বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

জয়েন্ট স্টকের ঘাটে ঘাটে ঘুষের ফাঁদ!

  •    
  • ২৮ মে, ২০২১ ২০:৩৩

দেশের যেকোনো জায়গায় যৌথ ব্যবসা বা এককভাবে বড় কোনো ব্যবসা করতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধকের (আরজেএসসি) সনদ বাধ্যতামূলক। নিউজবাংলার অনুসন্ধানে দেখা গেছে, জয়েন্ট স্টক নামে পরিচিত এই অফিস যেন এখন ভোগান্তির আরেক নাম। নতুন কোনো কোম্পানির নামের ছাড়পত্র ও নিবন্ধন সনদ নিতে ঘাটে ঘাটে দিতে হচ্ছে ঘুষ।

যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধক (আরজেএসসি) হলো বাংলাদেশ সরকারের একমাত্র অফিস, যা দেশের আইন অনুযায়ী কোম্পানি ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান গঠনের সুবিধা দেয় এবং এর মালিকানা সম্পর্কিত সব নথিপত্র সংরক্ষণ করে।

দেশের যেকোনো জায়গায় যৌথ ব্যবসা বা এককভাবে বড় কোনো ব্যবসা করতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন এই পরিদপ্তরের সনদ বাধ্যতামূলক। জয়েন্ট স্টক নামে পরিচিত এই পরিদপ্তরের প্রধান কার্যালয় রাজধানীর কারওয়ান বাজারের টিসিবি ভবনে।

নিউজবাংলার অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এই অফিস যেন এখন ভোগান্তির আরেক নাম। নতুন কোনো কোম্পানির নামের ছাড়পত্র ও নিবন্ধন সনদ নিতে ঘাটে ঘাটে দিতে হচ্ছে ঘুষ।

এই নিবন্ধন সেবা কার্যক্রম বেশ কয়েক বছর অনলাইনে শুরু করা হলেও তার সুফল মেলেনি আজও। ডিজিটাল কারসাজির মাধ্যমে ঘুষ আদায় করা হয় বলে অভিযোগ করেছেন কয়েকজন উদ্যোক্তা ও আইনজীবী। অভিযোগ আছে পুরোনো কোম্পানির নিবন্ধন নবায়নেও ভোগান্তিতে পড়ার।

অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, নতুন কোম্পানি খুলতে বা পুরোনো কোম্পানির নিবন্ধন নবায়ন করতে অনেকেই আর এই অফিসে যেতে চান না। প্রয়োজন মেটাচ্ছেন আইনজীবীদের মাধ্যমে।

তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন আরজেএসসির প্রধান। নিউজবাংলার কাছে বিরক্তি প্রকাশ করে তিনি বলেছেন, এটা আলু-পটলের ব্যবসা না। একটা অনলাইন সিস্টেমে যা যা থাকা দরকার তা তাদের ওয়েবসাইটে আছে। শুধু ‘অশিক্ষিতরাই’ এটা বুঝতে পারে না।

বেশ কয়েক মাস আগে ব্যবসা শুরু করতে সনদ নিতে আরজেএসসিতে যান ওবায়দুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি।

নিউজবাংলাকে সনদ নেয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘আমার নতুন কোম্পানির সনদ নিতে প্রথমে একাই জয়েন্ট স্টকে যাই। তারা আমাকে অনলাইনে আবেদন করতে বলে। তাদের কথামতো তাদের সাইটে ঢুকে নামের ছাড়পত্র নিতে গিয়ে দেখি প্রথমেই আমার ইউজার আইডি চাইছে। এখন নতুন মানুষ হিসেবে আমি কীভাবে বুঝব- ইউজার আইডি কীভাবে দিতে হয়?

‘পরে আরেকজনের সাহায্য নিয়ে নামের ছাড়পত্র নিই। এরপর নিবন্ধন সনদ নিতে গিয়ে দেখি অসংখ্য তথ্যের ঘর পূরণ করতে হবে। কষ্ট করে তারা যা যা চায় সেটাও পূরণ করলাম। টাকাও জমা দিলাম। কিন্তু পরে আমার সনদের আর কোনো হদিসই পেলাম না।’

ওবায়দুল ইসলাম বলেন, ‘পরে এক আইনজীবীর কাছ থেকে জানতে পারলাম অনলাইনে ফরম পূরণের ২১ দিনের মধ্যে সনদ পেয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু কোনো ভুল তথ্য দিলে সেটা ২১ দিন পর আপনা আপনি বাতিল হয়ে যাবে। আমারটাও বাতিল হয়ে যায়। এই ভুলের জন্য পরে আইনজীবীর মাধ্যমে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পুনরায় আবেদন করে সনদ পেয়েছি।’

নিউজবাংলার কাছে প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, ‘অনলাইনে ফরম পূরণ করলে আমার ভুল ধরিয়ে দেবে কে? একজন নতুন মানুষ কীভাবে বুঝবে কোনটা ভুল আর কোনটা সঠিক।’

আরজেএসসিতে বিভিন্ন কোম্পানির সনদ নিতে সাহায্য করেন এমন এক আইনজীবী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘অনলাইনে সনদ নেয়ার এমন একটা প্রক্রিয়া এখানে সৃষ্টি করা হয়েছে, যাতে নতুন কোনো সাধারণ মানুষ এটা না করতে পারেন। করলেও সবাই যেন ভুল করে- এটা তাদের জানা।

‘সবাই যেন আমাদের মতো আইনজীবীর মাধ্যমে করে সেই ব্যবস্থাই করা আছে। কারণ আইনজীবীরা সবাই কর্মকর্তাদের পরিচিত, তাই তাদের কাছ থেকে ঘুষ নিতে তাদের কোনো সমস্যা হয় না। আমরাও রুটিরুজির জন্য কর্মকর্তাদের নিয়মিত ঘুষ দিয়ে কাজ করি।’

তিনি বলেন, অনলাইনে কোনো ভুল তথ্য রেকর্ড করা হলে তা সংশোধনের জন্য আবেদনকারীদের জানানোর কথা থাকলেও কর্মকর্তারা সেটা জানান না। তাই তারা বাধ্য হয়ে নিজেরাই ২১ দিনের মধ্যে কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন। তখনই শুরু হয় ঘুষ লেনদেনের ঘটনা।

কারণ ২১ দিনের মধ্যেই ভুল সংশোধন করে সনদ পেতে হবে। ওই সংশোধন না করলে সনদ তো মিলবেই না, জমা দেয়া অর্থও ফেরত পাওয়া যাবে না। আর এই সুযোগটাই নেন অসাধু কর্মকর্তারা।

‘তাছাড়া সব সঠিক তথ্য দিলেও লাভ হয় না। ওখানকার সিন্ডিকেট টালবাহানা করতে থাকে। ফরমে সঠিক তথ্য থাকলেও তথ্যের ঘাটতি বা ভুল দেখায়। এসব অজুহাত দেখিয়ে ঘুষ দাবি করে আবেদনকারীর কাছে। না দিলে অনলাইনে এই সনদ আর পাওয়া যায় না।’

এই আইনজীবী জানান, এখানে নতুন কোম্পানির সনদ নিতে আসা ব্যক্তিদের দুই ধরনের কর্মকর্তাদের ঘুষ দিতে হয়। প্রথমে ঘুষ দিতে হয় অথরিটি কর্মকর্তাকে, যিনি কোম্পানির নামের প্রথম অক্ষর অনুযায়ী যাচাই-বাছাই করে থাকেন। আরজেএসসিতে এই রকম ১০ জন আছেন। এরা সবাই কমবেশি টাকার বিনিময়ে সনদ যাচাই-বাছাই করে থাকেন। টাকা না দিলে সনদ পাওয়া যায় না।

এই ১০ জনের মধ্যে কম্পিউটার অপারেটর মো. তাজুল ইসলাম, মো. জালাল উদ্দিন খান, শারমিন আক্তার, তাজমিন নাহার ও সঞ্জীব সরকার অন্যতম। এরা সবাই উচ্চমান সহকারী পদে কর্মরত। সাধারণ মানুষ সনদ নিতে গেলে এদের দুই-আড়াই হাজার টাকা দেয়া লাগেই। আর আইনজীবীরা গেলে এক হাজার টাকা দিলেই হয়।

এই আইনজীবী আরও জানান, এই অথরিটি কর্মকর্তাদের যাচাই-বাছাইয়ের পর ফাইল যায় সহকারী নিবন্ধকদের কাছে। তারাও টাকা ছাড়া ফাইল ছাড়েন না।

আরজেএসসিতে সহকারী নিবন্ধক পদে আছেন তিনজন। এর মধ্যে মো. সিরাজ উদ্দিন ও মো. শরিফুল ইসলাম এই ঘুষ সিন্ডিকেটের অন্যতম। এই সিরাজ গত বছর ঘুষের টাকাসহ হাতেনাতে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কর্মকর্তাদের কাছে ধরাও খেয়েছিলেন।

সে সময় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ায় মুচলেকা দিয়ে কোনো রকমে পার পেয়ে যান বলে জানান আরজেএসসি-সংশ্লিষ্ট এই আইনজীবী।

তিনি বলেন, ‘সাধারণ মানুষ এই সনদ নিতে গেলে এই তিন সহকারী নিবন্ধককে দিতে হয় তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা। আর আমাদের দিতে হয় দুই হাজার টাকা।

‘সব মিলিয়ে একজন সাধারণ মানুষ সনদ নিতে গেলে তাকে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হবে। আর আমাদের মতো আইনজীবী দিয়ে সনদ নিতে গেলেও দুই থেকে তিন হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়।’

তিনি জানান, পুরোনো কোম্পানির নিবন্ধন নবায়ন, মালিকানা পরিবর্তনসহ নানা ধরনের ছাড়পত্রের জন্য যেতে হয় সহকারী নিবন্ধকের চেয়ে বড় কর্মকর্তাদের কাছে।

ওই আইনজীবী বলেন, ‘এসব ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বেশি ঘুষ আদায় করেন বার্ষিক রিটার্ন ফাইলিং, কোম্পানির পরিচালক পরিবর্তনসহ সংশ্লিষ্ট সব নথির অবিকল নকল কপি সরবরাহসহ নানা ধরনের সেবার ছাড়পত্র দেয়ার নামে।’

তিনি জানান, নতুন কোম্পানি খোলার নিবন্ধন ও পুরোনো কোম্পানির নিবন্ধন নবায়নসহ এসব কাজ ঘুষ ছাড়া করা যায় না। এটাই এখানকার নিয়মে পরিণত হয়েছে।

এসব বিষয়ে নিউজবাংলার সঙ্গে কথা হয় রুবেল হোসেন নামে আরেক আইনজীবীর সঙ্গে, যিনি নিয়মিত আরজেএসসি থেকে সাধারণ মানুষকে সনদ নেয়ার কাজে সাহায্য করেন।

এখানে অবৈধ লেনদেন হয় কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এখানে ঘুষ বাণিজ্যের বিষয়ে আমি কিছু জানি না। তবে নানা ধরনের সমস্যা আমাদের মোকাবিলা করতে হয়। এখানে কাজের তুলনায় লোকবল অনেক কম, যার কারণে ফাইলের জট লেগেই থাকে। মানুষও হয়রানির শিকার হয়।

‘তাছাড়া হাই ম্যানেজমেন্টের তদারকির অভাব আছে, যার কারণে অনেক কর্মকর্তাই সময়মতো কাজ করেন না। পাবলিক রিলেশনেরও অভাব আছে এই অফিসে। সাধারণ মানুষ জানে না এই অফিসে কীভাবে কী করতে হয়। কর্তৃপক্ষ এগুলোর সমাধান করতে পারলে আমাদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও উপকৃত হবে বলে আমি মনে করি।’

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঘুষের টাকাসহ দুদক কর্মকর্তাদের হাতেনাতে ধরা পড়া সহকারী নিবন্ধক সিরাজ উদ্দিন এখনো বহাল তবিয়তে আরজেএসসিতে রয়েছেন। অভিযোগ আছে, তিনি এখনো অবৈধ লেনদেন চালিয়ে যাচ্ছেন।

এ অভিযোগের বিষয়ে জানতে সহকারী নিবন্ধক সিরাজ উদ্দিনের মোবাইলে বেশ কয়েকবার ফোন দিলেও তিনি সাড়া দেননি।

সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে নিউজবাংলা কথা বলেছে আরজেএসসির নিবন্ধক মো. মকবুল হোসেনের সঙ্গে।

অনলাইনে নিবন্ধন নিয়ে সাধারণ মানুষের ভোগান্তির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা কোনো আলু-পটলের ব্যবসা না। ব্যবসা করতে হলে আমাদের এই সিস্টেম বুঝতে হবে। একটা অনলাইন সিস্টেমে যা যা থাকা দরকার আমাদের ওয়েবসাইটে তার সবই আছে। যারা এটা বোঝে না বলে তারা নিজেরাই দুর্বোধ্য। তারা অশিক্ষিত, লেখাপড়া জানে না।’

সহকারী নিবন্ধক সিরাজ উদ্দিনের দুদকের হাতে ধরা পড়ার পরও কীভাবে এখনো বহাল আছেন জানতে চাইলে আরজেএসসি প্রধান বলেন, ‘তাকে যে সময় দুদক ধরেছিল সে সময় আমি এখানে ছিলাম না। আর এটা দুদকের বিষয়, তাই এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না।’

সনদ পেতে ঘাটে ঘাটে ঘুষ লাগার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বিরক্তি প্রকাশ করে নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আপনি কি এইসব বিষয় শোনার জন্য আমাকে মোবাইল করছেন? এইভাবে কি কেউ কাউকে ইন্টারভিউ নেয়?’

এর এক পর্যায়ে স্যরি, স্যরি বলে মোবাইল ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন আরজেএসসির নিবন্ধক মকবুল।

এ বিভাগের আরো খবর