বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

বিচারের নামে সেনাবাহিনী নিয়ে যেন প্রহসন না হয়

  • সম্পাদকীয়   
  • ২৫ অক্টোবর, ২০২৫ ২৩:২০

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে গুম সংক্রান্ত ‘মানবতা বিরোধী অপরাধের’ মামলায় একযোগে ২৫ জন সাবেক ও বর্তমান সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি-- এমন ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রায় নজিরবিহীন। বিশেষ করে তাদের মধ্যে ১৫ জন বর্তমানে কর্মরত হওয়ায় বিষয়টি শুধু সেনা সদর নয় পুরো দেশজুড়ে আলোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে পরিণত হয়েছে।

এ বিষয়ে সেনাপ্রধানের বক্তব্য স্পষ্ট করে জানান। ‘আমরা সব সময় ন্যয়ের পক্ষে। ইনসাফের সঙ্গে কোন আপস নেই। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সংবিধান ও রাষ্ট্রীয় আইনের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল।’ আদালতের আদেশ পাওয়ার পরই বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল দেখিয়ে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। সেনাবাহিনী কর্তৃপক্ষ অভিযুক্ত ১৬ কর্মকর্তাকে স্বেচ্ছায় হেফাজতে আত্মসমর্পণের নির্দশ দেয়।তাদের মধ্যে ১৫ জন ইতোমধ্যে সেনা হেফাজতে এসেছেন একজন অনুপস্থিত রয়েছেন।

-তবে একই সঙ্গে সেনা সদর স্বীকার করে হঠাৎ এ ধরনের ঘটনা সেনা সদস্যদের মনোবলে সাময়িক প্রভাব ফেলেছে এবং তাদের দিয়েই ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মাদ ইউনূসের ভাষ্য মোতাবেক ইতিহাসের সেরা নির্বাচন করার পরিকল্পনা ও রয়েছে।

সেনা সদর মনে করে বিচার প্রক্রিয়া যেভাবে উপস্থাপিত হয়েছে তা অনেক সময় একটি প্রতিষ্ঠানের সামগ্রিক ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

এ বিষয়ে সাবেক সেনা কর্মকর্তাদের অভিমত হলো কেউ অপরাধ করে থাকলে আইন অনুসারে তার বিচার হবে। বিচারে দোষী সাব্যস্ত হলে তার শাস্তি হবে। লক্ষ্য করা যাচ্ছে যেভাবে বিঢয়টি উপস্থাপন করা হয়েছে তাতে বিচারের আগেই শাস্তির ঘটনা ঘটছে। সেনাবাহিনীকে মিডিয়া ট্রায়ালের স্বীকার করা হচ্ছে।

অথচ অভিযুক্তরা ঘটনার সময় কেউ কেউ ডিজিএফআই ও সরকারী অন্যান্য সংস্থায় কর্মরত ছিলেন এসব সংস্থায় পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছে।

‘ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. জাহেদুর রহমান বলেন, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের --সেটি সশস্ত্র বাহিনী হোক, বিচার বিভাগ হোক, বা প্রশাসন বিভাগ হোক সবার নিজস্ব মর্যাদা আছে, দেশের জন্য দশের জন্য ভূমিকা আছে। আমরা যখন সেই প্রতিষ্ঠানের কোনো সদস্যের কৃতকর্মের জন্য ঢালাওভাবে সেই প্রতিষ্ঠানকে দোষারোপ করি অথবা তার ইমেজকে সংকটে ফেলে দিই তখন সেই প্রতিষ্ঠানটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।সেই প্রতিষ্ঠানের সদস্যদের কর্মস্পৃহা উদ্দীপনা হ্রাস পায়। আমরা বর্তমানে যে ঘটনা যে দেখছি সশস্ত্র বাহিনীর যেসব সদস্য গুম বা এ সংক্রান্ত অপরাধে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছে তারা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের একটি মামলায় এসেছেন। মামলা হওয়াটা স্বাভাবিক। আসতেই হবে। কেউ তার কৃতকর্মের জন্য দায়মুক্তি পেতে পারেন না। সেটি আইনের বরখেলাপ হবে।দেশের মানুষের প্রতি অন্যায় করা হবে। অবশ্যই অপরাধ করে থাকলে তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। বিচারের আওতায় আনার প্রক্রিয়াকে আমি স্বাগত জানাই। সশস্ত্র বাহিনী ও এটাকে স্বাগত জানিয়েছে। সশস্ত্র বাহিনী ও একটি নিয়মের মধ্যে দিয়েই যাচ্ছে, যাতে সুষ্ঠুভাবে তাদের বিচারের সামনে দাঁড় করানো যায়। কিন্তু এই প্রক্রিয়ার মধ্যে যদি আমরা সশস্ত্র বাহিনীকেই কালিমা লিপ্ত করি তাহলে দেশের জন্য সশস্ত্র বাহিনীর যে অবদান সেটিকে প্রশ্নের মধ্যে ফেলে দিচ্ছি। এ ক্ষেত্রে আমার পর্যবেক্ষণ ---ব্যক্তিকে দোষারোপ করব প্রতিষ্ঠানকে নয়। কিছু গণমাধ্যম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনকের বক্তব্য শুনেছি। এতে দুঃখজনক ঘটনা লক্ষ্য করা গেছে। আমি ৩৪ বছর সশস্ত্র বাহিনীতে কাজ করেছি। কেউ অপরাধ করে থাকলে তাকে দায় নিতে হবে। আমি অপরাধ করলে আমি কি বলব--- প্রতিষ্ঠান এটা আমাকে শিখিয়েছে। অবশ্যই শিখায়নি। লোভে হউক রাজনৈতিক চাপে হউক আমি লেজুড়বৃত্তি করে থাকলে আমার বিচার হবে। আমার প্রশিক্ষণ প্রণোদনায় ভুল ছিল না। বাহিনী আমাকে অপরাধ করতে শিখিয়ে দেয়নি। আমি আমার প্রতিষ্ঠানের শেখানো মন্ত্রের বাহিরে গিয়ে কাজ করে থাকলে তার দায় আমাকেই নিতে হবে। আমরা যেন চেষ্টা করি শুধু সশস্ত্র বাহিনী নয় যে প্রতিষ্ঠানগুলো আছে ---যারা দেশের কাজে ওতোপ্রোতোভাবে জড়িত সেই প্রতিষ্ঠানকে যেন দোষারোপ না করি।’

অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের বিচার কোন আইনে হবে--সেনা আইন নাকি আইসিটি আইনে-এ নিয়ে কোন সাংঘর্ষিক অবস্থান আছে কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে সেনাবাহিনীর অ্যাডজুটেন্ট মেজর জেনারেল মো. হাকিমুজ্জামান বলেছেন ‘আইসিটি আইন বনাম সেনা আইন- এটা না বলাই ভালো মুখোমুখি বিষয়টি না বলাই ভালো।

তিনি আরও বলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-আইসিটি আইনে বলা আছে যে ---অভিযোগ পত্রে নাম উঠলে চাকরি চলে যাবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো অভিযুক্ত কি আসলে সাজাপ্রাপ্ত? সাজা হওয়ার পরও কিন্তু আপিলের সুযোগ থাকে। আপিল নিষ্পত্তির পর যদি সাজা বহাল থাকে তখনই তাকে সাজাপ্রাপ্ত বলা যাবে। আবার দেখা যাবে কেউ খালাস পেয়ে গেলেন----তাহলে আইন অনুযায়ী তিনি আবার সার্ভিসে ফিরে যেতে পারবেন।

মেজর জেনারেল মো. হাকিমুজ্জামান বলেন অনেকের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতি হতে পারে।কেউ মানসিকচাপে অসুস্থ হয়ে যেতে পারেন, কেউ হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হন---- এসব মানবাধিকার লঙ্গন নয়, এই প্রশ্ন ও আছে।

সেনাবাহিনীতে চলমান নিয়মের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন,’ কোন কর্মকর্তার বিচার চলাকালীন সময়ে তার বয়স শেষ হয়ে গেলে তিনি অবসরে যাবেন। তখন খালাস পেলেও তাকে চাকরিতে ফেরানো যাবে না। তাই ট্রাইব্যুনাল আইনের বিষয়ে আমরা যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে ব্যাখ্যা চাইব। চার্জসিটে নাম থাকা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে সেনা আাইনে কোন পদক্ষেপ নেওয়া যাবে কিনা জানতে চাইলে মেজর জেনারেল মো. হাকিমুজ্জামান বলেন গুম সংক্রান্ত একটি জাতীয় কমিশন আছে যাদের আমরা সর্বত্মক সহযোগিতা করে আসছি। সেনাবাহিনী আলাদা করে কোন কমিশন করিনি। বাংলাদেশ আর্মি ন্যায়বিচারের প্রতি অটল----যা ন্যায়সঙ্গত হবে আর্মি তার পক্ষেই থাকবে।

তিনি আরও বলেন গুম কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রতিষ্ঠান হিসেবে এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত নয়। আমাদের কিছু কর্মকর্তা হয়তো ব্যাব বা ডিজিএফআইয় এ ছিলেন, কিন্তু তখন তারা আর্মিতে সক্রিয় দায়িত্বে ছিলেন না।ব্যাব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ডিজিএফআই প্রধান মন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে। বর্তমানে এটি উপদেষ্টা পরিষদের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে।’

অভিযুক্ত সেনা কর্মকর্তাদের বিচার সামরিক আইনে করা যেতে পারে কিনা--- সে প্রশ্ন রয়েছে। এ বিষয়ে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মুহাম্মদ সাজ্জাদ সিদ্দিক (সেনাবাহিনীর সাবেক জাজ অ্যাডভোকেট জেনারেল) বলেন সেনা আইনের ৫৭(২)ধারা অনুসারে গুমের সঙ্গে যেহেতু খুনের বিষয়টি ও জড়িত সে কারণে অভিযুক্তদের বিচার সামরিক আদালতে করা যাবে না। মুহাম্মদ সাজ্জাদ সিদ্দিক তার পেজবুক পেজে এ বিষয়ে বিস্তারিত লিখেছেন।

সেনাকর্মকর্তাদের বিচারের ব্যাপারে এরি মধ্যে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো মতবাদ ব্যক্ত করেছেন যেমনটি বিএনপির বক্তব্যে এসেছে --বিএনপি যুগ্ন মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে বিষয়টি নিয়ে দলের অবস্থান তুলে ধরা হয়।উল্লেখ করেন বাংলাদেশ জাতীয়বাদী দল –‘বিএনপি বিশ্বাস করে, দেশের গণতন্ত্র মানবাধিকার ও সেনাবাহিনীর পেশাদারি রক্ষায় সংশ্লিষ্ট অপরাধের সুষ্ঠু ও নির্মোহ বিচার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ন্যায়বিচার শুধু অতীতের ঘটনাগুলোর শাস্তির নিশ্চয়তা দেয় না বরং ভবিষ্যতে যেন কেউ এমন অন্যায়ের পুনরাবৃত্তি না ঘটায় সেই নিশ্চয়তা দেয়।আইন ও মানবাধিকারের প্রতি পূর্ণাঙ্গ শ্রদ্ধা রেখেই হতে পারে একটি শান্তিপূর্ণ জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্রের ভিত্তি।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, কিছু চিহ্নিত ব্যক্তির দায় যেমন কোন প্রতিষ্ঠানের ওপর চাপানো উচিত নয়, তেমনি তাদের অপকর্মের কারণে সেই প্রতিষ্ঠানকে প্রশ্নবিদ্ধ করা ও অনুচিত। একজন মানুষের কাজের ভালো মন্দের দায় বিশেষত গুরুতর অপরাধের শাস্তি একান্তই তার নিজের।’

জামায়াত যা বলেছে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুকে পেজে লিখেছেন, ‘দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে নিয়ে বাংলাদেশের জনগন গর্বিত থাকতে চান। দুঃখজনক হলেও সত্য, বাহিনীর কিছু সদস্য দেশের বিদ্যমান আইন ও মানবাধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শনে ব্যর্থ হয়েছেন। ফ্যাসিষ্ট সরকারের প্ররোচনায় প্রতিপক্ষ নিধনের এজেন্ডা বাস্তবায়নে তারা অন্ধ সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন। ফলে গুম ও খুনের একটি ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। তবে সুনির্দিষ্ট কয়েকজন ব্যক্তির অপরাধের কারণে পুরো প্রতিষ্ঠানকে কলংকিত হতে দেওয়া যায় না। অপরাধের দায় কেবল সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ওপরই বর্তাবে। এরই মধ্যে সেনাবাহিনী এই বিচার প্রক্রিয়াকে সহায়তা করার ঘোষণা দিয়েছে এবং অভিযুক্ত ব্যক্তিদের হেফাজতে নিয়েছে। আমরা সেনাবাহিনীর এ উদ্যোগকে স্বাগত জানাই।’

দেশের স্বাধীনতা সুরক্ষা করা ও দেশের ক্লান্তি লগ্নে সবার আগে এগিয়ে আসা, জাতিসংঘের শান্তি রক্ষা মিশনে অবদান রাখা আমরা কোনটাই তাদের অবদানকে খাটো করে দেখতে চাই না। বিচারের নামে মিডিয়া ট্রায়াল যা কিছু বলি না কেন সেনাবাহিনী আমাদের গর্বের।ফ্যাসিবাদী সরকারের অবসানে সেনাবাহিনীর ভূমিকা কম নয় বরং অগ্রনী ভূমিকা ছিল বলেই কাঙ্ক্ষিত ফলাফল এসেছে। বর্তমানে আমাদের সেনাবাহিনী দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে মাঠে অতন্দ্র প্রহরীর মত দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। প্রকৃতপক্ষে যারা অপরাধী তাদের বিচার হবে এটা স্বাভাবিক কিন্তু বিচারের নামে যেন প্রহসন না হয় সেইদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।দেশে আইনের শাষন প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায়ে নিরপেক্ষভাবে বিচার প্রক্রিয়া সম্পাদন করা লক্ষ্যে অভিযুক্ত সেনা কর্মকর্তাদের আইনি প্রক্রিয়া নিয়ে যেন অযথা মন্তব্য বা বিতর্কে আমরা না জড়াই এটাই হবে নাগরিক হিসেবে সকলের নৈতিক দায়িত্ব।

লেখক : কলামিস্ট ও ব্যাংকার।

এ বিভাগের আরো খবর