ঈদের আগের দিন আজাদ প্রোডাক্টসের দরজায় তালা।
দেড় দশক আগে এই সময়ে অবিশ্বাস্য একটি ঘটনা হিসেবেই ধরা যেত। তখন ঈদ কার্ডের ব্যাপক চল। আর এই কার্ড মানেই আজাদ প্রোডাক্টস।
মোবাইল ফোন আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম মানুষের জীবনকে ব্যাপকভাবে পাল্টে দেয়ায় ব্যবসা পাল্টাতে বাধ্য হয়েছেন তারা।
আজাদ প্রোডাক্টসের তুমুল জনপ্রিয়তায় ৮০ ও ৯০ দশকে রাজধানীর পুরানা পল্টন এলাকায় আরও বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে। ঈদের ভরা মৌসুমে বন্ধ তার একটি ছাড়া সবগুলোই।
খোলা ছিল কেবল আনন্দ প্রোডাক্টস কার্ড নামে একটি প্রতিষ্ঠান। তবে সেখানে ঈদ কার্ড বলতে কিছুই নেই। গত এক দশকেও তারা কোনো কার্ড আনেনি।
ব্যবসা তাহলে কীভাবে চলে?
আনন্দ প্রোডাক্টসের কর্মকর্তা মকবুল হোসেন বলেন, ‘আগে এমন সময়ে দিনে ২০ হাজার কার্ড বিক্রি করতাম। সারা রাত দোকান খোলা থাকত। গত কয়েক বছরে আর সেই আশা নেই। এখন শুধুমাত্র বিয়ের কার্ডটা মোবাইলে দেয়া বাকি আছে।’
১৯৮২ সালে মকবুলের চাকরি জীবনের শুরু আজাদ প্রোডাক্টসেই। তাই সে সময় বিখ্যাত হয়ে উঠা প্রতিষ্ঠানটির রমরমা সময়ের চিত্র জানা গেল তার বয়ানেই।
তিনি বলেন, ‘তখন বিভিন্ন শপিংমল, লাইব্রেরি, ভ্রাম্যমাণ দোকানে ঈদ কার্ড বিক্রি হতো। কার্ডে কী লেখা হবে সেটি নিয়ে চলত জল্পনা কল্পনা। তখন প্রিয় মানুষদের দেয়া ঈদ কার্ডগুলো সংরক্ষণ করে রাখা হতো যত্ন সহকারে।
‘রোজা শুরুর পর থেকে পোস্ট অফিসগুলোতে ঈদ কার্ড পোস্ট করা আর ডেলিভারি নেয়ার জন্য ভিড় লেগে থাকত। তবে এখন নতুন প্রজন্মের কাছে ঈদ কার্ড দিয়ে শুভেচ্ছা জানানোর বিষয়টা যেন অচেনা সংস্কৃতি।’
মকবুল জানান, ৮২ সাল থেকে শুরু হলেও ঈদ কার্ডের আধুনিকায়ন শুরু হয় ১৯৮৬ সাল থেকে। তবে ২০১০ সালের পর থেকে মন্দা লাগে এই ব্যবসাতে। মানুষ তখন শুভেচ্ছা বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে বেছে নেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আর মোবাইল ফোনের ক্ষুদেবার্তা।
কেমন ছিল ঈদের কার্ড
মকবুল জানান, ৯০ দশকে ৫০০ টাকাতেও বিক্রি হতো কোনো কোনো ঈদের কার্ড। তবে শুধু ঈদ নয়, হালখাতা, পয়লা বৈশাখ বা ইংরেজি নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময়ের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ও আকর্ষণীয় মাধ্যম ছিল কার্ড বিনিময়।
চাহিদা কেমন ছিল?
মকবুল বলেন, ‘আমার এখনও মনে আছে মিউজিক কার্ডের কথা। নতুন এই ধরনের কার্ড আসার পর সেটি নিয়ে এক ধরনের মাতামাতি ছিল তরুণদের মধ্যে। আমরা দিনে প্রায় ১৫ হাজার কার্ড তখন বিক্রি করেছি। এমনও দিন গেছে যে ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকার কার্ড বিক্রি হয়েছে দিনে।
আর কী কী কার্ড জনপ্রিয় ছিল?
মকবুল বলেন, ‘মিউজিক কার্ডের তিনটা ধরন ছিল। একটা ছিল চারটা হিন্দি গান নিয়ে বানানো, সেটির দাম ছিল ২৫০ টাকা। একটার ধরণ ছিল শুধু মিউজিক। দাম ছিল ২০০ টাকা। আর একটার নাম ছিল ভলিউম কার্ড। সবচেয়ে বেশি ৫০০ টাকা দামে এটি বিক্রি হতো।
তবে সে সব কার্ড এখন আর সংরক্ষণে নেই।
মকবুল বলেন, ‘আগে নাটকের অভিনেতা হুমায়ূন ফরিদী আজাদ প্রোডাক্টসে আসতেন। আরও অনেক অভিনেতা আর নাট্যকারদের ভিড় লেগেই থাকত। সারারাত জেগে আমরা কাজ করতাম।’
আনন্দ প্রোডাক্টসের মালিক আব্দুল হাকিম বাবুল। একটু মন খারাপ নিয়ে বলেন, ‘এভাবে আর বেশিদিন ব্যবসা করা যাবে না।’
তিনি বলেন, ‘দোকানটাই শুধু খোলা আছে। বিক্রি বা অর্ডার নেই। কর্মচারীদের বেতন অন্যভাবে জোগাড় করে দিয়েছি।’
কার্ডের ঐতিহ্য কীভাবে হারিয়ে গেল?
তিনি বলেন, ‘আপনিই দেখেন এখন আর সেই যুগ নেই। আগে মানুষ শুভেচ্ছা বিনিময় বলতে কার্ড আদান-প্রদানকেই বোঝাত। এখন শুধু বিয়ের কার্ডের চল আছে। তাও খুব কম সংখ্যক। মানুষ বিয়ের কার্ড না দিলে মন খারাপ করে, তাই সেই আনুষ্ঠানিকতার জায়গাটা রয়ে গেছে।’
‘সময়ের স্রোতে আর ইন্টারনেটের দাপটে কার্ড দিয়ে শুভেচ্ছা জানানোর সেই সংস্কৃতি এখন কেবল ইতিহাস। মোবাইলে ক্ষুদেবার্তা, ফেসবুক, মেসেঞ্জার, ইমো, হোয়াটসঅ্যাপসহ নানা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এখন ঈদের শুভেচ্ছা জানানো হয়’- সময়ের স্রোতে ব্যবসা হারানোর হতাশাগ্রস্ত ব্যবসায়ীর কণ্ঠে ঝরে পড়ে আর্তনাদ।
কোথা থেকে আসত কার্ডের ডিজাইন
মকবুল হোসেন জানান, ‘আজাদ প্রোডাক্টসের মালিক আবুল কালাম আজাদ সাহেব নিজে থেকেই এই ডিজাইনগুলো বের করতেন। আর সেইভাবেই ছাপা হয়ে যেত। বাইরের দেশে কী কী ডিজাইন চলছে সেটি নিয়েও আমরা কাজ করতাম।’
এখন কেমন কার্ডের বাজার
আনন্দ প্রোডাক্টসে যতগুলো কার্ড আছে সব বিয়েকেন্দ্রিক। কিছু কিছু ভিন্নতা পাওয়া যায়। অনেকেই জন্মদিন, সুন্নতে খৎনাতে কার্ড দিয়ে থাকেন। তেমন কিছু কার্ড আছে। মূলত মিশরীয় কিছু নকশা এখন অনুসরণ করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে আছে ভারতীয় নকশা।
আনন্দ প্রোডাক্টসে সর্বোচ্চ দামের বিয়ের একটি কার্ড এক হাজার টাকা। ৮০০ টাকা দামের আরেকটি কার্ড রয়েছে। কিছু কিছু ডিজাইন আছে যেগুলো খুব দামি।
মকবুল বলেন, ‘আগে মাত্র এক থেকে দেড়শ কার্ডের ডিজাইন ছিল। আর এখন আমার এই দোকানে প্রায় তিন হাজার আটশ কার্ডের ডিজাইন পাওয়া যাবে।’
লকডাউনের কারণে বিয়ের কার্ডের ব্যবসাও যেন থেমে গেছে। এখানেও সীমিত পরিসরের হাওয়া লেগেছে বলে জানান কোম্পানির মালিক আব্দুল হাকিম। জানান, গত বছরের নভেম্বর থেকে এ বছর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত একটু ব্যবসা ছিল। তবে আবার সেটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম।