বাজারে এখন নানান ব্র্যান্ডের কাপড় কাচা সাবান, আছে গুঁড়া সাবানও। তবে এখন থেকে তিন দশক আগের দিনগুলোর কথা একবার ভাবুন- পণ্যের এত সমাহার সে সময় ছিল বিরল।
নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশে হাতে গোনা দুই-একটি কোম্পানি উৎপাদন করত কাপড় কাচা সাবান। আর ছিল আমদানি করা সাবানের কদর। এর মাঝে হঠাৎ করেই স্থানীয় প্রতিষ্ঠান আলম সোপ অ্যান্ড ফ্যাক্টরি লিমিটেড নিয়ে আসে আলমের ১ নং পঁচা সাবান। নামটি দৃশ্যত অদ্ভুত, দেখতেও খুব একটা ঝকঝকে নয়।
তবে কিছু দিনের মধ্যেই আলমের ১ নং পঁচা সাবান পৌঁছে যায় সাধারণ মানুষের ঘরে ঘরে। প্রান্তিক পর্যায়ে, বিশেষ করে নিম্নবিত্ত অনেক পরিবার আপন করে নেয় এই সাবান।
বিটিভির পাশাপাশি রেডিওতে পঁচা সাবানের জনপ্রিয় জিঙ্গেল এখনও হয়তো মনে করতে পারেন অনেকে- সাবান আছেমনের মতো কাপড় কাচে…আছে এমন সাবান আছেপঁচা সাবান, আলমের ১ নং পঁচা সাবান।
পঁচা সাবানের সেই সোনালি দিন এখন অতীত। চাহিদা থাকলেও, বাজারে বলতে গেলে চোখেই পড়ে না। মুক্তবাজার অর্থনীতির অসম প্রতিযোগিতার পাশাপাশি মালিকপক্ষের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততায় একসময়ের রমরমা ব্যবসা বলতে গেলে প্রায় বিলুপ্ত।
বাজার থেকে প্রায় উধাও
রাজধানীর একাধিক বাজার ঘুরেও পাওয়া যায়নি আলমের ১ নং পঁচা সাবান।
কারওয়ান বাজারের কিচেন মার্কেটের ব্যবসায়ী জসিম উদ্দিন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বেশ কয়েক মাস ধরেই বাজারে পঁচা সাবান নেই। কোম্পানির কোনো প্রতিনিধি চাহিদা নিতে আসে না। তবে ক্রেতারা মাঝেমধ্যেই এই সাবান চান।’
একই মার্কেটের ব্যবসায়ী খোরসেদ আলম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘একসময় এই সাবানের অনেক চাহিদা ছিল, তবে এখন পাওয়া যায় না। কাপড় কাচার বেশি সাবান নেই। আর পঁচা সাবানের চাহিদা থাকলেও সরবরাহ নেই।’
মিরপুরের ৬০ ফুট রাস্তার পাশের জহির জেনারেল স্টোরের শফিক জানান, পঁচা সাবান পাওয়া যায় না। বিক্রির জন্য কেউ নিয়ে আসে না।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, বেশ কয়েক মাস ধরেই বাজারে পঁচা সাবান নেই। ছবি: সংগৃহীত
ওই এলাকার দোকানি শওকত বলেন, ‘পুরোনো অনেক পণ্যই আমরা রাখি। এর আলাদা একটা ভোক্তা আছে, কিন্তু পঁচা সাবান খুঁজেও পাই না।’
শেওড়পাড়া আলম স্টোরের আলিম উদ্দিন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘পুরোনো পণ্যের ক্রেতা আছে, কিন্তু পঁচা সাবানের কোনো বিক্রয় প্রতিনিধি পাওয়া যায় না।’
- আরও পড়ুন: ক্ষয়ে যাচ্ছে সেই ‘অক্ষয়’ কসকো
রাজধানীর সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার মৌলভীবাজার ঘুরেও পঁচা সাবানের অস্তিত্ব পায়নি নিউজবাংলা। সেখানকার ব্যবসায়ীরা জানান, একটি প্যাকেটে ৪ পিস সাবান বাজারজাত করা হতো। খুচরা পর্যায়ে ৭০০ গ্রাম সাবানের দাম নেয়া হতো ৩৭ থেকে ৪০ টাকা।
একসময় পঁচা নামে ডিটারজেন্ট পাউডার বাজারে দেখা গেলেও সম্প্রতি বিভিন্ন দোকান খুঁজে এরও অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।
উৎপাদন কি একেবারেই বন্ধ
‘নামে নয়, গুণে পরিচয়’- এমন প্রচারে একসময় যে পঁচা সাবান অসংখ্য ভোক্তার হৃদয় জয় করেছিল, সেটির উৎপাদন এখন প্রায় শূন্যের কোঠায়।
কোথায়, কী পরিমাণে এই সাবান উৎপাদন হচ্ছে, তা নিয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্যও পাওয়া যায়নি।
আলম সোপ অ্যান্ড ফ্যাক্টরি লিমিটেডে দুই দশক চাকরি করছেন এমন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘৯০-এর দশকের দিকে আলমের পঁচা সাবান বাজারজাত করা হয়। তবে এখন উৎপাদন নেই বললেই চলে। বন্ধের পথে রয়েছে সব কারখানা।’
তিনি জানান, সাবান তৈরির উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় চাহিদা অনুযায়ী পণ্য সরবরাহ করা যাচ্ছে না। তা ছাড়া প্রতিযোগিতাপূর্ণ বাজারে টিকে থাকার সক্ষমতাও কোম্পানির নেই।
কারখানায় তৈরি হচ্ছে পঁচা সাবান। ছবি: সংগৃহীত
তিনি বলেন, ‘বর্তমানে আমাদের চারটি কারখানা রয়েছে। মূল কারখানা কাঁচপুর ব্রিজের কাছে অবস্থিত। এ ছাড়া বাইপাইল, পুরান ঢাকার মৌলভীবাজারেও আছে কারখানা। কাঁচপুর কারখানায় সামান্য পরিমাণে সাবান উৎপাদন হয়। অন্য তিন কারখানা বন্ধের পথে। একেক কারখানায় ১৫ থেকে ২০ জন মিলে চার কারখানাতে ৬০ জনের মতো কর্মরত আছেন।’
ওই কর্মকর্তা জানান, আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে পণ্যের বিজ্ঞাপন দেয়া থেকেও তারা সরে এসেছেন। বর্তমানে এ খাতে কোনো বরাদ্দ নেই।
ব্যবসা পরিচালনার লাইসেন্স না থাকায় ২০১৫ সালে জরিমানার মুখে পড়ে আলম সোপ অ্যান্ড ফ্যাক্টরি লিমিটেডের সিদ্ধিরগঞ্জের সাবান কারখানা। বিএসটিআইএর অনুমোদন ও পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের লাইসেন্স না থাকায় এই কারখানাটিকে জরিমানা করে ভ্রাম্যমাণ আদালত।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, কোম্পানিটির গাজীপুর কারখানার কাগজপত্রের মেয়াদও ২০১২ সালে শেষ হয়ে যায়। কারখানাটিতে সে সময় শিশু শ্রমিক দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করানোর অভিযোগ ওঠে।
প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তা জানান, ২০১৫ সালে জরিমানার মুখে পড়ার পর লাইসেন্স নবায়ন করা হয়।
কারখানায় পঁচা সাবান তৈরিতে ব্যস্ত শ্রমিকরা। ছবি: সংগৃহীত
বিএসটিআইয়ের পরিচালক রেজাউল হক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আলমের পঁচা সাবানের তিনটি ইউনিটের লাইসেন্স নবায়ন করা আছে। সেগুলো হলো লালবাগ, বৃহত্তর সাভার এবং নারায়ণগঞ্জ কারখানা।’
তিনি বলেন, ‘২০১৫ সালে যখন অভিযান পরিচালনা করা হয়, তখন পণ্য উৎপাদনের জন্য যে লাইসেন্স প্রয়োজন, তা নবায়ন করা ছিল না। পরে ওই প্রতিষ্ঠান আগ্রহী হয়ে লাইসেন্স নবায়ন করেছে।’
স্বস্তিতে নেই মালিক
আলমের ১ নং পঁচা সাবান উৎপাদন করে আলম সোপ অ্যান্ড ফ্যাক্টরি। প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শরীফুল আলম কিশোরগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি।
জেলাভিত্তিক রাজনীতিতে টিকে থাকা এবং কর্মসূচিকেন্দ্রিক নানা সংকটে জড়িয়ে ব্যবসায় মনোযোগ হারিয়েছেন শরীফুল আলম।
জানা যায়, শরীফুল আলম ২০০০ সালের দিকে পোল্ট্রি ফিড ব্যবসার পাশাপাশি হোটেল ও ট্যুরিস্ট ব্যবসায় সম্পৃক্ত হন। ২০১৩ সালে তিনি সিআইপি সম্মাননা লাভ করেন।
শরীফুল আলমের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে নিউজবাংলা। তার মোবাইল ফোনটিও বন্ধ পাওয়া গেছে।