‘বাজান সকাল থাইকান বসে আছি। আইতে একটু লেট কইরা ফালাছিলাম তাই বকশিস পাই নাই। নাতনিডাও আমার সাথে আইয়া বইছিল। ওর মনডি খারাপ। আপনে কি নিউজ করবার জন্য জিগাইলেন। আমাগো নাম দিয়েন না। লজ্জা লাগে।’
কথাগুলো বলছিলেন সিদ্ধেশ্বরী জামে মসজিদের পাশে বসে থাকা জাহানারা বেগম (ছদ্মনাম)। সকালে ঈদের জামাতের পর মুসল্লিরা রাস্তায় বসে থাকা জাহানারা বেগমের মত আরও অনেককে বকশিস দিয়ে থাকেন। যার যেমন মানসিকতা ও সাধ্য তাই দান করেন জাহানারা বেগমদের।
রাজধানীর প্রতিটি এলাকায় গত একমাস ধরেই রাতের তারাবি নামাজের পর ছিন্নমুল মানুষদেরকে মসজিদের আশেপাশে ভিড় করতে দেখা যায়। উদ্দেশ্য একটাই, বকশিসের টাকা সংগ্রহ। মানুষের বাসায় কাজ করার পাশাপাশি এই টাকা দিয়েই ঈদ পালন করেন তারা।
জাহানারা বেগমের নাতনি রাজধানীর একটি মাদ্রাসার চতুর্থ শ্রেণিতে পড়াশোনা করে। ঈদ উপলক্ষে দান থেকে একটা জামা পেয়েছে সে। জামাটা গায়ের চেয়ে কয়েক সাইজ বড়; হাতে পরেছে কিছু পুরান চুড়ি।
ঈদে নাতনির জন্য কিছু কিনতে পেরেছেন কি না জানতে চাইলে জাহানারা বলেন, ‘না বাজান। যেই বাড়িতে কাজ করি হ্যাতেরা একটা জামা দিছে। কিন্তু সেটাও নাতনির পরনে একটু বড় হইয়া গ্যাছে। কী আর করুম। বলছি এইডাই পর। টাকা তুলবার পারলে পরে কিনা দিবনে।’
এমনই আরেকজন শিউলি আক্তার (ছদ্মনাম)। একটা বাসায় কাজ করেন। মাসে সাড়ে চার হাজার টাকা পান। তা দিয়ে সংসার চালানো দায়। ঈদের দিন সকালে একটু সেমাই রান্না করেই অবস্থান নেন মগবাজারের শাহ আলী মাজার মসজিদ পাশে।
বললেন, ‘অনেকেই ট্যাকা দিসে। এইখানে নাকি আরও আগে থাইক্যা ট্যাকা দিতাছে। আমার দেরি হয়ে গেছে। আগে আসলে আরও বেশি পাইতাম।’
মালিবাগ থেকে মগবাজার মূল রাস্তার উপর দিয়ে উঠে গেছে ফ্লাইওভার। এই ফ্লাইওভারের নিচে বসতি গড়ছে অনেক ছিন্নমূল মানুষ। মানুষের বাসায় কাজ করে অথবা ভিক্ষা করে দিননিপাত করেন তারা।
কথা হয় সাত বছর বয়সী জ্যোৎস্নার সঙ্গে। ফ্লাইওভার এর নিচে পলিথিন দিয়ে মোড়ানো ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। মা গেছে বাইরে।
জ্যোৎস্না বলল, ‘সকাল থাইক্যা মা নাইতো। একটা জামা রাইখ্যা গেছিল। এই যে লাল রঙয়ের। এইডা পরছি।
মা কই জানতে চাইলে জ্যোৎস্না বলে, ‘মা তো টাকা আনতি গেছে। সকাল থিকা দেখি নাই।’
রাজধানীতে শুক্রবার ছিন্নমূলদের এভাবেই কেটেছে ঈদের সকাল-বিকেল। ঈদের বকশিস অনেকের জন্য ধরা দিয়েছে আয়ের অন্যতম উপলক্ষ হয়ে। সঙ্গে ভালো খাবার তাদের কাছে বাড়তি পাওনা।
রিকশাচালক হযরত আলী একাই থাকেন ঢাকাতে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া মেয়ে বৃহস্পতিবার ফোন দিয়ে বাবাকে বাড়ি ফিতে বলেছে। তবে বাড়ি ফেরার মত পুঁজি তার হয়নি।
নিউজবাংলাকে হযরত বলেন, ‘আমার মায়াডা সিক্সে পড়ে। লালমনিরহাট বাড়ি আমার। কিছু কিনে দিবার পারি নাই। পাঁচশ টাকা ওর মাকে পাঠায়ছি। এই টাকায় কি হয়। দুইমাস ধরে ছিড়া লুঙ্গি পিন্দা আছি মামা। কি করুম কোন। লকডাউনে তো সব শ্যাষ। বাড়িত যামু তয় গাড়ি নাই। মেলা ট্যাকা লাগে। সকাল থিকাই রিকশা নিয়ে বের হয়েছি।’
ঢাকায় হযরত আলীর মত মানুষের সংখ্যা নেহাত কম না। তাদের নির্দিষ্ট ঘড়বাড়ি নেই। ফুটপাথ বা ফ্লাইওভারের নিচে কোনোভাবে রাত যাপন করেন।
ঢাকায় ছিন্নমূল মানুষদের নিয়ে সাজেদা ফাউন্ডেশনের ‘আমরাও মানুষ’ নামে একটি প্রকল্প রয়েছে। ওই প্রকল্পের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০২০ সালে ঢাকা শহরের দেড় কোটি মানুষের মধ্যে বর্তমানে অনুমানিক ২০ থেকে ২২ হাজার লোক ফুটপাতে বসবাস করে। তাদের অনেকে ৩০ থেকে ৩৫ বছর ধরে ফুটপাতে বসবাস করছে।