উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নায়ক, স্বাধীন বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টা, মুসলিম জাগরণের অগ্রনায়ক, লাহোর প্রস্তাবের উপস্থাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার রূপকার ও লাঞ্চিত বঞ্চিত ও শোষিত কৃষক প্রজার মুক্তিদাতা হিসেবে এ উপমহাদেশের ইতিহাসে উজ্জ্বল নক্ষত্ররূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক। ব্রিটিশ শাসকদের দুঃশাসনে এ উপমহাদেশের মুসলমানরা যখন ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছিল, ইংরেজদের প্রতি ঘৃণায় ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণে বিরত ছিল ঠিক সে সময়ে ১৮৭৩ সালের ২৬ অক্টোবর মধ্যরাতে বরিশালের রাজাপুর থানার সাতুরিয়া গ্রামে মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ১৮৮৭ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। শিক্ষা জীবনে তিনি অত্যন্ত তীক্ষ্ম, প্রতিভাধর ও মেধাবী শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি গণিত, পদার্থ ও রসায়ন মোট তিনটি বিষয়ে অনার্স পাস করেন। বাঙালী মুসলমানদের মধ্যে তিনিই প্রথম তিনটি বিষয় নিয়ে অনার্স করেন। পরবর্তীতে ১৮৯৫ সালে গণিতে এম.এ পাস করেন এবং ১৮৯৭ সালে ইউনিভার্সিটি ল কলেজ থেকে বিএল ডিগ্রী লাভের মধ্য দিয়ে পাঠ পর্ব শেষ করেন। ১৮৯৭ সালে স্যার আশুতোষ মুখার্জির শিক্ষানবিস হিসেবে কলকাতা হাইকোর্ট কর্মজীবন শুরু করেন। আইন ব্যবসা ছেড়ে ১৯০৬ সালে ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেটের চাকরি গ্রহণ করেন। পরে সরকারি চাকরি ত্যাগ করে পুনরায় আইন ব্যবসায় মনোনিবেশ করেন। এ.কে ফজলুল হক নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহ মানসপত্র ছিলেন। তার সযত্ন তত্ত্বাবধানেই পরবর্তীতে শেরে বাংলা সারা ভারতবর্ষের রাজনৈতিক অঙ্গনে মহীরূপে অবির্ভূত হয়েছিলেন। তিনি মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস উভয় দলের নেতা ছিলেন। তিনি ১৯১৪ সালে কৃষক প্রজা সমিতি গঠন করেন। পরবর্তীতে তার গঠিত কৃষক প্রজা পার্টি ১৯৩৭ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করলে তিনি বাংলার প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে জয়লাভ করলে পূর্ব পাকিস্তানের মূখ্যমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৯১৩ সাল হতে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত আইন সভার সদস্য, ১৯২৪ সালে শিক্ষামন্ত্রী ১৯৫৬-৫৮ সালে পূর্ব পাকিস্তানের গবর্নর ছিলেন। তিনি শিক্ষা বিস্তারে অভূতপূর্ব ভূমিকা পালন করেন। বাংলার মুসলমানদের শিক্ষা বিস্তারে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় তিনি মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। তিনি ছিলেন অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষার প্রধান উদ্যোক্তা। তিনি মাদ্রাসা শিক্ষার প্রধান উদ্যোক্তা। তিনি মাদ্রাসা শিক্ষায় সারকারি সাহায্যের ব্যবস্থা করেন এবং মুসলমানদের শিক্ষায় অগ্রসরতা বৃদ্ধির জন্য স্কুল, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও মেডিক্যাল কলেজ আসন নির্দিষ্ট করে দেন। নারী শিক্ষার প্রসারতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৯৩৯ সালে লেডি ব্রার্বোন কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন এবং সকল বালিকা বিদ্যালয়ে আর্থিক বরাদ্ধ বৃদ্দি করেন। এছাড়াও ঐতিহাসিক চাখার ফজলুল হক কলেজ, সেন্ট্রাল উইমেন্স কলেজ, কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ, ঢাকা ইডেন গার্লস কলেজে ভবন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের এ.কে. ফজলুল হক হলসহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠান তার সদিচ্ছার ফসল। তিনি কৃষি শিক্ষা বিস্তারে বাংলাদেশ কৃষি ইনস্টিটিউট, পশু চিকিৎসা কেন্দ্র ও তেজগাঁও কৃষি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারের জন্য প্রত্যেক জেলায় স্কুল বোর্ড প্রতিষ্ঠা করেন এবং নিরক্ষরতা দূরীকরণের জন্য তিনি প্রাথমিক বয়স্ক শিক্ষা কমিশন এবং মাদ্রাসা শিক্ষাকে আধুনিক করার জন্য মাওলাবক্স কমিটি গঠন করেন। কমিটির সুপারিশে জুনিয়র মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা হয়। শেরে বাংলা কৃষক ও প্রজা সাধারণের প্রাণের বন্ধু ছিলেন। কংগ্রেস, মুসলিমলীগ ও অন্যান্য দলের জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ, ভূমি ও কৃষি সংস্কারের সদিচ্ছার অভাব উপলদ্ধি করেই কৃষক প্রজা পার্টি গঠন করেছিলেন এবং বাংলার প্রধানমন্ত্রী হয়ে ঋণ সালিশী বোর্ড গঠন করে কৃষকদের মহাজনদের শোষণমুক্ত করেছিলেন। তিনি ফ্লাউড কমিশন নিয়োগ করে জমিদারদের শোষণ মুক্ত করার জন্য সচেষ্ট ছিলেন। তার সময়ে সে সমবায় আইনি ও বিধি প্রণীত হয়েছিল, এরই ফলশ্রুতিতে হাজার হাজার সমবায় সমিতি গঠিহ হয় যা কৃষি ও শিল্প ক্ষেত্রে যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করে। পল্লী উন্নয়য়নের জন্য পল্লী মঙ্গল সমিতি ও কুটির শিল্পের ব্যবস্থার পাশাপাশি সুচিকিৎসার ব্যবস্থা, পানীয়জলের ব্যবস্থা, পয়:প্রণালী ব্যবস্থার যথেষ্ট উন্নতি সাধন করেন। তিনি মুসলিম জাগরণের অগ্রপথিক ছিলেন। বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব লাভের পর অনগ্রসর মুসলমানদের পৃষ্ঠপোষকতার লক্ষ্যে চাকরির ক্ষেত্রে ৫০% আসন সংরক্ষিত রাখার নির্দেশ দেন। অপরদিকে তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। তিনি হিন্দু মুসলমানদের সম্প্রীতি রক্ষার জন্য ১৯২৩ সালে বেঙ্গল প্যাক্ট ও ১৯১৬ সালে লাখনৌ প্যাক্ট প্রণয়নে মূখ্য ভূমিকা পালন করেন। তিনি ১৯৪০ সালে ২৩ মার্চ ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। তিনি আসাম-বাংলা নিয়ে আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলেন। ১৯৩৭ সালে ১৫ অক্টোবর লাখনৌ শহরে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের সম্মেলনে অপূর্ব ভাষণ শ্রবণ করে লাখনৌবাসী তাকে শেরে বাংলা উপাধিতে ভূষিত করেন। তিনি বাংলার প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং নববর্ষকে সরকারি ছুটি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। তারই উদ্যোগে পাকিস্তানে ১৯৫৬ সালে শাসনতন্ত্রে বাংলা ভাষা অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি এবং ২১ ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস ঘোষণা করা হয়।এ.কে. ফজলুল হক কঠিন করোনারী থ্রোমসিস রোগে আক্রান্ত হয়ে আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে পড়েন। ১৯৬২ সালে ২৭ এপ্রিল সকাল ১০টা ২০ মিনিটে ৮৯ বছর ৬ মাস বয়সে একজন শ্রেষ্ঠ দেশপ্রেমিক, সেরা সমাজ সংস্কারক সর্বোপরি একজন শ্রেষ্ঠ মানুষের দেহাবসান ঘটে। ২০০৪ সালের মার্চ এপ্রিলে বিবিসি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ২০ জন বাঙালির নাম ঘোষণা করেছির। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক। আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় বলেছিলেন- ‘ফজলুল হক মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত বাঙালি’। সেই সংঙ্গে তার মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত সাচ্চা মুসলমান। খাটি বাঙালি আর সাচ্চা মুসলমানের এমন সমন্বয় আমি আর দেখিনি।ড. দেওয়ান আযাদ রহমান
লেখক: গবেষক ও প্রবন্ধকার।