সাইফুল আলমের বিশ্ববিদ্যালয়জীবন শেষ হয়েছে বেশি দিন হয়নি, চার বছর। মাসে তিন থেকে চারবার বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়া হতো। চাকরির কারণে মাঝে মাঝে সময় মেলাতে পারতেন না। তবু ওই দুই-তিন দিন তার কাছে বাকি দিনের রসদ ছিল।
গত বছর করোনা আসার পর থেকে সাইফুলের জীবনের অনেক কিছুই বদলে গেছে। বন্ধুদের সঙ্গে মুক্ত আড্ডা একেবারে বন্ধ।
করোনার প্রভাবে সবাই জীবনের ছন্দ ভিন্ন তালে মেলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। তবে আড্ডা দেয়া না হলেও অনলাইনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরব হয়ে ওঠেন সাইফুল। মেসেঞ্জারে একটা গ্রুপ খুলে নিয়েছেন। এরপর সেখানে যোগ করেন আরও বন্ধুদের। এখন মাঝে মাঝে ভিডিও কলে সবার সঙ্গে কথা হয়।
তবে মুখোমুখি আড্ডা বা সত্যিকার ঘোরাঘুরির যে মজা সেটি ভীষণভাবে অনুভব করেন সাইফুল।
গত বছর করোনার শুরুতে হুট করে বন্ধ হয়ে যায় সবকিছু। দফায় দফায় লকডাউন আর বিধিনিষেধের বেড়াজালে আটকে পড়ে গোটা দেশ। অনেক কিছু স্বাভাবিক হলেও স্বাভাবিক হয়নি মানুষের উন্মুক্ত চলাফেরা। হারিয়ে গেছে অনেক কিছু। বন্ধ আছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, গত দেড় বছরের এই সময়ে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে মানুষের মনোজগতে। সামাজিক যোগাযোগনির্ভর হয়েছে সম্পর্কগুলো। আগের মতো আড্ডা আর দেখা হওয়ার বাইরেই গড়ে উঠেছে সম্পর্কগুলো।
বন্ধুত্বের ধরন যেমনই হোক না কেন, প্রতিবছর পালন হচ্ছে বন্ধু দিবস। ২০১১ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ৩০ জুলাইকে অফিশিয়াল ইন্টারন্যাশনাল ফ্রেন্ডশিপ ডে ঘোষণা করা হয়। তবে ভারত, বাংলাদেশসহ কিছু দেশ আগস্টের প্রথম রোববার বন্ধুত্ব দিবস উদযাপন করে।
ফ্রেন্ডশিপ ডে ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, হলমার্ক কার্ডের প্রতিষ্ঠাতা ‘জয়েস হল’ ১৯১৯ সালে আগস্টের প্রথম রোববার বন্ধু দিবস হিসেবে সবাইকে কার্ড পাঠাতেন। ১৯৩৫ সালে আমেরিকার সরকার এক ব্যক্তিকে হত্যা করে। দিনটি ছিল আগস্টের প্রথম শনিবার। তার প্রতিবাদে পরদিন ওই ব্যক্তির এক বন্ধু আত্মহত্যা করেন।
আমেরিকান কংগ্রেসে ১৯৩৫ সালে আগস্টের প্রথম রোববারকে বন্ধু দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তবে ২০১১ সালের ২৭ এপ্রিল জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ৩০ জুলাই অফিশিয়াল ইন্টারন্যাশনাল ফ্রেন্ডশিপ ডে ঘোষিত হয়।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে বন্ধু তৈরির যে সময়, সেটি হারিয়ে ফেলতে বসেছে একটি প্রজন্ম। স্কুলে আলাদা জায়গায় আড্ডা, বিকেলে খেলার মাঠে অথবা একটু বেশি বয়সে কোনো কফিশপ বা চায়ের দোকানের যে গল্পগুলো তৈরি হয়, তা এখন আর নেই। আড্ডা ছাড়াই চলছে বন্ধুত্ব।
তবে আড্ডা না হলেও এখন বন্ধু হওয়ার জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যথেষ্ট। আগের মতো দেখা করা বা গল্প করা এখন সীমাবদ্ধ হয়েছে মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে। যেটি নিয়ে এই প্রজন্মের আফসোস থাকলেও বিকল্প কিছু পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী পরিচালক মো. তৌহিদুল আলম অফিসের কাজেই ব্যস্ত থাকেন। তবে শুক্রবার ও শনিবার ছুটি থাকার কারণে সময় পেলেই ছুটে যেতেন তার ক্যাম্পাসে।
আড্ডা দেয়ার সেই সময়গুলো খুব মিস করেন জানিয়ে তৌহিদুল বলেন, ‘রাতে মাঝে মাঝেই এখন অনলাইনে বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলি। তবে চায়ের দোকানে বসে গল্প করা, একটু হাঁটাহাঁটি করে ছবি তোলা এইগুলো আর হয় না।’
তৌহিদুলের মতো একই রকম অনুভূতি বাংলাদেশে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের আইন কর্মকর্তা শেখ মো. ফেরদৌস আরাফাতের।
তারা দুজনই সদ্য স্নাতকোত্তর শেষ করে চাকরিজীবনে যোগ দিয়েছেন।
আরাফাত বলেন, ‘এবার ঈদে বাড়ি যাওয়া হয়নি। ঢাকায় খুব নিঃসঙ্গ সময় কাটিয়েছি। অনলাইনে আপনি কতটুকুই বা সময় কাটাতে পারেন। খুব ইচ্ছা হয় ছুটে বেরিয়ে পড়ি। বন্ধুদের সাথে খুনসুটি করি। করোনা একটা বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে এই সমাজে। এখন সবকিছুই যেন স্ক্রিনে বন্দি হয়ে আছে।’
আরাফাত আর তৌহিদুল জীবনের একটা সময় বন্ধুদের নিয়ে সময় পার করলেও স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের কাছে এই সময়টা যেন থমকে আছে। শুরুতে অনলাইনে বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ হলেও এখন আর সেটিও হচ্ছে না। সারা দিন অনলাইনে ক্লাস ও কোচিংয়ের কারণে সেই সময় আর হয়ে ওঠে না। স্কুল বা কলেজে আড্ডা দেয়ার জায়গাগুলো স্মৃতি থেকে যেন মুছে যাচ্ছে সবার।
ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী প্রাচীর কাছেও তাই বন্ধু এখন খুব অপরিচিত একটা বিষয়। সারা দিন অনলাইন ক্লাস আর কোচিংয়ের কারণে কারো সঙ্গে অনলাইনেও কথা হয় না প্রাচীর। চার দেয়ালে তার বন্ধু এখন বোন ও ভাই।
বিভিন্ন সময়ে গবেষণায় দেখা গেছে, একজন মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত সম্পর্ক হয় দুই থেকে তিনজনের সঙ্গে। ভালো বন্ধুর সংখ্যা সর্বোচ্চ পাঁচজন থাকে। একজন মানুষ নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে পারে ২০ন জনের সঙ্গে। তবে একজন মানুষ একবারে ১৫০ জনের বেশি মানুষের কথা মনে রাখতে পারেন না।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক চিকিৎসক হেলাল উদ্দিন আহমেদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এখনকার অনলাইনভিত্তিক সম্পর্কের ভালো ও মন্দ দুই ধরনের প্রভাবই রয়েছে।
আন্তব্যক্তিক সম্পর্ক কোনো কোনো ক্ষেত্রে হ্রাস পাচ্ছে আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমরা নিজেদের নতুন করে পরিচিত করতে পারছি। আগে অনেকেই অনলাইনে কথা বলতে পারতেন না। তারা এখন সেই জায়গাটা তৈরি করতে পারছেন।’
এই অধ্যাপক অনলাইন সামাজিকায়নের বিষয়টিকে ভালো বলেই অভিহিত করেছেন। এখন যে জীবনধারা, সেখানে অনলাইনভিত্তিক জীবনধারা অনেক কিছুই সহজ করে দিয়েছে।