রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের স্টাফ কলোনির ১৭ নম্বর ভবনে থাকেন আখতার হোসাইন। রেলওয়ের কর্মচারী না হয়েও গত ১০ বছর রেলওয়ের কর্মচারীদের জন্য বরাদ্দ কোয়ার্টারই আখতারের ঠিকানা।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দেড় লাখ টাকা জমা দিয়ে বাড়ি নিয়েছি, তাছাড়া মাসে ১১ হাজার টাকা করে ভাড়া দেই।
‘যার কাছ থেকে ভাড়া নিয়েছি তিনি জানিয়েছেন, “কেউ উঠাতে পারবে না। নিশ্চিন্তে থাকতে পারবেন। কোনো সমস্যা হলে আমাকে জানাবেন, আমি তো আছি।”’
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের স্টাফ কলোনির বেশির ভাগ বাসায় এভাবেই থাকছেন বহিরাগতরা। এর মধ্যে কেউ কেউ আবার তাদের দখলে রাখা বাসা অন্যদের ভাড়া দিচ্ছেন।
রেলওয়ে বিষয়টি জানলেও কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
রেলওয়ের তথ্য অনুযায়ী, পূর্বাঞ্চলের আওতাধীন চট্টগ্রামের টাইগারপাস ও পাহাড়তলীর রেলওয়ে কলোনিতে চার ক্যাটাগরিতে মোট ৫ হাজার ৩২৯টি বাসা রয়েছে। এর মধ্যে প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তাদের জন্য ১৫৩টি, দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তাদের জন্য ২৩৭টি, তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীদের জন্য ২ হাজার ২৫৫টি ও চতুর্থ শ্রেণির জন্য ২ হাজার ৬৮৪টি বাসা রয়েছে। এর মধ্যে বেশির ভাগ বাসাতেই থাকেন না রেলের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
রেলওয়ে কোয়ার্টারের বাসা ভাড়া নিয়ে তা আবার ভাড়া দেয়া হয়। ছবি: নিউজবাংলা
নগরীর টাইগারপাসে নেভি কনভেনশন হলের পাশ দিয়ে রেলওয়ে কলোনিতে ঢুকে একটু এগুতেই চোখে পড়ে বাসা ভাড়া দেয়ার বিজ্ঞাপন।
বিজ্ঞাপনে দেয়া একটি নম্বরে বৃহস্পতিবার দুপুরে ফোন করেন নিউজবাংলার প্রতিবেদক। অপর প্রান্ত থেকে ফোন রিসিভ করেন আলমগীর মিয়া নামের এক ব্যক্তি।
তিনি জানান, তিনি রেলওয়ের স্টাফ নন। রেলের এক কর্মচারীর কাছ থেকে বাসা ভাড়া নিয়েছেন। সেই বাসা এখন আবার তিনি ভাড়া দেবেন।
টাইগারপাসের কলোনির ১৪ নম্বর ভবনের ১/বি বাসায় পাঁচ বছর ধরে পরিবার নিয়ে আছেন মোরশেদা আকতার। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বাপ্পি নমের রেলের এক কর্মচারীর কাছ থেকে বাসাটা ভাড়া নিয়েছি। পাঁচ বছর ধরে এই বাসায় আছি। এর আগেও প্রায় এক যুগের বেশি এই ভবনে ছিলাম, কোনো সমস্যা হয়নি।’
রেলের ইকরাম নামের এক কর্মচারীর কাছ থেকে মাসে ১২ হাজার করে ভাড়া নিয়ে ৩ নম্বর ভবনের তৃতীয় তলার একটি কোয়ার্টারে পরিবার নিয়ে থাকছেন সবজি ব্যবসায়ী মহিন। এর মধ্যে দুইটি কক্ষ আবার সাবলেটও দিয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘আমি রেলের কর্মচারী ইকরামের আত্মীয়। তবু কোয়ার্টারটা ভাড়া নেয়ার সময় তাকে দেড় লাখ টাকা অগ্রিম দিতে হয়েছে।
এসব বাসা ভাড়া দেয়ার সময় ভাড়াটিয়ার কাছ থেকে এককালীন দেড় থেকে দুই লাখ টাকা করে নেন রেলওয়ের কর্মচারীরা। মাসপ্রতি ভাড়া ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা।
রেলওয়ে কোয়ার্টারের বাসা ভাড়া দেয়ার এমন বিজ্ঞাপন দেখা যায় হরহামেশাই। ছবি: নিউজবাংলা
আবার কলোনির আঙিনার খালি জায়গাতেও অবৈধভাবে কাঁচা-পাকা ঘর, দোকানপাট নির্মাণ করে ভাড়া দেয়া হচ্ছে। সেখানে পানি ও বিদ্যুতের সংযোগও নেয়া হয়েছে অবৈধভাবে।
এসব ঘটনার সত্যতাও পাওয়া গেছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সমন্বিত জেলা কার্যালয়, চট্টগ্রাম-১-এর অভিযানে।
সংস্থার সহকারী পরিচালক ফখরুল ইসলামের নেতৃত্বে চার সদস্যের একটি দল ২০১৯ সালের অক্টোবর রেলের অবৈধ বাড়িওয়ালাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালায়।
ফখরুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীই বাসা বরাদ্দ নিয়ে সেই বাসা লাখ টাকা সেলামি নিয়ে ভাড়া দিচ্ছেন। অনেকেই কোয়ার্টারের খালি জায়গায় অবৈধ স্থাপনা তৈরি করে সেগুলো ভাড়া দিয়ে উপরি আয় করছেন।
‘এসব বাসায় অবৈধভাবে পানি ও বিদ্যুতের সংযোগও দেয়া হয়। এর সত্যতা আমরা পেয়েছি।’
অবৈধ জেনেও সরকারি কোয়ার্টারে বাসা ভাড়া কেন দিচ্ছেন, জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলের ৫৫ বছর বয়সী এক কর্মচারী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কোয়ার্টারে সুযোগ সুবিধা তেমন ভালো না।’
কোয়ার্টারের খোলা জায়গায় এ ধরনের ঘর তৈরি করেও দেয়া হয় ভাড়া। ছবি: নিউজবাংলা
তিনি বলেন, ‘রেলের কর্মচারীরা তাই এসব বাসায় থাকতে চান না। এ জন্য ভাড়া দিয়ে দেন। আমার পাশে অনেকে বাসা বরাদ্দ পেয়েছেন। কিন্তু বহিরাগতদের ভাড়া দিয়ে নিজেরা ভাড়া বাসায় থাকছেন।’
এ বিষয়ে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় প্রকৌশলী-২ আহসান হাবীব বলেন, ‘রেলওয়ের কর্মচারীদের জন্য বরাদ্দ বাসায় বহিরাগতদের থাকার কোনো সুযোগ নেই। ২০২০ সালে অভিযান চালিয়ে বহিরাগতদের উচ্ছেদ করা হয়েছে।
‘এরপরও কোনো কর্মচারী তার বরাদ্দপ্রাপ্ত বাসায় বহিরাগতদের ভাড়া দেয়ার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
চট্টগ্রাম-১-এর সহকারী পরিচালক ফখরুল জানান, যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী এই কাজে জড়িত তাদের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। অভিযোগটির বিস্তারিত তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সুপারিশ করা হবে।