বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ভেজাল-নকলের বিষচক্র: যেখানে জীবন ও জীবিকা উভয়ই নিঃস্ব

  • সম্পাদকীয়   
  • ২৫ অক্টোবর, ২০২৫ ১৮:৪৭

নকল আর ভেজালের সর্বগ্রাসী থাবা আজ আমাদের সমাজদেহের প্রতিটি পরতে এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছে যে, মানুষের জীবন ও জীবিকা উভয়ই আজ এক গভীর সংকটের মুখে। একুশ শতকের এই তথাকথিত আধুনিক সময়ে দাঁড়িয়েও যখন খাদ্য থেকে শুরু করে নিত্য ব্যবহার্য সামগ্রী, এমনকি জীবন রক্ষাকারী ওষুধেও ভেজালের রমরমা কারবার চলে, তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, জাতিগতভাবে আমরা এক ভয়াবহ নৈতিক স্খলনের মধ্য দিয়ে চলেছি। এই ভেজাল সংস্কৃতি শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতিসাধন করে না, বরং মানুষের স্বাস্থ্য, বিশ্বাস এবং সামাজিক ভিত্তিকে দুর্বল করে দিয়ে একটি জাতিকে নিঃস্বতার দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দেয়।

মানুষের মৌলিক চাহিদার মধ্যে অন্যতম হলো নিরাপদ খাদ্য ও স্বাস্থ্যসেবা। কিন্তু বাজারে আজ যে খাদ্যদ্রব্য পাওয়া যায়, তার কতটুকুই বা নির্ভেজাল? কৃষিপণ্যে ক্ষতিকারক রাসায়নিকের ব্যবহার থেকে শুরু করে ফল পাকাতে কার্বাইড, মাছ তাজা রাখতে ফরমালিন, দুধে সাবান বা স্টার্চের মিশ্রণ, মসলায় ইটের গুঁড়ো, এই তালিকা যেন অন্তহীন। মুনাফা লাভের এক অন্ধ প্রতিযোগিতায় এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী মানুষের জীবন নিয়ে নির্দ্বিধায় ছিনিমিনি খেলছে। এই ভেজাল খাবার খেয়ে মানুষ আপাতদৃষ্টিতে হয়তো পেট ভরাচ্ছে, কিন্তু বিনিময়ে তাদের শরীরকে ঠেলে দিচ্ছে দুরারোগ্য ব্যাধির দিকে। ক্যান্সার, কিডনি ফেইলিওর, লিভারের মারাত্মক সমস্যা এবং অন্যান্য জটিল রোগ আজ ঘরে ঘরে। আর এসব রোগের চিকিৎসা করাতে গিয়ে সাধারণ মানুষ তাদের সঞ্চয়, সম্পত্তি এমনকি ভিটেমাটিও হারাচ্ছে। একসময় যারা সচ্ছল ছিল, তারাও চিকিৎসার বিপুল ব্যয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ছে। রোগভোগের শারীরিক কষ্টের চেয়েও বড় হয়ে দাঁড়ায় অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের যন্ত্রণা।

দীর্ঘমেয়াদে এই ভেজাল সংস্কৃতি একটি জাতিকে অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যগত উভয় দিক থেকেই পঙ্গু করে দেয়। স্বাস্থ্যখাতে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় জাতীয় বাজেটের একটি বড় অংশ চলে যাচ্ছে রোগ প্রতিরোধের পরিবর্তে রোগ নিরাময়ের দিকে। অথচ এই অর্থ যদি শিক্ষা, গবেষণা বা অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যয় করা যেত, তবে দেশের সার্বিক প্রবৃদ্ধি আরও দ্রুত হতো। ভেজাল খাদ্য গ্রহণের ফলে একটি শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, যা জাতির ভবিষ্যতের জন্য এক অশনি সংকেত। শিশুরা সঠিক পুষ্টি থেকে বঞ্চিত হওয়ায় তাদের মেধা ও কর্মক্ষমতা কমে যাচ্ছে, যা ভবিষ্যতে দেশের মানবসম্পদকে দুর্বল করে দেবে। অর্থাৎ, ভেজাল চক্র কেবল বর্তমান প্রজন্মকে নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও নিঃস্ব করে দিচ্ছে।

এই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন একটি বহুমুখী এবং সমন্বিত উদ্যোগ। প্রথমেই দরকার কঠোর আইনের প্রয়োগ এবং নিয়মিত মনিটরিং। ভেজালকারীদের জন্য দ্রুত বিচার এবং সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান নিশ্চিত করতে হবে, যাতে অন্যরা এমন জঘন্য কাজ করার সাহস না পায়। আদালত এবং সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলোকে এক্ষেত্রে শূন্য সহনশীলতা নীতি অবলম্বন করতে হবে। নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা এবং বড় বড় ভেজাল কারখানার বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে অপরাধীদের জনসম্মুখে নিয়ে আসতে হবে। শুধু জরিমানা নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি কারাদণ্ড এবং সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের মতো কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

আমরা সবাই যদি একযোগে এই ভেজালের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই, তবেই কেবল সম্ভব একটি সুস্থ ও নিরাপদ সমাজ গঠন করা। অন্যথায়, এই নকল ও ভেজালের সর্পিল চক্রের জালে আবদ্ধ হয়ে মানুষ তার অর্থ, স্বাস্থ্য এবং সর্বোপরি জীবনের শান্তি হারিয়ে কেবলই নিঃস্ব হতে থাকবে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য আর দেরি করা নয়, এখনই প্রয়োজন জাতীয় চেতনার উন্মেষ এবং সম্মিলিত প্রতিরোধের মাধ্যমে এই ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধিকে চিরতরে নির্মূল করা। এই সংগ্রাম কেবল অর্থনৈতিক বা আইনি নয়, এটি মূলত মানবতা ও নৈতিকতার পক্ষে এক ঐতিহাসিক লড়াই। এই লড়াইয়ে জয়ী না হলে আমাদের আগামী প্রজন্ম এক অসুস্থ, প্রতারণাপূর্ণ এবং নিঃস্ব সমাজে বড় হবে, যা কারও কাম্য হতে পারে না। এই ভয়াবহ জাল থেকে মুক্তিই এনে দিতে পারে জাতির অর্থনৈতিক মুক্তি ও মানবিক মর্যাদা।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

এ বিভাগের আরো খবর