সড়ক পরিষ্কার ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার নামে অস্বাভাবিক দামে পাঁচ ধরনের যান-যন্ত্রপাতি কিনছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। ইতোমধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ প্রকল্পটির দুটি প্যাকেজের মধ্যে একটির কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে। আরেকটি প্যাকেজের কার্যাদেশ দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে।
‘আধুনিক যান-যন্ত্রপাতি সংগ্রহের মাধ্যমে সড়ক পরিষ্কার ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কাজের উন্নয়ন’ নামের এ প্রকল্পটির মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৯ কোটি ১৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে যার প্রায় সব টাকাই বিভিন্ন যন্ত্রপাতি কেনায় খরচ হবে।
এগুলো হচ্ছে তিনটি মেকানিক্যাল রোড সুইপার, দুটি সোয়াম্প টাইপ চেইন ডোজার, দুটি বেকহো লোডার, ১১টি কম্পেক্টর ট্রাক ও দুটি মোটরসাইকেল।
এসব যন্ত্রপাতি ও যানবাহনের মধ্যে একটি মেকানিক্যাল রোড সুইপারের দাম ৬ কোটি ২৫ লাখ টাকা, একটি সোয়াম্প টাইপ চেইন ডোজারের দাম ৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা, একটি বেকহো লোডারের দাম ২ কোটি ও একটি কম্পেক্টর ট্রাকের দাম ১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ধরা হয়েছে।
তবে নিউজবাংলার অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রকল্পে উল্লিখিত যান-যন্ত্রপাতির দাম প্রকৃত বাজার মূল্যের দুই থেকে ছয় গুণ বেশি ধরা হয়েছে। এত দাম দিয়ে এসব যন্ত্রপাতির কেনার তথ্যে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন আমদানি সংশ্লিষ্ট একাধিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা।
‘আধুনিক যান-যন্ত্রপাতি সংগ্রহের মাধ্যমে সড়ক পরিষ্কার ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কাজের উন্নয়ন’ নামের প্রকল্পটিতে ব্যয় হবে ৪৯ কোটি ১৪ লাখ টাকা
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, ‘আধুনিক যান-যন্ত্রপাতি সংগ্রহের মাধ্যমে সড়ক পরিষ্কার ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কাজের উন্নয়ন’ প্রকল্পটির প্রথম দফায় মেয়াদ ছিল ২০১৯ সালের অক্টোবর থেকে ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। তবে ওই মেয়াদে প্রকল্পের কোনো কাজই শুরু করতে পারেনি ডিএনসিসি।
এরপর নতুন করে মেয়াদ ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়াতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছেন প্রকল্পটির পরিচালক ও ডিএনসিসির অতিরিক্ত প্রধান বর্জ্য ব্যাবস্থাপনা কর্মকর্তা এস এম শফিকুর রহমান। বিষয়টি এখনও প্রক্রিয়াধীন।
নিউজবাংলার হাতে আসা প্রকল্পের নথি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, তিনটি মেকানিক্যাল রোড সুইপার মেশিনের মোট দাম ধরা হয়েছে ১৮ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। অর্থাৎ একটি মেকানিক্যাল রোড সুইপারের দাম ৬ কোটি ২৫ লাখ টাকা। প্রতিটি সোয়াম্প টাইপ চেইন ডোজারের দাম ৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা ধরা হয়েছে। সে হিসাবে দুটির দাম পড়বে ৭ কোটি টাকা। দুটি বেকহো-লোডারের দাম ধরা হয়েছে ৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ একেকটির দাম ২ কোটি টাকা।
প্রকল্প পরিচালক ও ডিএনসিসির অতিরিক্ত প্রধান বর্জ্য ব্যাবস্থাপনা কর্মকর্তা এস এম শফিকুর রহমান। ছবি: নিউজবাংলা
প্রকল্পে ১১টি কম্পেক্টর ট্রাকের দাম ধরা হয়েছে ১৯ কোটি ২৫ লাখ টাকা। এতে প্রতিটির দাম পড়বে ১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। এ ছাড়া অন্যান্য ব্যয়ের মধ্যে আছে দুটি মোটরসাইকেল বাবদ ৪ লাখ টাকা, প্রচার ও বিজ্ঞাপন বাবদ ৫ লাখ টাকা, আপ্যায়ন বাবদ ২ লাখ টাকা ও সম্মানী বাবদ ৩ লাখ টাকা।
এ ধরনের যান-যন্ত্রপাতি আমদানিকারক একাধিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলেছে নিউজবাংলা। তারা সবাই বলেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে সবচেয়ে ভালো ও উন্নতমানের যান-যন্ত্রপাতির দামের চেয়ে অনেক বেশি ব্যয় দেখানো হয়েছে এই প্রকল্পে।
নির্মাণ প্রতিষ্ঠান মনিকো লিমিটেড এ ধরনের কিছু যন্ত্রপাতি আমদানি করে। প্রতিষ্ঠানের প্রধান মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার মো. মজিবুর রহমান নিজেদের অভিজ্ঞতা ও অনলাইনে বর্তমান আন্তর্জাতিক বাজারের দর ঘেঁটে দেখে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ইউরোপের বিভিন্ন দেশে তৈরি সবচেয়ে ভালো মানের যন্ত্রপাতির সর্বোচ্চ মূল্য বিবেচনায় নিলেও তা প্রকল্পের উল্লিখিত দামের ধারে কাছে নেই।’
এ ধরনের বেকহো-লোডার আনতে খরচ হবে ২ কোটি টাকা
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে মূলত এসব যানবাহন ও যন্ত্রপাতি ইউরোপ থেকে এখন আর খুব একটা আসে না। কারণ ইউরোপের যান ও সরঞ্জাম বাংলাদেশের আবহাওয়ার বেশিদিন টেকে না। তাই আমরা এখন ভারত, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান থেকে এগুলো বেশি এনে থাকি।’
একটি সোয়াম্প টাইপ চেইন ডোজারের দাম সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ইউরোপের তৈরি ১৬ টনের একটি চেইন ডোজারের দাম পড়ে ১ কোটি ২০ লাখ টাকা আর ২২ টনের দাম পড়বে ২ কোটি টাকা। আর ১৬ টনের একটি চাইনিজ ডোজারের দাম ৮০ লাখ টাকা। ২২ টনের চাইনিজ ডোজারের দাম ১ কোটি ২০ লাখ টাকা।’
অথচ ডিএনসিসির প্রকল্পে প্রতিটি সোয়াম্প টাইপ চেইন ডোজারের দাম ৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা ধরা হয়েছে।
প্রকল্পে ১১টি কম্পেক্টর ট্রাকের দাম ধরা হয়েছে ১৯ কোটি ২৫ লাখ টাকা
একটি বেকহো-লোডারের দাম সম্পর্কে মুজিবুর রহমান বলেন, ‘সবচেয়ে ভালো মানে একটি চাইনিজ বেকহো-লোডারের দাম ৪৩ লাখ টাকা, আর ইউরোপের তৈরি বেকহো-লোডারের দাম পড়বে ৮৫ লাখ টাকা।’
উত্তর ঢাকায় নেয়া প্রকল্পে প্রতিটি বেকহো-লোডারের দাম ধরা হয়েছে ২ কোটি টাকা।
ভালো মানের মেকানিক্যাল রোড সুইপার ও কম্পেক্টর ট্রাকের দাম কত হতে পারে সে প্রশ্ন রাখা হয়েছিল মুজিবুর রহমানের কাছে। জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা এ সব যান-যন্ত্রপাতি আমদানি করি না। ’
তবে অনলাইন ঘেঁটে তিনি বলেন, ‘একটি ভালো ইউরোপীয় মেকানিক্যাল রোড সুইপার দাম ভ্যাট-ট্যাক্সসহ ৮০ লাখ টাকা পড়বে। আর সেই একই রোড সুইপার ভারত-চীন থেকে আনা হলে দাম পড়বে ৩৫ লাখের মতো।’
‘আর বর্জ্য স্থানান্তরের জন্য পাঁচ টনের ইউরোপীয় কম্পেক্টর ট্রাকের দাম ভ্যাট-ট্যাক্সসহ ৭০ লাখ টাকার নিচে হবে, আর চাইনিজ হলে দাম ৩৫ লাখের মধ্যে হবে।’
ডিএনসিসিতে আনা হচ্ছে দুটি সোয়াম্প টাইপ চেইন ডোজার
ডিএনসিসির প্রকল্পের নথি বলছে, তারা প্রতিটি মেকানিক্যাল রোড সুইপার ৬ কোটি ২৫ লাখ টাকায় কিনছে। আর কম্পেক্টর ট্রাকের প্রতিটির দাম পড়বে ১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। অর্থাৎ বাজারমূল্যের কয়েকগুণ বেশি দাম দেখানো হয়েছে প্রতিটি ক্ষেত্রে।
গত বছর (২০২০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর) স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০টি রোড সুইপার ইতালি থেকে আমদানি করে দেশের ১২টি সিটি করপোরেশনে বণ্টন করেছে। এজন্য প্রতিটিতে ব্যয় হয়েছে দেড় কোটি টাকা। তার আগে ২০১৮ সালে ডিএনসিসি ৫ কোটি টাকায় একটি মেকানিক্যাল রোড সুইপার কিনেছিল। তবে এবারের প্রকল্পে সেই রোড সুইপার কিনতেই ৬ কোটি ২৫ লাখ টাকা দেখানো হচ্ছে।
প্রকল্পের বিষয়ে জানতে প্রকল্প পরিচালক ও ডিএনসিসির অতিরিক্ত প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা এস এম শফিকুর রহমানের সঙ্গে কথা বলেছে নিউজবাংলা। তিনি বলেন, ‘করোনা শুরু হওয়ায় আমরা নির্ধারিত সময়ে কাজ শুরু করতে পারি নাই। তাই সময় বাড়িয়ে মেয়াদ ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত করতে মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়েছে।’
প্রকল্পের একটি প্যাকেজের কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে, আর একটির কার্যাদেশ দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে বলেও জানান তিনি।
প্রতিটি মেকানিক্যাল রোড সুইপারের দাম ধরা হয়েছে ৬ কোটি ২৫ লাখ টাকা
যান-যন্ত্রপাতির অস্বাভাবিক দামের কারণ জানতে চাইলেই উত্তেজিত হয়ে ওঠেন শফিকুর রহমান। এবার তিনি বলেন, ‘আমি অনলাইন পত্রিকায় কোনো বক্তব্য দেই না। আপনার যা জানা দরকার, জনসংযোগ কর্মকর্তা অথবা মেয়রের সঙ্গে কথা বলেন।’
এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা সব সময় বেস্ট জিনিসটা নিতে চাই, সড়ক বাতির সময়ও আমরা ইউরোপ থেকে সব চেয়ে ভালোটা এনেছিলাম। ’
ইউরোপের যন্ত্রপাতিও এত উচ্চমূল্যের নয় জানালে মেয়র বলেন, ‘ধরেন, একটা মোবাইলের দাম আছে ১৬৫০ টাকা, আবার আরেকটা মোবাইল আছে ১৬ হাজার ৫০ টাকা, আবার আরেকটি মোবাইল আছে ২ লাখ টাকা, এ সবই কিন্তু মোবাইল। আমরা বেস্ট জিনিসটা নেব, সস্তার যেন তিন অবস্থা না হয় সেটা আমি এনশিওর করতে পারি। তাই যাচাই-বাছাই করেই জিনিস নেব আমরা।’
ডিএনসিসির এই প্রকল্পের মোট ব্যয়ের মধ্যে সরকার দিচ্ছে ৪৬ কোটি ৬৮ লাখ ৩০ হাজার টাকা, আর ডিএনসিসির নিজস্ব তহবিল থেকে খরচ হবে ২ কোটি ৪৫ লাখ ৭০ হাজার টাকা।