ধামরাইয়ের যশোমাধবের রথের খ্যাতি দেশজুড়ে। প্রতিবছর হিন্দুধর্মাবলম্বীরা দেশের প্রাচীন ও বৃহত্তম এই রথযাত্রায় বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনায় অংশ নেন।
তবে করোনাভাইরাস মহামারির প্রকোপে গত বছর বন্ধ ছিল প্রায় ৪০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী এই রথযাত্রা। কেবল ধর্মীয় আচারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল এই ধর্মীয় অনুষ্ঠান। এর আগে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এই রথটি পুড়িয়ে দেয়ায় ওই সময় রথযাত্রা বন্ধ ছিল।
শুরুর পর চলতি বছর তৃতীয়বারের মতো রথযাত্রা স্থগিত হলো বলে জানিয়েছে যশোমাধব মন্দির পরিচালনা পর্ষদ।
ঐতিহ্যবাহী এই রথযাত্রার আদ্যোপান্ত নিউজবাংলাকে জানান যশোমাধব মন্দির পরিচালনা পর্ষদের সাধারণ সম্পাদক নন্দ গোপাল সেন।
জগন্নাথ হলেন হিন্দু দেবতা বিষ্ণুর দ্বাপর যুগের অবতার কৃষ্ণের এক বিশেষ রূপ। কৃষ্ণের এই রূপকে তার দাদা বলরাম ও বোন সুভদ্রার সঙ্গে পূজা করা হয়। ভারতের ওড়িশা, ছত্তিশগড় (বস্তার অঞ্চল), পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খন্ড, বিহার, অসম, মণিপুর ও ত্রিপুরা রাজ্যে এবং বাংলাদেশে জগন্নাথের পূজা প্রচলিত।
ধামরাই উপজেলার এই জগন্নাথ রথ বা যশোমাধব রথ জগন্নাথের প্রতি উৎসর্গ করা একটি রথমন্দির। প্রতিবছর রথযাত্রার দিন একটি সুবিশাল ছয়তলা রথে মাঝে সুভদ্রা, তার ডানে বলরাম ও বাঁয়ে জগন্নাথরূপী কৃষ্ণের প্রতিমা নিয়ে শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয় এখানে।
রথটি হিন্দু দেবদেবীর নানা ছবিতে সজ্জিত থাকে। জগন্নাথ দেবের মাসির বাড়ি যাওয়া উপলক্ষে প্রতিবছরই আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে রথ টানা হয়। চাকার ওপর স্থাপন করা বিশেষ রথের ভেতর দেবতার প্রতিমা বসিয়ে নেয়া হয় ধামরাই বাজার থেকে পৌর এলাকার কায়েতপাড়ার মাধব মন্দিরে। সারা দেশ থেকে পুণ্যার্থীরা এই রথযাত্রায় অংশগ্রহণ করতে আসেন। আয়োজন করা হয় মাসব্যাপী মেলারও। রথ নিয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন-
‘রথযাত্রা, লোকারণ্য, মহা ধুমধাম,
ভক্তেরা লুটায়ে পথে করিছে প্রণাম।
পথ ভাবে আমি দেব রথ ভাবে আমি,
মূর্তি ভাবে আমি দেব—হাসে অন্তর্যামী।’
তবে করোনা মহামারি পরিস্থিতিতে আটকে গেছে যশোমাধবের রথের চাকা। ১১ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে রথযাত্রার দিন হলেও এবারও হচ্ছে না অনুষ্ঠান। প্রতিবছর রথযাত্রা উপলক্ষে পুরো ধামরাই বাজার এলাকায় সাজ সাজ রব থাকলেও এ বছর নেই কোনো আড়ম্বর। কর্মব্যস্ততাও নেই যশোমাধব মন্দির পরিচালনা কমিটিরও।
নন্দ গোপাল বলেন, ‘লোকমুখে জানা যায়, একসময় ধামরাই এলাকার রাজা ছিলেন শ্রীযশোপাল। সেই সময় সাভারের শিমুলিয়া থেকে সৈন্য-সামন্ত নিয়ে ধামরাইয়ের কাশবন ও দুর্গম এলাকা পার হয়ে পাশের এক গ্রামে যাচ্ছিলেন তিনি। এরই মধ্যে কায়েতপাড়ায় এসে একটি মাটির ঢিবির সামনে থেমে যায় তাকে বহনকারী হাতি। রাজা শতচেষ্টা করেও হাতিটিকে সামনে নিতে পারেন না। তখন তিনি হাতি থেকে নেমে স্থানীয় লোকজনকে ওই মাটির ঢিবি খনন করার নির্দেশ দেন। সেখানে পাওয়া যায় একটি মন্দির। পাওয়া যায় বেশ কিছু মূর্তিও। এর মধ্যে শ্রীবিষ্ণুর মূর্তির মতো দেখতে শ্রীমাধব মূর্তিও ছিল। তখন রাজা ভক্তি করে সেগুলো সঙ্গে নিয়ে যান। সে রাতেই শ্রীমাধবকে স্বপ্নে দেখেন রাজা যশোপাল। দেবতা তাকে নির্দেশ দেন পূজা করার। আর বলে দেন, রাজার নামের সঙ্গে মাধবের নাম জুড়ে নিতে। এরপরেই রাজা যশোপালের নাম হয়ে যায় যশোমাধব। পরে ধামরাই সদরে ঠাকুরবাড়ি পঞ্চাশ গ্রামের বিশিষ্ট পণ্ডিত শ্রীরাম জীবন রায়কে তিনি ওই মাধব মূর্তি নির্মাণের দায়িত্ব দেন। এখনও সেই মূর্তির পূজার প্রচলন রয়েছে। সময়টি ছিল চন্দ্র আষাঢ়ের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথি। সেই থেকেই শুরু হয় যশোমাধবের পূজা।’
যেভাবে বানানো হয় রথ
নন্দ গোপাল আরও বলেন, ‘বাংলা ১০৭৯ সাল থেকে ধামরাইয়ের রথযাত্রা ও রথমেলা উৎসব পালিত হয়ে আসছে। কালের পরিবর্তনে কখন বাঁশের রথটি কাঠের রথে পরিণত হয় তার সঠিক ইতিহাস জানা যায়নি। বাঁশের রথের পর বাংলা ১২০৪ থেকে ১৩৪৪ সাল পর্যন্ত ঢাকা জেলার সাটুরিয়া থানার বালিয়াটির জমিদাররা বংশানুক্রমে এখানে চারটি রথ তৈরি করেন।
‘১৩৪৪ সালে রথের ঠিকাদার ছিলেন নারায়ণগঞ্জের প্রয়াত সূর্য নারায়ণ সাহা। এ রথ তৈরি করতে সময় লাগে এক বছর। ধামরাই, কালিয়াকৈর, সাটুরিয়া, সিঙ্গাইর থানার বিভিন্ন কাঠশিল্পী যৌথভাবে নির্মাণকাজে অংশ নিয়ে ৬০ ফুট উচ্চতাসম্পন্ন রথটি তৈরি করেন।’
‘তিনতলা রথটির প্রথম ও দ্বিতীয় তলায় চার কোণে চারটি প্রকোষ্ঠ ও তৃতীয় তলায় একটি প্রকোষ্ঠ ছিল। বালিয়াটির জমিদাররা চলে যাওয়ার পরে রথের দেখভালের দায়িত্ব পালন করতেন টাঙ্গাইলের রণদা প্রসাদ সাহার পরিবার।’
মুক্তিযুদ্ধে যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় রথটি
১৯৭১ সালের ৯ এপ্রিল ধামরাই গণহত্যার দিনই এই রথ পুড়িয়ে দেয় পাকিস্তানি হানাদাররা। পুড়িয়ে দেয়ার আগে রথটির কাঠের তৈরি তিনতলাবিশিষ্ট ৪০ ফুট প্রস্থ, ৭৫ ফুট উচ্চতা, ৯টি প্রকোষ্ঠ, ৩২টি চাকা ও ৯টি মাথাবিশিষ্ট কাঠামো ছিল। সৌন্দর্যশৈলীর নানা কারুকার্য খচিত ছিল রথটিতে।
যেভাবে পুনরায় শুরু হয় রথযাত্রা
যশোমাধব মন্দির পরিচালনা পর্ষদের সাধারণ সম্পাদক নন্দ গোপাল জানান, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে এই রথ না থাকায় উৎসব বন্ধ ছিল এক বছর। পরবর্তী সময়ে ১৯৭৩ সালে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা ছোট আকারে একটি বাঁশ ও কাঠের রথ নির্মাণ করে উৎসব পালন করে। ১৯৭৪ সালে বৃহৎ রথের আদলে ছোট পরিসরে কাঠের রথ নির্মাণ করে পুনরায় রথ উৎসবের নবযাত্রা শুরু হয়।
সবশেষ ২০১৩ সালে পুরোনো রথের আদলে দেড় কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন রথ তৈরি করে দেয় তৎকালীন সরকার। ৪০ জন শিল্পী ছয় মাসেরও বেশি সময় ধরে নিরলসভাবে কাজ করে ৩৭ ফুট উচ্চতা ও ২০ ফুট প্রস্থের কারুকার্যখচিত বর্তমান রথটি নির্মাণ করেন।
লোহার খাঁচার ওপর সেগুন ও চাম্বল কাঠ বসিয়ে খোদাই করে তৈরি করা হয়েছে আকর্ষণীয় সব শৈল্পিক নিদর্শন। এতে রয়েছে লোহার তৈরি ১৫টি চাকা। রথের সামনে রয়েছে কাঠের তৈরি দুটি ঘোড়া ও সারথি।
এ ছাড়া রথের বিভিন্ন ধাপে প্রকোষ্ঠের মাঝে স্থাপন করা হয়েছে কাঠের তৈরি দেব-দেবীর প্রতিমা। প্রতিবছর রথযাত্রার আগে রং চড়ানো ও সাজসজ্জার কাজ করে এটিতেই অনুষ্ঠিত হয় রথ উৎসব।
নন্দ গোপাল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘করোনার কারণে গত বছরের পর এ বছরও সীমিত পরিসরে রথযাত্রা উপলক্ষে কায়েতপাড়া মন্দিরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে শুধু ধর্মীয় পূজা-অর্চনা করা হবে। ১১ জুলাই রাতে অধিবাস পূজা হবে। আর বিকেলে প্রশাসনের নির্দেশ পেলে মাসির বাড়ি নেয়া হবে জগন্নাথ, সুভদ্রা ও বলরামকে। তবে রথের মেলা এ বছরও বসছে না।’
রথযাত্রার আনু্ষ্ঠানিকতার বিষয়ে ধামরাই থানার পুলিশ পরিদর্শক আতিক রহমান বলেন, ‘করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় চলমান লকডাউনের মধ্যে সব জমায়েত নিষিদ্ধ করা হয়েছে। একই কারণে রথযাত্রাও বাতিল করা হয়েছে। মন্দিরের ভেতরেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে পূজার কাজ শেষ করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।’