চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) আইন বিভাগে শিক্ষক নিয়োগে তোড়জোড় চলছে। তবে এ নিয়োগ কার্যক্রমে পরিকল্পনা কমিটির সিদ্ধান্তকে উপেক্ষা করার অভিযোগ উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে। বিভাগের শিক্ষক নিয়োগে উপাচার্য ‘বিশেষ ক্ষমতা’ প্রয়োগ করেছেন বলে জানা গেছে। পরিকল্পনা কমিটিকে উপেক্ষা করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর আগামীকাল রোববার ডাকা হয়েছে শিক্ষক নির্বাচনি বোর্ড। বিষয়টিকে ‘ক্ষমতার অপব্যবহার’ হিসেবে দেখছেন শিক্ষকদের একাংশ।
এ বছরের ১২ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে শিক্ষক নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে কর্তৃপক্ষ। সেখানে আইন বিভাগে দুই প্রভাষক পদে নিয়োগের জন্য নিয়োগপ্রার্থীদের থেকে দরখাস্ত আহ্বান করা হয়।
নিয়মানুযায়ী, চবিতে কোনো বিভাগে শিক্ষক নিয়োগ দিতে হলে প্রথমে বিভাগের পরিকল্পনা কমিটির সভায় বিষয়টির অনুমোদন নিতে হয়। সভায় অনুমোদিত হলে বিভাগের সভাপতি তা রেজিস্ট্রারের কাছে পাঠান। পরবর্তীতে রেজিস্ট্রার বিভিন্ন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে উপাচার্যের সম্মতি নিয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করবেন।
তবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, উপাচার্যের ক্ষমতাবলে এই বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়েছে। অতীতে উপাচার্যকে এ ক্ষমতা দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট।
এ ব্যাপারে আইন বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, এ বিভাগে শিক্ষক নিয়োগের বিষয়ে বিভাগীয় পরিকল্পনা কমিটির মতামত চেয়ে গত ২৩ মার্চ রেজিস্ট্রার একটি চিঠি পাঠান। পরবর্তীতে বিভাগীয় পরিকল্পনা কমিটির সভায় বিভিন্ন বিষয় যাছাই-বাছাই করে শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি না দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়, পরবর্তীতে (৯ এপ্রিল) যা রেজিস্ট্রারকে চিঠির মাধ্যমে জানিয়ে দেন বিভাগের সভাপতি।
সেই চিঠির একটি কপি নিউজবাংলার হাতে এসেছে।
রেজিস্ট্রারকে দেয়া ওই চিঠিতে বলা হয়, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচলিত নিয়ম অনুসারে শিক্ষকবৃন্দের সাপ্তহিক ন্যূনতম ক্লাস লোড হলো, অধ্যাপক ১০টি ক্লাস, সহযোগী অধ্যাপক ১২টি এবং সহকারী অধ্যাপক ও প্রভাষক ১৪টি ক্লাস।
‘আইন বিভাগে বর্তমানে কর্মরত অধ্যাপক আছেন ১১ জন এবং ছুটিতে আছেন দুই জন। ১১ জন অধ্যাপক প্রতি সপ্তাহে সর্বমোট ৭১টি ক্লাস নেন। গড়ে একজন অধ্যাপক প্রতি সপ্তাহে ৬.৪৫টি ক্লাস নেন। একইভাবে দুইজন কর্মরত সহযোগী অধ্যাপক (১ জন ছুটিতে আছেন) প্রতি সপ্তাহে সর্বমোট ১২টি ক্লাস নেন; গড়ে একজন সহযোগী অধ্যাপক প্রতি সপ্তাহে ৬টি ক্লাস নেন। অনুরূপভাবে ৭ জন সহকারী অধ্যাপক প্রতি সপ্তাহে সর্বমোট ৫৮টি ক্লাস নেন। গড়ে একজন সহকারী অধ্যাপক প্রতি সপ্তাহে ৮.২৮টি ক্লাস নেন। এছাড়াও সপ্তাহে ৮টি ক্লাস অন্যান্য বিভাগের শিক্ষকরা নিয়ে থাকেন।
‘এই বিভাগে বর্তমানে অনার্সে ১৩৬ ক্রেডিট কোর্স চালু আছে। ভবিষ্যতে OBE চালু হলে অনার্সে ন্যূনতম ক্রেডিট দাড়াবে ১৪০ যা বর্তমান ক্রেডিট এর চেয়ে মাত্র ৪ (চার) ক্রেডিট বেশি। ছুটিতে থাকা শিক্ষক কাজে যোগদান করলে শিক্ষকদের ক্লাস লোড আরও কম হবে।
‘এমতবস্থায় উপরোক্ত বিষয়সমূহ এবং আইন বিভাগের বর্তমানে নিয়োজিত শিক্ষকদের ক্লাস লোড বিবেচনা করে বর্তমানে প্রভাষক দুইটি স্থায়ী শূন্য পদে বিজ্ঞাপন প্রদান না করার জন্য সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো।’
তবে এ সিদ্ধান্তের সঙ্গে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ জাফর উল্লাহ তালুকদার এবং ড. মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন ভিন্নমত পোষণ করেন বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিভাগের সাবেক সভাপতি সিফাত শারমিন বলেন, ‘আমরা যখন চিঠিটা দিয়েছিলাম সেটাতে পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসেব করে দিয়েছিলাম। সেখানে আমরা দেখিয়েছিলাম যে, আমাদের শিক্ষক সঙ্কট নাই। আমাদের কতজন শিক্ষক আছে, কার কতটা ক্লাস লোড- এগুলোও উল্লেখ করেছিলাম। আমি বলেছিলাম আমাদের শিক্ষকরা ছুটিতে আছে, তারা ফিরে আসলে আমাদের ক্লাস লোড আরও কমে যাবে। এগুলো সবই অফিশিয়াল ডকুমেন্ট আর তা আমরা অফিশিয়ালি-ই পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু কর্তৃপক্ষ আমাদের পরিকল্পনা কমিটির সিদ্ধান্তকে বিবেচনায় না নিয়ে শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দিয়েছেন।’
এ বিষয়ে আইন বিভাগের এক অধ্যাপক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘ক্লাস লোড হিসেব করলে আইন বিভাগে পর্যাপ্ত শিক্ষক রয়েছে। পরিকল্পনা কমিটি বিচার-বিশ্লেষণ করে বলেছে, নতুন শিক্ষক লাগবে না। পরপর তিনবার পরিকল্পনা কমিটি না করে দেয়ার পরও উপাচার্য তার ক্ষমতাবলে বিজ্ঞাপন দিয়ে দিলেন। এ অবস্থায় নতুন শিক্ষক নিয়োগ শুধু রাজনৈতিক কারণ তথা বিভাগের এক পক্ষের দল ভারী করার লক্ষ্যে।’
তিনি বলেন, ‘পরিকল্পনা কমিটি অন্যায় করলে উপাচার্যের বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগ করবে, কিন্তু এখানে সেটা হচ্ছে না। এটা (বিশেষ ক্ষমতা) তো ক্ষমতার অপব্যবহার করার জন্য দেয়া হয় নাই।'
জানতে চাইলে আইন বিভাগের বর্তমান সভাপতি অধ্যাপক ড. রকিবা নবী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের মাস্টার্সে ১৩টা কোর্সের মধ্যে ৬ থেকে ৭টা কোর্স চালু আছে। শিক্ষকের অভাবে চালুও করতে পারছি না। নতুন কারিকুলামে যখন আমরা যাব, তখন আমাদের আরও কোর্স চালু করতে হবে। কাজেই আমাদের শিক্ষক লাগবেই। যারা বলছেন শিক্ষক লাগবে না তারা রাজনীতি করছেন। আমাদের বিভাগে আরও শিক্ষক দরকার। আমাদের শিক্ষক সঙ্কট আছে; এরমধ্যে অনেকেই বাইরে আছেন।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ শাখার ডেপুটি রেজিস্ট্রার হাছান মিয়া বলেন, ‘অতীতের সিন্ডিকেটের একটি সিদ্ধান্ত দেয়া আছে, কোনো বিভাগের কোনো পদ শূন্য হলে সেই পদের জন্য পরিকল্পনা কমিটি যদি ৩ মাসের মধ্যে বিজ্ঞপ্তি দিতে সুপারিশ না করে, সেক্ষেত্রে উপাচার্যকে পদটি পূরণে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মাঝেমধ্যে কোনো কোনো উপাচার্য ক্ষমতাটি প্রয়োগ করেছেন। এ ক্ষেত্রেও (আইন বিভাগের শিক্ষক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি) সেটিই ঘটেছে। এখানে দুটো পদ শূন্য হয়েছে।’
তবে চবি শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. মুস্তাফিজুর রহমান ছিদ্দিকী বলেন, ‘বিভাগে শিক্ষক দরকার আছে কি না, এর সম্পূর্ণটাই দেখবে পরিকল্পনা কমিটি। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে, পরিকল্পনা কমিটির সিদ্ধান্তকে পাত্তা না দিয়েই রেজিস্ট্রার অফিস থেকে বিজ্ঞাপন দিয়ে দেয়া হচ্ছে। এমন কোনো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি যেটার জন্য বিভাগের পরিকল্পনা কমিটির সিদ্ধান্তকে পাশ কাটিয়ে বিজ্ঞপন দিতে হবে। এটি ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশের লঙ্ঘন।’
এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতারের মোবাইল নম্বরে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি তা রিসিভ করেননি। ফলে তার মন্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।