সাম্প্রতিক সময়ে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত নতুন কোম্পানির শেয়ার লেনদেনের পর সর্বোচ্চ পরিমাণ দাম বৃদ্ধির যে প্রবণতা দেখা গেছে, লাভেলো আইসক্রিমের (লেনদেন হচ্ছে তৌফিকা ফুডস অ্যান্ড এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামে) ক্ষেত্রেও সেটি দেখা যাচ্ছে।
প্রথম দিন আইপিও দামের ৫০ শতাংশ বেশিতে ১৫ টাকায় বিক্রেতা ছিল না বললেই চলে। প্রথম দিন লেনদেন হয় ১৭ হাজারের মতো শেয়ার।
- আরও পড়ুন: নতুন শেয়ার: লোকসান গুনে শিক্ষা হলো কি?
দ্বিতীয় দিন আরও ৫০ শতাংশ বেশি দরে ২২ টাকা ৫০ পয়সাতেও খুব বেশি বিক্রেতা পাওয়া যায়নি। তবে প্রথম দিনের তুলনায় বেশি শেয়ার লেনদেন হয়েছে সর্বোচ্চ দামে। ৫০ হাজার ১৯১টি শেয়ার হাতবদল হয়েছে।
সর্বোচ্চ দামে এক কোটি ৬০ লাখ শেয়ার কেনার আদেশ ছিল সকালে।
রোববার থেকে স্বাভাবিক নিয়মে ১০ শতাংশ বাড়তে অথবা কমতে পারবে কোম্পানিটির শেয়ার। এ হিসাবে সর্বোচ্চ দাম হতে পারবে ২৪ টাকা ৭০ পয়সা। আর সর্বোচ্চ কমলে দাম হবে ২০ টাকা ৩০ পয়সা।
নতুন তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ার দরে লাগাম টানতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি এই শেয়ারেও সার্কিট ব্রেকার বসিয়েছে। এমনিতে একটি শেয়ারের দর দাম ভেদে দিনে পাঁচ থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে।
তবে নতুন তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো আইপিও দরের চেয়ে প্রথম দুই কার্যদিবসে ৫০ শতাংশ করে বাড়তে বা কমতে পারে। তবে এর পর থেকে স্বাভাবিক সার্কিট ব্রেকার প্রযোজ্য হবে অর্থাৎ ১০ শতাংশ উঠানামা করতে পারবে।
এই নিয়ম প্রবর্তন হওয়ার আগে প্রথম দিন কোনো সীমা ছিল না দামের। এমন দেখা গেছে আইপিও দরের ১৬ গুণ দামে বিক্রি হয়েছে শেয়ার।
নতুন শেয়ার উচ্চমূল্যে কিনে বিনিয়োগকারীরা যেন লোকসানে না পড়েন, সে জন্য সার্কিট ব্রেকার বসানোর পরেও খুব একটা লাভ হয়েছে এমন নয়।
একাধিক বিনিয়োগকারীর সঙ্গে কথা বলে এটা বোঝা গেছে, তাদের বহুজন ভাবেন প্রথম দুই দিন ৫০ শতাংশ করে দাম বাড়বে। আর এই সুযোগে কারসাজির চেষ্টা হয়।
গত ডিসেম্বর থেকে পুঁজিবাজারে ক্রমাগতভাবে বিনিয়োগ বাড়ার পাশাপাশি বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার দরে ঘটে উল্লম্ফন। এক পর্যায়ে গত ৩০ জানুয়ারি বিএসইসি তিন হাজার কোটি টাকা লেনদেনের আশা প্রকাশ করে।
কিন্তু এর পরের কার্যদিবস থেকে কমতে থাকে লেনদেন। কদিন আগেও যে বাজারে টানা ১০ দিন গড়ে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে, সেই বাজারে বৃহস্পতিবার এক হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে ১১ কার্যদিবস পরে। তাও আবার দুটি কোম্পানির লেনদেন হয়েছে ৪৫০ কোটি টাকা। এগুলো বাদ দিলে লেনদেন ছিল ছয়শ কোটি টাকা মাত্র।
লেনদেন কেন এত কমল- সেই বিষয়টি নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। তবে সদ্য তালিকাভুক্ত তিনটি কোম্পানির শেয়ার লেনদেনের চিত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, রবি, এনার্জিপ্যাক ও মীর আকতারের শেয়ারেই ১৪০০ কোটি টাকার বেশি টাকা আটকে গেছে বিনিয়োগকারীদের।
একইভাবে সদ্য তালিকাভুক্ত ডমিনোস, ক্রিস্টাল ইন্স্যুরেন্সের লোকসানও কাটিয়ে উঠতে পারেনি বিনিয়োগকারীরা। এগুলোতেও বিপুল পরিমাণ অর্থ হয় আটকে আছে, নয় ক্ষতি স্বীকার করে বিক্রি করে বের হয়েছেন তারা।
নানা সময় দেখা যায়, নতুন শেয়ার এলেই কোম্পানির মৌলভিত্তি, শেয়ারপ্রতি সম্পদমূল্য ও আয়, লভ্যাংশ দেওয়ার সম্ভাবনা বিবেচনা না করেই হুমড়ি খেয়ে পড়েন অনেক বিনিয়োগকারী। আর এই হুলুস্থুল শেষে দাম কমে এলে তাদের অর্থ আটকে যায় দীর্ঘদিনের জন্য। কেউ কেউ বড় লোকসান দিয়ে বের হন।
বিনিয়োগকারী নজরুল বলেন, ‘সম্প্রতি বেশ কিছু কোম্পানির শেয়ারের শুরুর প্রথম কয়েকদিন আইপিওতে প্রাপ্ত কেউ শেয়ার বিক্রি করতে চান না। দর বেড়ে যখন অতিমূল্যায়িত হয়ে যায় তখন বিক্রি করা হয়, আর সাধারণ বিনিয়োগকারীরা সেগুলো ক্রয় করে লোকসানে থাকে।’
তিনি বলেন, ‘না বুঝে শেয়ার কেনার পর যখন ক্রমাগত দর কমতে থাকে, তখন তারা হতাশ হয়। এজন্য শেয়ারের দর যখন অতিমূলায়িত হয়ে যায় তখন না কেনাই শ্রেয়।’
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক আবু আহমেদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সাধারণ বিনিয়োগকারীদের নতুন কোম্পানির শেয়ার কেনার ক্ষেত্রে সচেতন হতে হবে এবং কখন শেয়ার কিনতে হবে সেটা কোম্পানির আর্থিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে কেনা উচিত।’
নতুন শেয়ারে সবচেয়ে বেশি ধরা রবিতে
গত ২৪ ডিসেম্বর বহুজাতিক কোম্পানি রবির শেয়ার লেনদেন শুরু হলে তৈরি হয় হুলস্থুল। ১৪ কার্যদিবস টানা সর্বোচ্চ বেড়ে দাম দাঁড়ায় ৭৭ টাকা। সেদিনই আবার দাম কমে হয় ৭১ টাকায়। সেই শেয়ারই এখন বিক্রি হচ্ছে ৪৪ টাকা ৮০ পয়সা।
সবচেয়ে বেশি শেয়ার লেনদেন হয় গত ১২ জানুয়ারি। সেদিন লেনদেন হয় ছয় কোটি ৬২ লাখ ৫৮ হাজার ৭৯৫টি শেয়ার। সেদিন দাম ছিল ৬৩ টাকা ২০ পয়সা।
এই দামে যারা শেয়ার কিনেছেন, তারা প্রতি শেয়ারে লোকসানে আছেন প্রায় ২০ টাকা। সাড়ে ছয় কোটি শেয়ারে লোকসান দাঁড়ায় ১৩০ কোটি টাকার বেশি।
১৪ জানুয়ারি ৭০ টাকায় লেনদেন হয়েছে এক কোটি ৯৫ লাখ ৪৬ হাজার ৩৬টি শেয়ার।
সেদিন যারা শেয়ার কিনেছেন, তারা লোকসানে আছেন ২৬ টাকার মতো। তাদের আটকে আছে ৫০ কোটি টাকার মতো।
১৭ জানুয়ারি তিন কোটি ৯৯ লাখ ৯৮ হাজার ৬২৩টি শেয়ার লেনদেন হয়েছে ৬৪ টাকা ৫০ পয়সায়। সেদিন যারা কিনেছেন, তারা শেয়ার প্রতি ২০ টাকার মতো লোকসানে আছেন।
এই হিসাবে প্রায় ৮০ কোটি টাকা আটকে আছে সেদিনের বিনিয়োগকারীদের।
১৮ জানুয়ারি ৫৮ টাকা ৫০ পয়সায় তিন কোটি ৭৯ লাখ ৯ হাজার ৮৭৭টি শেয়ার লেনদেন হয়েছে। সেদিন যারা কিনেছেন, তারা লোকসানে আছেন ১৪ টাকা দরে।
সেদিনের বিনিয়োগকারীদের আটকে গেছে ৫৫ কোটি টাকার মতো।
১৯ জানুয়ারি দুই কোটি ৬৩ লাখ ৬৬ হাজার ১৭২টি শেয়ার লেনদেন হয় ৫৭ টাকা ৪০ পয়সায়।
১৩ টাকা করে লোকসানের হিসাবে সেদিনের বিনিয়োগকারীদের আটকে দেখে ৩০ কোটি টাকার বেশি।
২০ জানুয়ারি দুই কোটি ১৪ লাখ ৮৯ হাজার ৪৯৬টি শেয়ার বিক্রি হয়। সেদিন ক্লোজিং দাম ছিল ৬৩ টাকা ১০ পয়সা।
১৯ টাকা করে লোকসানে থাকা বিনিয়োগকারীদের আটকে গেছে ৪২ কোটি টাকার বেশি।
এই কয় দিনেই রবির শেয়ারে বিনিয়োগকারীরা হারিয়েছেন ৫২০ কোটি টাকার বেশি, অথবা তাদের বিনিয়োগ আটকে গেছে।
এর আগে পরের কয়েকটিদের লেনদেন হিসাব করলে টাকার অংকটা যে সাড়ে ৭০০ থেকে ৮০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে, সেটি নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।
এনার্জিপ্যাকও হাওয়া করেছে ৫০০ কোটি টাকার বেশি
বড় লোকসানে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের এনার্জি প্যাকের শেয়ারেও। ৩১ টাকায় তালিকাভুক্ত কোম্পানিটির শেয়ার গত ১৯ জানুয়ারি লেনদেন শুরু করে। মূল্য টানা বেড়ে এক পর্যায়ে উঠে যায় ১০১ টাকায়। সময় লাগে মাত্র পাঁচ কার্যদিবস।
এরপর কমতে কমতে শেয়ারের দর দাঁড়িয়েছে ৫১ টাকা ৭০ পয়সায়।
এই কোম্পানির শেয়ার সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয়েছে ২৬ জানুয়ারি। সেদিন হাতবদল হয় এক কোটি ২১ লাখ ৮০ হাজার ৫৭৬টি। সেদিন দাম ক্লোজ হয় ৮৩ টাকা ৪০ পয়সা।
সেদিন যারা শেয়ার কিনেছিলেন, তাদের প্রায় ৪০ টাকা করে হাওয়া হয়ে গেছে। এদের আটকে গেছে প্রায় ৫০ কোটি টাকা।
সেদিনের পর সবচেয়ে বেশি শেয়ার লেনদেন হয়েছে ২৭ জানুয়ারি, হাতবদল হয় ৪৭ লাখ চার হাজার ৫৭০টি শেয়ার। সেদিন দাম ছিল ৭৬ টাকা ৪০ পয়সা।
সেদিন যারা কিনেছেন, তাদের শেয়ার প্রতি ২৫ টাকা করে হাওয়া হয়ে গেছে। তাদের আটকে গেছে ১২০ কোটি টাকার বেশি।
২৮ জানুয়ারি লেনদেন হয় ৩৪ লাখ ১৭ হাজার ৭৯৬টি শেয়ার, দাম ছিল ৭১ টাকা ৭০ পয়সা।
সেদিন যারা কিনেছেন, তারা লোকসানে আছেন ২০ টাকা করে। তাদের আটকে গেছে ৬৮ কোটি টাকার বেশি।
৩১ জানুয়ারি লেনদেন হয় ৪৬ লাখ ৩৬ হাজার ৩৮৯টি শেয়ার। দাম ছিল ৬৬ টাকা ৪০ পয়সা।
সেদিন যারা কিনেছেন, তারা লোকসানে আছে ১৫ টাকা করে। তাদের আটকে গেছে ৭০ কোটি টাকার মতো।
এই কয়দিনের লেনদেনে বিনিয়োগকারীদের লোকসান হয়েছে ৪৩৫ কোটি টাকার বেশি। এই অর্থটাও আটকে গেছে।
এর আগে পরের লেনদেন হিসাব করলে হাওয়া হয়ে যাওয়া টাকার পরিমাণ ৫০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়।
মীর আকতারে কদিনেই লোকসান শত কোটি টাকার বেশি
গত ২ ফেব্রুয়ারি তালিকাভুক্ত হওয়া মীর আকতারের শেয়ারেও শত কোটি কারা বেশি লোকসানে বিনিয়োগকারীরা আট কার্যদিবসেই।
আশুগঞ্জে মির আকতারের বিদ্যুৎকেন্দ্র
সাধারণ বিনিয়োগকারীরা এই শেয়ার পেয়েছেন ৫৪ টাকায়। প্রথম দিন ৮১ টাকা পর্যন্ত দাম বাড়তে পারত। আর বেড়েছেও।
দ্বিতীয় দিন বাড়ার সুযোগ ছিল ১২১ টাকা ৫০ পয়সা। লেনদেন শুরুর আগেই সেই দামে ক্রয়াদেশ দেখে সন্দেহ হয় বিএসইসির। তারা দুটি বিও হিসাবের বিষয়ে খোঁজ নিতে শুরু করে। তখন সেই ক্রয়াদেশ তুলে নেয়া হয়। আর সেদিন পরে লেনদেন হয় ৯৫ থেকে ১১৭ টাকায়। দিন শেষে ক্লোজ হয় ১০০ টাকায়।
পরের দুই কার্যদিবসে দাম ১০ শতাংশ করে কমে আবার ৮১ টাকায় দাঁড়ায়। এরপর দুই দিন উঠানামা করে বৃহস্পতিবার দর দাঁড়িয়েছে ৮৮ টাকা ৫০ পয়সা।
অর্থাৎ যারা দ্বিতীয় দিন ৯৫ থেকে ১১৭ টাকায় শেয়ার কিনেছে, তারা এরই মধ্যে বড় লোকসানে আছেন।
এই কোম্পানির সবচেয়ে বেশি শেয়ার লেনদেন হয়েছে ৩ জানুয়ারি। সেদিন হাতবদল হয় ৪৯ লাখ ৮৪ হাজার ৮৯১টি শেয়ার। সেদিন যাকা কিনেছেন, তারা প্রতি শেয়ারে সর্বনিম্ন সাত টাকা থেকে সর্বোচ্চ ২৯ টাকা লোকসানে আছেন।
এই শেয়ারে বিনিয়োগকারীরাও সব মিলিয়ে ১০০ থেকে ১৫০ কোটি টাকা লোকসানে আছেন।
কী শিক্ষা নিল লাভেলো কেনায় আগ্রহীরা
তৌফিকা ফুডস অ্যান্ড এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামে লেনদেন শুরু করা কোম্পানিটি তালিকাভুক্ত হয়েছে ১০ টাকায়।
বুধবার প্রথম দিনের লেনদেনে সর্বোচ্চ ১৫ টাকা হতে পারত দাম। হয়েছেও তাই।
দ্বিতীয় দিন বৃহস্পতিবার দাম সর্বোচ্চ হতে পারত ২২ টাকা ৫০ পয়সা। হয়েছেও তাই।
এই শেয়ারের ভবিষ্যত দর কোথায় দাঁড়ায় তা এখন বলার সুযোগ নেই।
জুন ক্লোজিং এই কোম্পানির শেয়ার প্রতি সম্পদমূল্য আইপিওর আগে ছিল ১২ টাকা ৭৫ পয়সা, যা আইপিওর পরে কমে দাঁড়িয়েছে ১১ টাকা ৭৮ পয়সা।
চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে কোম্পানির আয় আইপিও পূর্ববর্তী শেয়ারের বিবেচনায় শেয়ারপ্রতি ছিল ৫০ পয়সা, যা আইপিওর পরে দাঁড়িয়েছে ৩২ পয়সা।
বৃহস্পতিবার যে দর দাঁড়িয়েছে তাতে প্রাইস আর্নিং রেশিও বা পিই দাঁড়ায় ২২.৫। অর্থাৎ এই হারে আয় করলে আগামী ২২ বছরে বিনিয়োগ উঠবে।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত তিন শতাধিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কমপক্ষে ৬০টি প্রতিষ্ঠান আছে, যার পিই ১০ এর কম। এমনকি দুই এর কমেও আছে কিছু মিউচ্যুয়াল ফান্ডের।