অর্থনৈতিকসহ নানা সংকটে পড়েছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ শ্রীলঙ্কা। কোনোভাবেই মোকাবিলা করা যাচ্ছে না পরিস্থিতি। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, মূল্যস্ফীতি আর ঋণের বোঝা দেশকে করেছে অস্থিতিশীল। এ দ্বীপরাষ্ট্রের মতো বিপদে পড়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে আরও কিছু দেশেরও।
সবমিলিয়ে ডাজন খানেক দেশ একই ধরনের ভয়াবহতার মুখোমুখি হতে পারে বলে আভাস দিয়েছে সংবাদমাধ্যম রয়টার্স।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইতোমধ্যে শ্রীলঙ্কা, লেবানন, রাশিয়া, সুরিনাম এবং জিম্বাবুয়ে ঋণ খেলাপি দেশে পরিণত হয়েছে। বেলারুশ দাঁড়িয়ে আছে খাদের কিনারে। অন্য দেশগুলোর অর্থনীতিও ধসে পড়তে পারে যে কোনো সময়।
বেশ কিছু বিষয় হিসেব-নিকেশ করে বিশ্লেষকরা বলছেন, ওইসব দেশের ঋণের বোঝার পরিমাণ প্রায় ৪০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। এর সঙ্গে আছে নানা সংকটও।
এর মধ্যে আর্জেন্টিনার মাথায় আছে ১৫ হাজার কোটি মার্কিন ডলার ঋণের বোঝা। ইকুয়েডরকে চার হাজার আর সাড়ে চার হাজার কোটি মার্কিন ডলার ঋণ পরিশোধ করতে হবে মিশরকে।
অবশ্য বিশ্ববাজার শান্ত হয়ে এলে এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে সমর্থন পাওয়া গেলে দেশগুলো সংকট থেকে নিজেদের উত্তরণ করতে সম্ভব হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, আর্জেন্টিনায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ব্যাপক মাত্রায় কমে গেছে। দেশটির মুদ্রা পেসো কালোবাজারে এখন প্রায় ৫০ শতাংশ ডিসকাউন্টে লেনদেন হচ্ছে। ২০২৪ সাল পর্যন্ত চলার যথেষ্ট ঋণ নেই সরকারের কাছে।
রাশিয়ার হামলায় বিধ্বস্ত ইউরোপের দেশ ইউক্রেনকে আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে ১২০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হবে। যুদ্ধময় পরিস্থিতিতে যা অনেকটাই অসম্ভব। এ ছাড়া নানা সংকট তো রয়েছেই।
চলতি সপ্তাহে আইএমএফের সঙ্গে একটি চুক্তি করেছে পাকিস্তান। তবে সার্বিক পরিস্থিতিতে সেই চুক্তি হয়তো কাজে নাও আসতে পারে। জ্বালাানি,খাদ্যসহ নানা সংকটে পড়েছে শাহবাজ শরিফের দেশটি। ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে সংকট মোকাবিলার চেষ্টা করছে পাকিস্তানের সরকার। এরই মধ্যে রুপি দুর্বল হয়ে রেকর্ড পরিমাণে নেমে এসেছে।
প্রায় একই ধরনের সংকটে পড়েছে তিউনিসিয়া, ঘানা, মিশর, কেনিয়া, ইথিওপিয়া, বেলারুশ, নাইজেরিয়া এবং এল সালভাদোরের মতো দেশগুলো।
স্বাধীন হওয়ার ৭০ বছরের বেশি সময়ের মধ্যে গত মে মাসে প্রথমবারের মতো ঋণখেলাপি হয় সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক সংকটে পড়া শ্রীলঙ্কা। ঋণের সুদ হিসেবে আসা ৭ কোটি ৮০ লাখ ডলার পরিশোধে অতিরিক্ত ৩০ দিন পার হওয়ার ঋণখেলাপি হওয়ার ওই ঘোষণা আসে।
দেশটিতে নিত্যপণ্যের আকাশছোঁয়া দামে বিপর্যস্ত জনজীবন। মূল্যস্ফীতি, দুর্বল সরকারি অর্থব্যবস্থা এবং করোনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি এই বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ। লঙ্কান সরকারের অন্যতম রাজস্ব আয়ের খাত পর্যটনশিল্প ধসে পড়েছে, রেমিট্যান্স পৌঁছেছে তলানিতে। বিদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় বা রিজার্ভ নেমে এসেছে ২ বিলিয়ন ডলারে।
বৈদেশিক মুদ্রার অভাবে জ্বালানি আমদানি কমে যাওয়ায় স্মরণকালের ভয়াবহ সংকটে পড়া শ্রীলঙ্কায় দিনের অর্ধেক বা এর বেশি সময় চলছে লোডশেডিং; খাবার, ওষুধ ও জ্বালানিসংকটে ক্ষোভ ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে।
গত কয়েক বছর শ্রীলঙ্কার রাজনীতি বেশ টালমাটাল ছিল। এই অবস্থায় দেশটির বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ নাটকীয়ভাবে কমে এসেছে।সংকটের জন্য প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে ও তার পরিবারের সদস্যদের দুর্নীতিকে দায়ী করেন বিক্ষোভকারীরা। এমন প্রেক্ষাপটে বিক্ষোভরতদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী ও ক্ষমতাসীনদের সংঘর্ষ হয়েছে। এতে প্রাণ গেছে পুলিশ সদস্যসহ বেশ কয়েকজনের।
একপর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজপাকসেকে ক্ষমতা ছাড়তে হয়। নতুন করে এই পদে আসেন রনিল বিক্রমাসিংহে। গঠন করা হয় নতুন মন্ত্রিসভা। সর্বশেষ পদ ছেড়েছেন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া। এ পদে ভারপ্রাপ্তের দায়িত্ব নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নিজেই। তবে দেশটির সংকট কাটছেই না।
দুই কোটির বেশি জনসংখ্যার এই দেশে চলতি বছর অর্থাৎ আগামী ছয় মাস চলতে ৩ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের জ্বালানি আমদানি করতে হবে বলে জানিয়েছেন রনিল বিক্রমাসিংহে। এ ছাড়া দেশটির রান্নার গ্যাস আমদানি করতে হবে ২৫০ মিলিয়ন ডলারের।
সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বিশ্লেষকদের মত, এ দেশের পথেই হাঁটছে আরও কিছু দেশ।