রংপুর কালেক্টরেট স্কুল অ্যান্ড কলেজ প্রশাসনিক অনিয়ম, ক্ষমতার অপব্যবহার, অবৈধ নিয়োগ এবং আর্থিক অনিয়মের অভিযোগে তীব্র বিতর্কের কেন্দ্রে রয়েছে। প্রিন্সিপাল মঞ্জুয়ারা পারভিনকে অপসারণের পর থেকেই প্রতিষ্ঠানটির পরিবেশে জটিলতা দেখা দিয়েছে, যা জেলা প্রশাসন ও দুদকের নজরেও এসেছে।
তদন্ত ও অনুসন্ধান সূত্রে জানা যায়, শিক্ষক আলিউল করিম প্রামানিক, রাশেদ-উল-ইসলাম, মিলন, তোতা এবং এক প্রাক্তন সদস্যের নেতৃত্বে একটি প্রভাবশালী মহল পরিকল্পিতভাবে মব তৈরি করে। লক্ষ্য ছিল অধ্যক্ষকে জোরপূর্বক পদত্যাগ করতে বাধ্য করা এবং পরে আলিউল করিম প্রামানিককে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ করানো। অভিযোগ রয়েছে, জোরপূর্বক পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করানো হয়েছে।
প্রাথমিক তদন্ত শুরু হয় অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে তিন সদস্যের কমিটি দ্বারা। পরে তদন্তের ভার এডিসি (শিক্ষা)-এর কাছে হস্তান্তর করা হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় রিপোর্ট পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছে, তা এখনও কার্যকর হয়নি। দুদক জানিয়েছে, বিষয়টি জেলা প্রশাসনের অধীনে তদন্তাধীন। ২৫ ফেব্রুয়ারি ৩৪৩ নম্বর স্মারক অনুযায়ী, জেলা প্রশাসনকে কেবল প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে; রিপোর্ট পাঠানোর নয়। ফলে সভাপতির বক্তব্য ও সরকারি অবস্থান মেলেনি।
মো. রমিজ আলমকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, যিনি একই সঙ্গে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্বও পালন করছেন। অভিযোগ অনুযায়ী, এতে তদন্তের স্বচ্ছতা প্রশ্নবিদ্ধ। অধ্যক্ষকে কোনো শুনানি দেয়া হয়নি, এবং অভিযোগকারীর তালিকায় কোনো শিক্ষক বা কর্মচারীর নামও নেই।
প্রিন্সিপাল মঞ্জুয়ারা পারভিন বলেছেন, ‘চাকরিজীবনে আমি একটি টাকাও অবৈধভাবে গ্রহণ করিনি। পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন ছাড়া কোনো আর্থিক সিদ্ধান্ত নেইনি। সকল নিয়োগ ও পদোন্নতি জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে হয়েছে। আমার ছুটির আবেদনও উপেক্ষা করা হয়েছে; সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে এবং বেতন স্থগিত রাখা হয়েছে।’
শিক্ষা মন্ত্রণালয় অনুযায়ী, কোনো বিভাগীয় মামলা ১৮০ কার্যদিবসের মধ্যে নিষ্পত্তি না হলে বরখাস্তকৃত শিক্ষক স্বয়ংক্রিয়ভাবে পুনর্বহাল হবেন এবং বেতন-ভাতা পুনরায় প্রদান করা হবে। সরকারি নির্দেশনায় স্পষ্ট বলা হয়েছে- যতই ক্ষমতার খেলাবাজি বা প্রশাসনিক অবহেলা হোক, ন্যায় ও নীতির বিজয় নিশ্চিত। অধ্যক্ষ মঞ্জুয়ারা পারভিন আবেদন করেছেন, কিন্তু সভাপতি বা কর্তৃপক্ষ এখনও পদক্ষেপ নেননি। এটি শুধু একটি ব্যক্তির নয়, পুরো প্রতিষ্ঠানের ন্যায়পরায়ণতার পরীক্ষা।
অর্থনৈতিক অনিয়মের অভিযোগও ভিত্তিহীন প্রমাণিত হয়েছে। অধ্যক্ষের নামে ১২টি চেক উত্তোলনের অভিযোগের কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি। ব্যাংক ও হিসাব শাখা সূত্রে জানা যায়, চেকগুলো বেতন ও পাওনাদারদের টাকা বিতরণে ব্যবহৃত হয়েছে; কোনো চেকই অধ্যক্ষ নিজে উত্তোলন করেননি।
অধ্যক্ষ দাবি করেছেন, ২০১২ সালে যোগদানের সময় কলেজের ফান্ড প্রায় ৩.৫ কোটি টাকা ছিল; ২০২৪ সালের ২১ আগস্ট পর্যন্ত তা ১৯ কোটি টাকার বেশি হয়েছে। যদি দুর্নীতি হতো, ফান্ড এত বৃদ্ধি পেত কীভাবে?
কলেজের সব আয় অটোমেশন প্রক্রিয়ায় আনা হয়েছে। এতে আত্মসাতের পথ বন্ধ হয়েছে এবং আর্থিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শিক্ষার মান ও সহশিক্ষা কার্যক্রমে প্রতিষ্ঠানটি রংপুরের শীর্ষে। তবে এই পদক্ষেপই ক্ষুব্ধ করেছে একটি প্রভাবশালী গোষ্ঠীকে, যারা অধ্যক্ষকে সরানোর জন্য ষড়যন্ত্র চালিয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, শিক্ষক আলিউল করিম প্রামানিক পূর্বে একাধিকবার শাস্তি পেয়েছেন। বর্তমানে তিনি ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের ঘনিষ্ঠ হিসেবে কলেজের ব্যবস্থাপনায় প্রভাব বিস্তার করছেন। রাশেদ, তোতা ও মিলনসহ তাদের সহযোগীরাও রাজনৈতিক প্রভাব ও প্রশাসনিক ছত্রছায়ায় কার্যক্রম চালাচ্ছেন।
চাকরিচ্যুত কৃষি শিক্ষক আলতাফ হোসেনকে বেআইনি পুনঃনিয়োগ কেন্দ্র করে নতুন বিতর্ক তৈরি হয়েছে। ২০০৬ সালে চাকরিচ্যুত হওয়া সত্ত্বেও ২১ মে ২০২৫ তারিখে তাকে পুনঃনিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সভাপতি ডিসি রবিউল ফয়সালের প্রস্তাবে নিয়োগ ও বেতন প্রদানের ফলে হাইকোর্টের আদেশের পরিপন্থী হয়েছে। তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
বর্তমানে প্রতিষ্ঠান নিয়ম-শৃঙ্খলা ভঙ্গ, শিক্ষক-কর্মচারীর মধ্যে বিভাজন এবং প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলায় জর্জরিত। অনেক শিক্ষক ক্লাস না নিয়ে অনিয়ম করছেন, পরীক্ষার সন্মানি বিতরণেও বৈষম্যের অভিযোগ উঠেছে। আলিউল করিম প্রামানিক ও সহযোগীরা কিছু সরকারি কর্মকর্তাকে সুবিধা দিয়ে সিদ্ধান্তে প্রভাব বিস্তার করছেন।
প্রভাবশালী গোষ্ঠীর আধিপত্যের কারণে শিক্ষক-কর্মচারী প্রকাশ্যে মুখ খুলতে ভয় পাচ্ছেন। তবে অভিভাবক ও স্থানীয় বিশিষ্টজনরা বলছেন, ‘মঞ্জুয়ারা পারভিনের মতো সৎ ও দক্ষ অধ্যক্ষ প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য অপরিহার্য।’
একই সঙ্গে, শিক্ষার্থীদের অধিকারও ঝুঁকিতে। ক্ষমতার খেলায় পড়ুয়াদের শিক্ষার মান ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে- এটি শুধু প্রশাসনিক সমস্যা নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শিক্ষার নিরাপত্তারও প্রশ্ন উত্থাপন করছে।
রংপুর কালেক্টরেট স্কুল অ্যান্ড কলেজে অনিয়ম ও ক্ষমতার অপব্যবহার শুধুমাত্র একটি প্রতিষ্ঠানের নয়, পুরো শিক্ষাব্যবস্থার জবাবদিহিতার প্রশ্ন তুলে ধরেছে। ঘটনাগুলি প্রমাণ করছে, শক্তি ও পদমর্যাদার খেলায় ন্যায় ও নীতির বিজয় কতটা ঝুঁকিতে পড়তে পারে।