘আমরা আশা করিনি এমন একটা অপপ্রচার সাংবাদিক ভাইয়েরা ছড়াবেন। আমাদের এখানে এ ধরনের ঘটনা ঘটে নাই।’

ওই কেন্দ্রে টিকা নেয়া বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছে নিউজবাংলা। তাদের অনেকেই অব্যবস্থাপনার অভিযোগ করেছেন।

ওই কেন্দ্র থেকে টিকা নেয়া বেশ কয়েকজন নিউজবাংলাকে জানান, টিকা নেয়ার কক্ষে ঢোকার আগেই সবার কাছ থেকে কার্ড নিয়ে তাতে সিল-স্বাক্ষর দিয়ে দেয়া হয়। ফলে টিকা পাওয়ার আগেই সার্ভারে যুক্ত হয়ে যায় গ্রহীতার তথ্য। এরপর একসঙ্গে ১০-১৫ জনকে কক্ষে ডেকে নিয়ে টিকা দেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। ওই কক্ষে যে যার ইচ্ছামতো যেকোনো টেবিলের সামনের চেয়ারে বসে টিকা নেন। ওই কক্ষে অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে টিকাদান এবং নজরদারির বিষয়টি খুব দুর্বল বলে জানিয়েছেন কয়েকজন টিকা গ্রহীতা।

বিএসএমএমইউর ওই কেন্দ্র থেকে টিকা নিয়েছেন বেসরকারি একটি টেলিভিশনের কর্মী ফারহানা ফারাহ। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা টিকা পাওয়ার আগেই সার্ভারে আপডেট করে দিয়েছিল যে, প্রথম ডোজ সম্পন্ন হয়েছে। তারপর নাম ডেকে ডেকে একসঙ্গে বেশ কয়েকজনকে রুমে ঢুকিয়ে টেবিল দেখিয়ে দেয়।’

ফারহানা বলেন, “আমার সঙ্গে এক নারী ছিলেন, তিনি রুমে ঢোকার পর বলছিলেন, ‘আমি একটু পরামর্শ করতে যাব, বাইরে আমার লোক আছে।’ তখন স্বেচ্ছাসেবক ওনাকে বলেছেন, ‘আপনি চাইলে যেতে পারেন, কিন্তু টিকা আর পাবেন না, কারণ আপনার ডেটা সার্ভারে অলরেডি আপডেট করা হয়েছে।’

এ বিষয়ে জানতে বিকেলে নিউজবাংলা ফোনে যোগাযোগ করে টিকাদান কার্যক্রমের সমন্বয়ক খোরশীদ আলমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘টিকার তাপমাত্রা জটিলতা ও প্রতিটি ভায়ালে ১০ ডোজ টিকা থাকার কারণে আগেই আমরা টিকা কার্ড সংগ্রহ করে তারপর টিকা দিই।’

এভাবে টিকা দিলে একাধিক ডোজ নেয়ার শঙ্কা থাকে কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার এখনে নার্স, চিকিৎসক ছাড়াও কিছু স্বেচ্ছাসেবী আছেন। তাদের সামনে কীভাবে একাধিকবার টিকা নেয়া সম্ভব।’

এরপর ব্যস্ততার কথা জানিয়ে ফোন কেটে দেন খোরশীদ আলম।

অন্য ওমর ফারুকের ফোন নম্বর দিল কর্তৃপক্ষ

বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে গত সোমবার টিকা নেয়া ব্যক্তিদের বিষয়ে তথ্য চাইলে তারা জানায়, সেদিন যারা টিকা নিয়েছেন তাদের মধ্যে চারজনের নাম ওমর ফারুক।

এর মধ্যে একজনের মোবাইল ফোন নম্বর দিয়ে তার সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শও দেন তারা। তবে ওই নম্বরে যোগাযোগ করা হলে ফোন রিসিভ করে একজন দাবি করেন, টিভিতে যিনি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, তিনি ওই ওমর ফারুক নন। তার নামের আরও মানুষ থাকতে পারে।

তিনি বলেন, ‘আপনাদের হয়তো ভুল হচ্ছে, ওই ব্যক্তি আমি নই। আমি এ বিষয়ে নিয়ে কিছুই জানি না। আমি সৌদিতে ছিলাম, এখন বাসায় আছি। আপনারা যার ভিডিও দেখছেন, তার মুখে দাড়ি ছিল। আমার মুখে দাড়ি নেই। আমি এক ডোজ টিকা দিয়েছি। আমার সঙ্গে কোনো সাংবাদিকের যোগাযোগ হয় নাই।’

টেলিভিশনে কথা বলা ওমর ফারুক তার বাড়ি নারায়ণগঞ্জে জানালেও বিএসএমএমইউর সরবরাহ করা ফোন নম্বরের ওমর ফারুকের বাসা ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে। তবে তার টিকা কার্ডে ঠিকানা পল্টন উল্লেখ করা হয়েছে।

এ বিষয়ে আবারও বিএসএমএমইউতে যোগাযোগ করা হলে তারা কোনো ব্যাখ্যা না দিয়েই ফোন কেটে দেয়।

নারায়ণগঞ্জের ওমর ফারুককে তুলে আনার অভিযোগ

নিউজবাংলার অনুসন্ধানের একপর্যায়ে জানা যায়, টেলিভিশনে কথা বলেছেন যে ওমর ফারুক, তার বাড়ি নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার ভূঁইঘরে।

ওই ঠিকানায় যোগাযোগ করা হলে ফারুকের বাবা জামাল হোসেন প্রধান অভিযোগ করেন, তার ছেলেকে বুধবার সকালের দিকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে বিএসএমএমইউতে ভর্তি করা হয়েছে।

ওমর ফারুক নিখোঁজের খবরে তার বাড়িতে ভিড় করেন প্রতিবেশীরা

তিনি সন্ধ্যায় মোবাইল ফোনে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমার ছেলে ওমর ফরুক সোমবার টিকার ডোজ দিয়ে আসছে। আজ বেলা সাড়ে ১১টার সময় দুইটা গাড়ি আমার বাড়িতে আসে। তাতে ১০ থেকে ১৫ জন লোক ছিল। তাদের কাছে আমার ছেলেকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন জানতে চাইলে তারা বলেন, আমরা পিজি হাসপাতাল থেকে এসেছি। ওনাকে পিজিতে নিয়ে যেতে হবে। এরপর নিয়ে চলে যায়।’

তিনি ক্ষোভের স্বরে বলেন, ‘আপনি সাংবাদিক হয়ে থাকলে পিজি হাসপাতালের ভিসিকে ফোন করেন। আমার ছেলে ৭টার সময় ফোন করে আমার সঙ্গে কথা বলেছে। সে বলছে, আমি পিজি হাসপাতালে আছি। এখানে আমার একটা টেস্ট করা হবে। তাই আমাকে পিজি হাসপাতালে থাকতে হবে। তুমি চিন্তা করো না।’

তবে জামাল হোসেনের দাবি অস্বীকার করেছে বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষ। ওমর ফারুক কোথায় আছেন, জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মিডিয়া কো-অর্ডিনেটর সুব্রত বিশ্বাস নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আপনি এমনভাবে বলছেন যেন আপনি জানেন, তিনি আমাদের হাসপাতালেই আছেন। সাংবাদিকদের মতো আমরাও ওমর ফারুককে খুঁজছি। আপনার কাছে যদি ওনার বাবার নম্বর থাকে, তাহলে আমাদের দেন, আমরা ওনাদের সঙ্গে যোগাযোগ করব।’

তিনি বলেন, ‘এই নিউজটা ভুয়া। আমরা সোমবার যাদের টিকা দিয়েছি তার মধ্যে চারজন ওমর ফারুক রয়েছেন। তাদের সবার সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করেছি। তাদের কেউই তিন ডোজ টিকা দেননি। আর কাউকে বাড়ি থেকে তুলে আনা হয়নি।’

যা বলছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমআইএস পরিচালক মিজানুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এ ঘটনা যেখানে ঘটেছে তারা বিষয়টি তদন্ত করবে।’

এমআইএসের পক্ষ থেকে কোনো তদন্ত করা হবে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক যদি এ বিষয়ে তদন্ত করতে বলে অবশ্যই করব। কারণ এটা না করলে টিকাদান কর্মকাণ্ড প্রশ্নবিদ্ধ হবে।’

বিষয়টি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলমের বক্তব্যও জানার চেষ্টা করেছে নিউজবাংলা। তবে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

এ বিভাগের আরো খবর