চট্টগ্রামের ফরেস্ট্রি সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ইনস্টিটিউট (এফএসটিআই) থেকে চার বছরের ডিপ্লোমা ইন ফরেস্ট্রি কোর্স করেও বেকার বসে আছেন নারী শিক্ষার্থীরা। তাদের অভিযোগ, ফরেস্টার পদের নিয়োগবিধিতে থাকা উচ্চতা ও বুকের মাপের শর্তের কারণেই চাকরির আবেদন করতে পারছেন না তারা, যেখানে কোর্সে ভর্তির সময় শারীরিক যোগ্যতার কোনো শর্তই ছিল না।
এসব শিক্ষার্থী বলছেন, ২০১৯ সালে প্রকাশিত বন অধিদপ্তরের কর্মচারী নিয়োগ বিধিমালায় নারীদের প্রসঙ্গই নেই। এতে শারীরিক যোগত্যার যেসব শর্ত দেয়া হয়েছে, তার সবই পুরুষ প্রার্থীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। অথচ নারীর ক্ষমতায়নের পাশাপাশি দেশের বনাঞ্চল রক্ষায় নারীদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার জন্যই প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশক্রমে এখানে নারী শিক্ষার্থীদের ভর্তি করা হয়।
এমন পরিস্থিতিতে ফরেস্টার পদে নিয়োগের জন্য নারী শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে শারীরিক যোগ্যতা শিথিল করতে বাংলাদেশের প্রধান বন সংরক্ষক বরাবর ২০২০ সালের নভেম্বরে একবার লিখিত আবেদন জানান। তারপর আরও একবার একই আবেদন জানিয়েও কোনো লাভ হয়নি।
তাদের এসব অভিযোগের বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেছে নিউজবাংলা। তারা বলছেন, এফএসটিআইয়ের নারী শিক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করে নিয়োগবিধি পরিবর্তনের প্রস্তাব নিয়ে কাজ চলছে। বর্তমানে পুলিশের নারী কনস্টেবলদের যে শারীরিক যোগ্যতার কথা উল্লেখ আছে, সেভাবেই তাদের বিষয়ে উল্লেখ থাকবে। তবে মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, এতে নারীর অধিকার ও ক্ষমতায়ন বাধাগ্রস্ত হবে।
বন, পরিবেশ, বন্য প্রাণী ও জীববৈচিত্র্য, বন ব্যবহার, সামাজিক বনায়ন, জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে শিক্ষা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে ১৯৯৪ সালে চট্টগ্রাম নগরীর পূর্ব নাছিরাবাদ এলাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় এফএসটিআই। এখানে চার বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা ইন ফরেস্ট্রি কোর্সে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ছাত্রছাত্রীদের ভর্তি করা হয় মেধাতালিকার ভিত্তিতে। এ ক্ষেত্রে শারীরিক উচ্চতা বা বুকের মাপ নিয়ে কোনো শর্ত নেই।
এফএসটিআইতে শিক্ষার্থীদের যথাযথ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বন ও পরিবেশ-সম্পর্কিত জ্ঞানে পারদর্শী করা হয়। বনবিদ্যায় ডিপ্লোমাধারী এসব শিক্ষার্থীই প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে ফরেস্টার হিসেবে যোগদান করতে পারেন। বাংলাদেশে বর্তমানে ১০ হাজার ডিপ্লোমা ইন ফরেস্ট্রি জ্ঞানলব্ধ মানবসম্পদের প্রয়োজন। সম্পূর্ণ আবাসিক এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের আওতাধীন এবং বন অধিদপ্তর কর্তৃক পরিচালিত হয়।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এফএসটিআইতে ডিপ্লোমা ইন ফরেস্ট্রি কোর্সে ২১তম ব্যাচ পর্যন্ত শুধু ছাত্ররাই ছিলেন। ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষ থেকে ছাত্রীরা এই কোর্স করতে পারছেন। প্রতিষ্ঠানের ২২তম ব্যাচের ওই শিক্ষার্থীদের মধ্যে আট ছাত্রী কোর্সটি সম্পন্ন করেছেন।
নিউজবাংলাকে এসব নারী শিক্ষার্থী অভিযোগ করে জানিয়েছেন, কোর্স শেষে চাকরির দরখাস্ত করতে গিয়ে দেখা যায়, তাদের কোনো কথাই নেই নিয়োগবিধিতে। শারীরিক যে যোগ্যতার কথা বলা হয়েছে, তা আসলে পুরুষদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। যে কারণে শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকলেও ফরেস্টার পদে চাকরির আবেদনই করতে পারছেন না তারা। ভবিষ্যৎ নিয়ে আছেন চরম অনিশ্চয়তায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এফএসটিআইয়ের এক শিক্ষক নিউজবাংলাকে জানিয়েছেন, চার বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা ইন ফরেস্ট্রি কোর্সের প্রতিটি ব্যাচে আসনসংখ্যা ৫০। প্রতিবছরই ছাত্রীরা ভর্তি হন। তবে বন অধিদপ্তরের নিয়োগবিধির কারণে কোর্স শেষ করছেন না বেশির ভাগ। বর্তমানে বিভিন্ন ব্যাচে ছাত্রী রয়েছেন মাত্র ১২ জন।
তিনি বলেন, ‘এই প্রতিষ্ঠানে নারী শিক্ষার্থী ভর্তি শুরুর পর থেকেই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বন অধিদপ্তরের নিয়োগবিধি পরিবর্তনের কথা বলে আসছি। কিন্তু তারা আমলে নেয়নি। তবে সম্প্রতি জানতে পেরেছি, মেয়েদের কথা চিন্তা করে নিয়োগবিধি সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
‘কিন্তু সেখানেও পুলিশের নারী কনস্টেবলের শারীরিক যোগ্যতার মতো শর্ত আরোপ করা হচ্ছে। এটা সত্য হলে পাস করে যাওয়া একটি মেয়েও চাকরি পাবেন না। তাই পুলিশের নারী কনস্টেবলের সঙ্গে নারী ফরেস্টারদের শারীরিক যোগ্যতার মাপকাঠি কোনোভাবেই কাম্য নয়।’
এফএসটিআইয়ের এসব নারী শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা নিউজবাংলাকে অভিযোগ করে জানান, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন সময়ে নারী শিক্ষার্থীদের উৎসাহ দিয়ে ফরেস্টার পদে তাদের নিয়োগ সহজ করার আশা দিয়েছে। তবে তারা ডিপ্লোমা শেষ করার পর যে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়, তাতে নারীদের বিষয় উল্লেখই করা হয়নি।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, নিয়োগ বিধিমালায় ফরেস্টার পদে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে শুধু পুরুষ প্রার্থীদের জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতা ও শারীরিক যোগ্যতা (উচ্চতা ১৬৩ সেন্টিমিটার ও বুকের মাপ ৭৬ সেন্টিমিটার) নির্ধারণ করা হয়েছে। উচ্চতা ও বুকের মাপের এ শর্তের কারণে আদিবাসী নারীসহ কোনো নারীই আবেদন করতে পারবেন না।
কোর্স সম্পন্ন করা এক নারী শিক্ষার্থী ক্ষোভ প্রকাশ করে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা চার বছর ধরে বনবিদ্যায় ডিপ্লোমা করেছি কি পুলিশের কনস্টেবল নিয়োগের মতো শর্তে চাকরি করার জন্য? আমি যখন ভর্তি হয়, তখন তো শারীরিক যোগত্যার কোনো কথা বলা হয়নি।
‘কোর্স শেষে এখন দেখছি চাকরির জন্য পুলিশের মতো শারীরিক গঠন লাগবে। কৃষি ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরেও ডিপ্লোমাধারী নারীরা মেধার ভিত্তিতে চাকরি করছেন। তাদের ক্ষেত্রে তো পুলিশের মতো শারীরিক যোগ্যতা লাগছে না। আমাদের ক্ষেত্রে কেন লাগবে?’
তিনি বলেন, ‘অনেক স্বপ্ন নিয়ে বাবা-মা আমাকে এখানে পড়িয়েছে। সবাই জানে আমি ফরেস্টার হব। কিন্তু পড়ালেখা শেষে দেখছি মেয়েদের ফরেস্টার হওয়ার কোনো সুযোগই নেই। এখন মনে হচ্ছে, পুরোটা সময়ই নষ্ট হয়েছে। এ নিয়ে পারিবারিক ও সামাজিকভাবে বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছি।’
এফএসটিআইয়ের এসব নারী শিক্ষার্থী যে শারীরিক যোগ্যতার ঘাটতির কারণে ফরেস্টার পদে চাকরির আবেদন করতে পারছেন না, তা নিউজবাংলার কাছে স্বীকার করেছেন প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক মোহাম্মদ আলীও।
তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশক্রমে ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষ থেকে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে দেশের একমাত্র বনবিদ্যা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ইনস্টিটিউটে নারী শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। এই শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হওয়া অনেক ছাত্রী তাদের ডিপ্লোমা শেষ করেননি। যারা ছিলেন সবার রেজাল্টই ভালো।
‘যে মেয়েটি সবচেয়ে ভালো করেছেন, তার শারীরিক উচ্চতা সবচেয়ে কম। বাকি ছাত্রীদের উচ্চতাও নিয়োগবিধির উচ্চতার চেয়ে কম। এ কারণে তারা কেউই চাকরির আবেদন করতে পারছেন না।’
ফরেস্টার পদে চাকরিতে নারীদের শারীরিক যোগ্যতা কেন গুরুত্বপূর্ণ- এমন প্রশ্নে এফএসটিআইয়ের পরিচালক বলেন, ‘আগে তো এ বিষয়ে মেয়েদের অধ্যয়নের সুযোগই ছিল না। তাই পুরুষ শিক্ষার্থীদের জন্য নিয়োগবিধি করা হয়। বিষয়টি সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। পুলিশের নারী কনস্টেবলদের ক্ষেত্রে যেসব শর্ত আছে, এখানকার নারী শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রেও তাই করার প্রক্রিয়া চলছে।’
চাকরির নিয়োগবিধিতে শারীরিক যোগ্যতা উল্লেখ করা হলে ভর্তির সময় কেন শারীরিক যোগ্যতার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়নি- জানতে চাইলে কোনো উত্তর দেননি তিনি।
এ প্রসঙ্গে জানতে বন অধিদপ্তরের প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরীর ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার সাড়া পাওয়া যায়নি।
বন অধিদপ্তরের উপপ্রধান বন সংরক্ষক ড. মো. জগলুল হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘নারীদের কথা চিন্তা করে নিয়োগবিধি পরিবর্তনের প্রস্তাব নিয়ে কাজ চলছে। বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। আগের নিয়োগবিধিতে নারীদের বিষয়টি উল্লেখ না থাকলেও বর্তমানে নারী কনস্টেবলদের যে শারীরিক যোগ্যতার কথা উল্লেখ আছে, সেভাবেই তাদের বিষয়ে উল্লেখ থাকবে।’
প্রতিষ্ঠানে ভর্তির বিষয়ে এমন কোনো শারীরিক যোগ্যতার কথা বলা আছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করছে সরকার। তাই বলে কারও চাকরি তো নিশ্চিত করতে পারব না। ফরেস্ট্রিতে ডিপ্লোমা করে বন বিভাগেই চাকরি করতে হবে, এ কথা তো কাউকে বলা হয়নি।’
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের পরিচালক (কারিকুলাম) প্রকৌশলী ফরিদ উদ্দিন আহম্মেদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা শুধু কারিকুলাম দেখি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি বিভাগের সিলেবাস ফলো করা হয় এফএসটিআইতে। এখান থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের বন বিভাগে চাকরির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত। সে ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি হলে সেটা কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের দেখার কথা।’
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. হেলাল উদ্দিনের অফিসের নম্বরে ফোন করলে তার ব্যক্তিগত সহকারী সাজ্জাদ হোসেন রিসিভ করেন। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘স্যার জুম মিটিংয়ে আছেন। আধা ঘণ্টা পর ফোন দেন।’
এর আধা ঘণ্টা পর একই নম্বরে ফোন করে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। পরে বিষয়টি জানিয়ে হেলাল উদ্দিনের হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পাঠিয়েও সাড়া পাওয়া যায়নি।
বিষয়টি নিয়ে নিউজবাংলা কথা বলেছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিচালক (প্রোগ্রাম) নীনা গোস্বামীর সঙ্গে। সংস্থাটি মানবাধিকার রক্ষা, লিঙ্গসমতা, সামাজিক নিরাপত্তার পাশাপাশি আইনগত সহায়তা দিয়ে থাকে।
নিউজবাংলাকে নীনা গোস্বামী বলেন, ‘নারীরা এই প্রতিষ্ঠান থেকে বের হয়ে যাতে কাঙ্ক্ষিত চাকরি পান, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সে বিষয়টি মাথায় রেখে নিয়োগবিধি প্রণয়ন করা উচিত। যাতে নারীর অধিকার ও ক্ষমতায়ন বাধাগ্রস্ত না হয়।’