রান্নাবিষয়ক রিয়েলিটি শো মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়ার চূড়ান্ত পর্বে সোমবার তৃতীয় হিসেবে বিজয়ী হয়েছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কিশোয়ার চৌধুরী।
মাস্টারশেফ বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় রান্না বিষয়ক রিয়েলিটি শো। বিশ্বের কমপক্ষে ৪০টি দেশে নিজস্ব আয়োজনে মাস্টারশেফ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। তবে জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়া শীর্ষে রয়েছে।
রোববার চূড়ান্ত প্রতিযোগিতার প্রথম দিনে পান্তাভাত ও আলু ভর্তা বানিয়েছেন কিশোয়ার চৌধুরী। একইসঙ্গে বিচারকদের উদ্দেশে পরিবেশিত তার রান্নায় ছিল সার্ডিন মাছ ভাজি ও সালাদ।
সম্প্রতি মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কিশোয়ার চৌধুরীর কয়েক পদের রান্নার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে পড়ে। লাউ চিংড়ি, বেগুন ভর্তা, খিচুড়ি, আমের টক, খাসির রেজালা, ফুচকা, চটপটি, সমুচার রেসিপি দিয়ে সবাইকে অবাক করে দেন কিশোয়ার।
সংবাদমাধ্যমে দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এবারের ১৩তম আসরে বিজয়ী হয়েছেন ২৭ বছর বয়সী ভারতীয় বংশোদ্ভূত অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক জাস্টিন নারায়ণ। প্রথম রানারআপ হয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েল্সের বাসিন্দা পিট ক্যাম্পবেল। আর দ্বিতীয় রানারআপ হিসেবে বিজয়ী হয়েছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কিশোয়ার চৌধুরী।
কে এই কিশোয়ার চৌধুরী
কিশোয়ার চৌধুরী অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়া রাজ্যের মেলবোর্নের বাসিন্দা। তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা অস্ট্রেলিয়াতেই। দীর্ঘদিন ধরে বিজনেস ডেভেলপার হিসেবে কাজ করছেন তিনি। পাশাপাশি পারিবারিক প্রকাশনা ব্যবসাও দেখভাল করেন তিনি।
কিশোয়ার সন্তানদের জন্য বাংলাদেশি খাবার রান্না করতে গিয়েই পরিবারের কাছে শিখেছেন বাঙালির ঐতিহ্যবাহী রান্না। আর রান্নায় হাতেখড়ি ছোটবেলাতেই বাবা-মায়ের হাত ধরে।
কিশোয়ার চৌধুরী অস্ট্রেলিয়ায় সমাজসেবার জন্য বিশেষভাবে সুপরিচিত বাংলাদেশি ব্যবসায়ী কামরুল হোসাইন চৌধুরী এবং লায়লা চৌধুরীর মেয়ে।
কিশোয়ার চৌধুরী। ছবি: ফেসবুক
কিশোয়ার বাবা একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। কিশোয়ারের দাদার বাড়ি ঢাকার বিক্রমপুরে। নানার বাড়ি কলকাতার বর্ধমানে। প্রায় ৫০ বছর আগে অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমান তার বাবা-মা। সেখানেই জন্ম হয় কিশোয়ারের।
সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান, ইন্ডিয়া টুডে ও ইউএনবির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে কিশোয়ার মেলবোর্নের প্রসবিটারিয়ান লেডিজ কলেজে পড়াশোন করেছেন। তিনি মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ে বাণিজ্য স্নাতক করেছেন। এরপরে তিনি গ্রাফিক ডিজাইনে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
কিশোয়ার বাংলাদেশি না ভারতীয় তা নিয়ে বিতর্ক হলেও তিনি ১০০ ভাগ বাঙালি, তবে অর্ধ ভারতীয় এবং অর্ধ বাংলাদেশি। তাই কোনও রাষ্ট্রই তাকে তার নিজের হিসাবে দাবি করতে পারে না। দাদার বাড়ি বাংলাদেশ ও নানার বাড়ি ভারত। ফলে প্রতিবেশী দুইদেশেই তার আত্মীয় ও সংযোগ রয়েছে।
রান্নার প্রতি যেভাবে আগ্রহ
পশ্চিমা সংস্কৃতির দেশ অস্ট্রেলিয়ায় বসবাস করলেও নিজের দেশের ভাষা, সংস্কৃতি চর্চা সবকিছুই বজায় রেখেছেন কিশোয়ারের বাবা-মা। আর সেটাই নিজের সন্তানদেরও ধারণ করতে তারা সব সময় উৎসাহিত করেছেন।
শৈশব থেকেই কিশোয়ারকে রান্না করার পাশাপাশি রান্নার উপাদানগুলোর উত্স সম্পর্কে শেখানো হয়েছিল। ফলমূল, শাকসবজি মরিচ-লাউ সব কিছুই নিজেরা উৎপাদন করে তাদের পরিবার।
ছোটবেলা থেকে বাবা-মা এসব কাজে তাকে সম্পৃক্ত করেছেন। কিশোয়ারের কখনও মনে হয়নি যে হঠাৎ করে তিনি রান্না শুরু করেছেন।
তার বাবা মাছ ধরা পছন্দ করতেন এবং কিশোয়ার ছোটবেলায় তার সঙ্গে মাছ ধরতে যেতেন। বাড়িতে সতেজ মাছ রান্না করা হচ্ছে এমনটি দেখেই তিনি বেড়ে ওঠেন।
ছোটবেলায় ঠিক কোন বয়স থেকে রান্না শুরু করেছিলেন সেই বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা না দিতে পারলেও প্রথম স্মৃতিই তার রান্নাকে ঘিরেই। সেই স্মৃতি হলো, ৩-৪ বছর বয়সের কিশোয়ারকে সঙ্গে নিয়ে তার মা কেক বানিয়েছেন।
শেশব থেকেই কিশোয়ার শাকসবজি কুটে দেয়া, পেঁয়াজ ছিলে দেয়া, মাছ কোটা, মুরগি কেটে দেয়ার শিক্ষা নেন। অনেক সময় কিশোয়ারের মা তাকে এবং তার বোনদের ওপর রান্নার দায়িত্ব দিতেন। তারা কখনও পাস্তা, কখনও নুডলস তৈরি করতেন।
মোট কথা বাবা-মায়ের কাছ থেকেই রান্নার হাতেখড়ি কিশোয়ারের। যত ধরনের রান্নাই হোক না কেন, বাসায় এক বেলা বিশেষ করে রাতের খাবারের মেন্যু হতো সবসময় বাঙালি খাবারের মেন্যু। কিশোয়ার এভাবেই রান্না শিখেছেন এবং রান্নার প্রতি তার আগ্রহ বাড়িয়েছিলেন।
মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়ায় কিশোয়ারের যাত্রা
কিশোয়ারের মাস্টারশেফে অংশ নেয়ার চিন্তুা মাথায় আসে ২০২০ সালে সারা বিশ্বের মতো অস্ট্রেলিয়াতেও করোনাভাইরাস পরিস্থিতি শুরু হওয়ার পর।
একটা বিষয় বারবার মনে হচ্ছিল যে তার বাবা-মা যে রকম করে তাদের সংস্কৃতি, খাবার-দাবার সবকিছুর সঙ্গে তাদের সংযোগ ঘটিয়েছেন, তিনি সেটা তার সন্তানদের মধ্যে করে দিতে পারবেন কি-না।
কিশোয়ার চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত
তিনি নিশ্চিত যে দেশের বাইরে যেসব বাবা-মায়েরা থাকেন সবার মধ্যেই এই চিন্তাটা থাকে। এমন চিন্তা থেকে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটা বই লেখার পরিকল্পনা করেন কিশোয়ার।
তবে কিশোরের কখনোই মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়ায় আবেদন করার ইচ্ছা ছিল না। এটি তার ছেলের স্বপ্ন ছিল এবং তিনি প্রায়শই তাকে বলতেন মাস্টারশেফে অংশ নিতে। কিশোয়ারের ছেলেও বেশ ভালো রান্না করতে পারে।
তিনি তার ছেলেকে জুনিয়র মাস্টারশেফ প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে বলেছিলেন। কিন্তু ছেলে তাকে মাস্টারশেফের জন্যে আবেদন করার পরামর্শ দেন। তখনই কিশোয়ার তার ছেলে এবং পরিবারের কাছে উদাহরণ তৈরির জন্য আবেদন করার সিদ্ধান্ত নেন।
চার বছরের কন্যা সেরাফিনা এবং ১১ বছরের ছেলে মিকাইলের কথা ভেবে কিশোয়ারের চেষ্টা যেন আরও এগুতে থাকে। এছাড়া তার পরিবার এবং জীবনসঙ্গী এহতেশাম নেওয়াজ সব সময় তার পাশে ছিলেন।
মূল চ্যালেঞ্জ
আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাঙালির ঐতিহ্যের খাবার উপস্থাপন করাটা কিশোয়ারের জন্য ছিল যেমন চ্যালেঞ্জের, তেমনি ছিল আনন্দেরও। তিনি সব সময় পরিবার এবং বাচ্চাদের জন্য রান্না করেছেন। কিন্তু সেই রান্না এ রকম একটা প্রতিযোগিতায় কতটা কাজে দেবে, তা নিয়ে একধরনের শঙ্কা ছিল তার।
তবে তার আত্মবিশ্বাস ও রান্নার দক্ষতা তাকে মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়ায় শীর্ষ ২৪ থেকে সেরা তিনজনের মধ্যে নিয়ে আসে। সোমবার প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্বে দ্বিতীয় রানারআপ হিসেবে বিজয়ী হন কিশোয়ার।
মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়ার চূড়ান্ত পর্বে বিজয়ী জাস্টিন নারায়ণ (বামে), প্রথম রানারআপ পিট ক্যাম্পবেল (ডানে) আর দ্বিতীয় রানারআপ হিসেবে বিজয়ী হয়েছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কিশোয়ার চৌধুরী (মাঝে)। ছবি: সংগৃহীত
কিশোয়ার সব সময় চেয়েছেন ভিন্ন সব বাঙালি খাবারের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার মানুষের পরিচিতি ঘটাতে। বাঙালির রান্না নিয়ে তারা যথেষ্ট আগ্রহী ছিল, কী হবে কেমন হবে এসব প্রশ্ন তাদের ছিল। অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকরা তার এমন রেসিপি পছন্দ করবে কিনা তা তার পক্ষে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল।
কেন বাঙালি খাবার বেছে নিলেন
অস্ট্রেলিয়ার বড় বড় শহরসহ বিভিন্ন দেশের নানান শহরে অনেক বাঙালি রেস্তোরাঁ রয়েছে তবে সেই রেস্তোরাঁগুলোতে খুব বেশি বাঙালি খাবার পাওয়া যায় না। বেশিরভাগই হয় ভারতীয়। রেস্তোরাঁর মালিক বাংলাদেশি হলেও বাংলাদেশি খাবার সেভাবে দেখা যায় না। তার ইচ্ছা ছিল ‘বাঙালি ফুড আইডেনটিটি’ তুলে ধরা এবং এটিই তিনি মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়ায় পূরণ করেছেন।