ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বর্বরতা অব্যাহত রয়েছে। সেখানে ইসরায়েলের আগ্রাসন কারণে প্রায় ৩ লাখ ২০ হাজার শিশু তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে। আলজাজিরার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
আলজাজিরার প্রতিবেদন অনুযায়ী, গাজার স্বাস্থ্য বিভাগ জানিয়েছে, শনিবার বেলা তিনটা পর্যন্ত পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় গাজায় অপুষ্টিতে আরও আট শিশু মারা গেছে। ইসরায়েল হামলা শুরুর পর গত প্রায় দুই বছরে গাজায় এ নিয়ে অন্তত ২৮১ জন অপুষ্টিতে মারা গেছেন, যাদের মধ্যে শিশু ১১৪টি।
এদিকে অপুষ্টির শিকার এসব শিশুর চিকিৎসা করতে অন্তত ১০টি হাসপাতাল দরকার বলে জানিয়েছেন শহরটির আল-শিফা হাসপাতালের পরিচালক মোহাম্মদ আবু সালমিয়া ও নাসের মেডিকেল কমপ্লেক্সের শিশু হাসপাতালের পরিচালক আহমদ আল-ফারা।
আবু সালমিয়া বলেন, শিশুদের পাশাপাশি গাজার বিভিন্ন হাসপাতালে আহত হয়ে আরও যারা ভর্তি হয়েছেন, তারাও বিভিন্ন মাত্রায় অপুষ্টিতে ভুগছেন। অপুষ্টি গাজার অন্যতম প্রধান সমস্যায় পরিণত হয়েছে। এই সমস্যা কাটিয়ে উঠতে দীর্ঘ সময় লাগতে পারে। আল-ফারা বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালে ভর্তি ১২০টি শিশু তীব্র অপুষ্টির শিকার। যেসব শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে, সারা জীবন তাদের মাশুল গুনতে হবে।’
এছাড়া গত শুক্রবার দ্য ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্লাসিফিকেশন (আইপিসি) এক প্রতিবেদনে জানায়, গাজা উপত্যকার গাজা নগর প্রশাসনিক অঞ্চল ও আশপাশের এলাকায় দুর্ভিক্ষ চলছে। এতে অন্তত ৫ লাখ ১৪ হাজার গাজাবাসী দুর্ভিক্ষের কবলে পড়েছেন। বর্তমান পরিস্থিতি চলতে থাকলে আগামী মাসের শেষের দিকে উপত্যকার মধ্যাঞ্চলের প্রশাসনিক অঞ্চল দেইর আল-বালাহ ও দক্ষিণের খান ইউনিসেও দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়তে পারে।
অন্যদিকে জাতিসংঘসহ একাধিক আন্তর্জাতিক সংস্থা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশের অনুদান ও সহায়তায় পরিচালিত আইপিসির প্রতিবেদন প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে ইসরায়েল গাজায় দুর্ভিক্ষের দাবি অস্বীকার করেছে।
কিন্তু জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস আইপিসির প্রতিবেদন আমলে নিয়ে এক বিবৃতিতে গাজার দুর্ভিক্ষকে ‘মানবসৃষ্ট বিপর্যয়’ ও ‘মানবতার ব্যর্থতা’ বলে মন্তব্য করেছেন। সংস্থাটির মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক ‘গাজার দুর্ভিক্ষকে ইসরায়েল সরকারের কর্মকাণ্ডের সরাসরি ফলাফল’ বলে উল্লেখ করেছেন।
জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএর প্রধান ফিলিপ লাজারিনি বলেছেন, গাজায় নিজেরা যে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করেছে, তা অস্বীকার করা ইসরায়েলকে বন্ধ করতে হবে।
তিনি বলেন, যাদের (যেসব দেশের) প্রভাব আছে, তাদের এটাকে (আইপিসির প্রতিবেদনকে) গুরুত্ব ও নৈতিক দায়িত্বের সঙ্গে গ্রহণ করা উচিত। জাতিসংঘের মানবিক কার্যক্রম বিভাগের অতিরিক্ত মহাসচিব টম ফ্লেচারের বিবৃতি ধরে তিনি এই প্রতিক্রিয়া জানান।
আইপিসির প্রতিবেদনের প্রতিক্রিয়ায় টম ফ্লেচার বলেন, ‘এ দুর্ভিক্ষ পুরোপুরি ঠেকানো যেত। কিন্তু ইসরায়েলের পরিকল্পিত বাধায় গাজায় খাদ্য ঢুকতে পারছে না। তাই দুর্ভিক্ষ তৈরি হয়েছে।’
মিসর সীমান্তে ত্রাণভর্তি হাজারো ট্রাক কয়েক মাস ধরে গাজায় ঢোকার অপেক্ষায় রয়েছে। কিন্তু গত মার্চ থেকে ইসরায়েলের অবরোধের কারণে সেগুলো গাজায় প্রবেশ করতে পারছে না। মে মাসের শেষ থেকে তারা গাজায় কিছু ত্রাণবাহী ট্রাক ঢুকতে দিচ্ছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।
এদিকে ইসরায়েলের ওপর অতিরিক্ত নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার প্রস্তাবে মন্ত্রিসভার সমর্থন না পেয়ে নেদারল্যান্ডসের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কাসপার ভেল্ডক্যাম্প পদত্যাগ করেছেন। ভেল্ডক্যাম্প মধ্য ডানপন্থি নিউ সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট দলের সদস্য।
মিডল ইস্ট আই–এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজা ও পশ্চিম তীর নিয়ে ইসরায়েলপন্থি ভাষা ব্যবহার না করার অভিযোগে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এক গণমাধ্যমবিষয়ক কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়েছ। তাঁর নাম শাহেদ ঘোরেইশি। তিনি বার্তা সংস্থা এপির এক প্রশ্নের জবাবে লিখেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র গাজাবাসীদের জোরপূর্বক স্থানান্তরকে সমর্থন করে না।
ইসরায়েলি হামলায় নিহত আরও ৬৩ ফিলিস্তিনি
ইসরায়েলের অব্যাহত হামলায় গাজা উপত্যকায় অন্তত ৬৩ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। একই সঙ্গে ইসরায়েলি সেনারা গাজা নগরীর ভেতরে আরও অগ্রসর হচ্ছে, যেখানে প্রায় ১০ লাখ মানুষকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করার পরিকল্পনা করছে তারা।
ভিডিওচিত্রে দেখা গেছে, ইসরায়েলি ট্যাংক গাজা নগরীর সাবরা এলাকায় প্রবেশ করেছে। এটি ওই অঞ্চলে সেনাদের স্থল অভিযানের সম্প্রসারণের ইঙ্গিত বহন করে। সাবরা গাজা নগরীর অবরুদ্ধ জায়তুন এলাকার কাছাকাছি, যেটি গত এক সপ্তাহ ধরে ব্যাপক হামলার শিকার। আল-আহলি হাসপাতালের এক সূত্র জানিয়েছে, সর্বশেষ সাবরায় ইসরায়েলি বিমান হামলায় এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে।
এদিন সকালে খান ইউনূসের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল আসদা এলাকায় বাস্তুচ্যুত মানুষের তাঁবুতে ইসরায়েলি গোলাবর্ষণে অন্তত ১৬ জন নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে ছয়জন শিশু।
মানবিক সহায়তা নিতে গিয়ে দিনভর আরও অন্তত ২২ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। খান ইউনূসের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে খাদ্য বিতরণ কেন্দ্রের কাছে একজনকে গুলি করে হত্যা করে ইসরায়েলি সেনারা। নেতজারিম করিডরের কাছেও খাদ্যের সন্ধানে আসা এক বেসামরিক নাগরিক গুলিতে নিহত হয়েছেন।
ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় অনাহারে আরও আটজনের মৃত্যু হয়েছে, যার মধ্যে দুই শিশু রয়েছে। এ নিয়ে যুদ্ধ শুরুর পর থেকে অনাহারে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৮১ জনে। এর মধ্যে ১১৪ জনই শিশু।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক মুনির আল-বুরশ বলেছেন, ‘ক্ষুধা নিঃশব্দে মানুষের দেহকে কুরে কুরে খাচ্ছে, শিশুদের জীবন থেকে বঞ্চিত করছে এবং প্রতিদিন তাঁবু ও হাসপাতালকে শোকে ভরিয়ে তুলছে।’
জাতিসংঘ শুক্রবার আনুষ্ঠানিকভাবে গাজায় দুর্ভিক্ষ ঘোষণা করেছে—যা মধ্যপ্রাচ্যে এ ধরনের প্রথম ঘটনা। সংস্থাটি বলছে, প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ ‘বিপর্যয়কর ক্ষুধা’র মুখোমুখি। মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস একে ‘মানবসৃষ্ট দুর্যোগ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।