দিল আফরোজ বিনতে আছির। বর্তমানে শিক্ষা ভবনের সবচেয়ে আলোচিত এই কর্মকর্তা ২৪তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে নিয়োগ পান। সমাজবিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর একটি কলেজে মাত্র ছয় মাস শিক্ষকতা করেছেন এই নারী। তারপর ২০০৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত কর্মরত আছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) প্রধান কার্যালয়ে শিক্ষা ভবনে।
এই ১৫ বছরে নানা অনিয়মে দিল আফরোজের নাম এসেছে। তারপরও মাউশির সর্বশেষ পদোন্নতির তালিকায় নাম এসেছে তার। এ কারণে বিতর্ক দেখা দেয়ায় আটকে গেছে যোগ্যদের পদোন্নতির প্রক্রিয়াও।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সরকারি কর্মকর্তাদের চাকরির ক্ষেত্রে একই স্থানে তিন বছরের বেশি সময় থাকার নিয়ম নেই। অভিযোগ রয়েছে, এই নিয়ম মানা হচ্ছে না শিক্ষা ভবনের কারও কারও ক্ষেত্রে, বিশেষ করে মাউশির পরিকল্পনা ও উন্নয়ন উইংয়ের সহকারী পরিচালক দিল আফরোজ বিনতে আছিরের ক্ষেত্রে।
তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মাউশির শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে শিক্ষা ভবনে থেকে গেছেন। পদোন্নতিও পেয়েছেন একাধিকবার। সর্বশেষ ২০১২ সালে পদোন্নতি পেয়ে তিনি হন মাউশির পরিকল্পনা ও উন্নয়ন উইংয়ের সহকারী পরিচালক। সেই থেকে তিনি এই ‘লাভজনক’ পদেই আছেন।
সব মিলিয়ে এখন পুরো শিক্ষা ভবনই যেন দিল আফরোজ বিনতে আছিরের কবজায়। এই সুযোগে নানা ধরনের অনিয়মে জড়িয়েছেন তিনি, সে জন্য তার বিরুদ্ধে হয়েছে একাধিক মামলাও।
এসব অভিযোগ এবং মামলা থাকা সত্ত্বেও দিল আফরোজ বিনতে আছিরের পদোন্নতির জন্য তার নামও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে মাউশি থেকে। এ খবরে ক্ষুব্ধ পদোন্নতিবঞ্চিত হাজার হাজার শিক্ষক; সমালোচনা চলছে খোদ মাউশিতেও।
সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, ঢাকা শহরের মধ্যবর্তী এলাকায় ১০টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্পে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে বিভাগীয় মামলা চলছে দিল আফরোজ বিনতে আছিরের বিরুদ্ধে। তার বিরুদ্ধে একটি সিআর মামলা চলছে ঢাকার সিএমএম কোর্টে সহকর্মীর বেতন অন্য হিসাবে পাঠানোর এবং ওই প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগে। এ ছাড়া ১০ স্কুল প্রকল্পসহ বিভিন্ন প্রকল্পে তার বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
আইন-বিধান মোতাবেক কারও বিরুদ্ধে সিআর মামলা বা বিভাগীয় মামলা চললে তিনি পদোন্নতির জন্য বিবেচিত হবেন না। কিন্তু দিল আফরোজ বিনতে আছিরের নাম পদোন্নতির তালিকায় কীভাবে গেল, সে বিষয়েও মাউশির দায়িত্বরত কেউ মুখ খুলছেন না।
এ ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও পদোন্নতি কমিটির সদস্য ফজলুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘পদোন্নতির তো একটা বিধান আছে। তবে এ বিষয়টি এখন আমার নলেজে নেই। আপনি মাউশির মহাপরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনি ভালো বলতে পারবেন।’
নিউজবাংলা এরপর যোগাযোগের চেষ্টা করে পদোন্নতি কমিটির সদস্যসচিব ও মাউশির মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ মো. গোলাম ফারুকের সঙ্গে। গত দুই দিনে তার মোবাইল ফোনে ১৫ বার যোগাযোগের চেষ্টা করেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। প্রতিবারই সংযোগ কেটে দেন পদোন্নতি কমিটির সদস্যসচিব ও মাউশির মহাপরিচালক সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এবার যোগ্যদের মধ্য থেকে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে শিক্ষা ক্যাডারের ১ হাজার ৮০ জনকে সহকারী অধ্যাপক থেকে সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেয়া হচ্ছে। কিন্তু এর বড় একটি অংশ সহকারী অধ্যাপক হওয়ার পর এক দিনের জন্যও শ্রেণিকক্ষে ক্লাস নেননি। কিন্তু তাদের নাম এসেছে সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির তালিকায়।
প্রায় ৯ বছর ধরে মাউশির পরিকল্পনা ও উন্নয়ন উইংয়ের সহকারী পরিচালক পদে থাকা দিল আফরোজ বিনতে আছিরের বিরুদ্ধে দুটি মামলা চলার পরও পদোন্নতির জন্য তাকে ‘ফ্রেশ প্রার্থী’ হিসেবে মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানোয় যোগ্য সবার পদোন্নতি আটকে আছে। এ-সংক্রান্ত জিও জারি করতে দেরি হচ্ছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, দিল আফরোজ বিনতে আছিরের পদোন্নতির জন্য ‘বড় স্যাররা তদবির করেছেন’।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে মাউশির এক কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে জানান, প্রথমে দিল আফরোজ বিনতে আছিরের কারণে পদোন্নতির রেজল্যুশনে সই করতে অস্বীকার করেন মহাপরিচালক স্যার নিজেই। পরবর্তী সমযে কোনো না কোনো কারণে তিনি সই করেছেন।
গত ৯ মে শিক্ষা ক্যাডারের ৩ হাজার ৩০৮ জন কর্মকর্তার পদোন্নতিসংক্রান্ত সভা শুরু হয়, যা চলে সাত কর্মদিবস।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, শিক্ষা ক্যাডারের ২২তম বিসিএসের ৫৫০ জন ১২ বছর ধরে পদোন্নতি পাননি। এভাবে ২৩ ব্যাচের ১৭ জন প্রায় এক যুগ এবং ২৪ ব্যাচের ১ হাজার ৮৪৮ জন প্রায় ১০ বছর এক পদে আছেন। এ ছাড়া ২৫ ব্যাচের ১১২ জনের ও ২৬ ব্যাচের ৬৪৬ জনের পদোন্নতির যোগ্যতা থাকলেও একটি সিন্ডিকেটের বাধায় তারা বঞ্চিত বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
পদোন্নতিসংক্রান্ত ওই সভায় যোগ্যদের মূল্যায়ন করা হবে- এমন আশায় ছিলেন শিক্ষা ক্যাডারের বঞ্চিত এসব কর্মকর্তা, যা শুধু হতাশায় পরিণত হয়েছে।
একাধিক শিক্ষক ক্ষোভ প্রকাশ করে নিউজবাংলাকে বলেন, এক দিল আফরোজ বিনতে আছিরের কারণে দিনের পর দিন যোগ্যদের বঞ্চিত করার কোনো অর্থ হয় না। বিষয়টি নিয়ে সরকারের শীর্ষ মহলের হস্তক্ষেপ আশা করছেন তারা।
এ সব অভিযোগের ব্যাপারে দিল আফরোজ বিনতে আছিরের বক্তব্য জানতে তার মোবাইলে একাধিকবার ফোন করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।