সূরা আহযাব, পর্ব ৩
অনুবাদ:
(৬) এই নবী মুমিনদের নিকট তাদের নিজেদের চেয়েও ঘনিষ্টতর ও অগ্রগণ্য এবং তার স্ত্রীগণ তাদের মা। আর আল্লাহর বিধান অনুযায়ী (উত্তরাধিকারে) সাধারণ মুমিন ও মুহাজিরদের চেয়ে আত্মীয়-স্বজনরা একে অপরের বেশি নিকটতর, তবে যদি তোমরা বন্ধুবান্ধবের সাথে দয়ার আচরণ করতে চাও, করতে পার। এটা আল্লাহর কিতাবে লিপিবদ্ধ আছে। (৭) আর (স্মরণ কর,) যখন আমি অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলাম সকল নবীর নিকট থেকে, তোমার নিকট থেকে, এবং নূহ, ইবরাহীম, মূসা ও মারইয়াম-পুত্র ঈসা থেকেও; আর তাদের নিকট থেকে গ্রহণ করেছিলাম মযবূত অঙ্গীকার, (৮) যাতে করে (কিয়ামতের দিন আল্লাহ) সত্যবাদীদেরকে তাদের সত্যবাদিতা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতে পারেন। আর আল্লাহ কাফিরদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক আযাব প্রস্তুত করে রেখেছেন।
মর্ম ও শিক্ষা:
ইসলামে নবীর মর্যাদা ও গুরুত্ব:
আলোচ্য আয়াতে নবীর মর্যাদা ও গুরুত্বের কথা বলা হয়েছে। ইসলামী জীবনাদর্শের নবী ও রাসূলের গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ আল্লাহ তাদেরকে সমস্ত মানবতার মধ্য থেকে নবুওয়তের জন্য নির্বাচন করেছেন। তাদের মাধ্যমেই আল্লাহ তার জীবনাদর্শ মানুষের নিকট পৌঁছে দেন। তাদের সম্মান যদি না দেয়া হয় এবং তাদের আনুগত্য যদি না করা হয়, তাহলে ইসলামী জীবন-ব্যবস্থাই ভেঙে পড়ে। সেহেতু কোরআনে বলা হয়েছে, হে মানুষ, তোমরা আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করো। অর্থাৎ মর্যাদা ও সম্মানের দিক দিয়ে আল্লাহর পরেই রাসূলের স্থান। আল্লাহর আনুগত্য যেমন অপরিহার্য, তেমনি রাসূলের আনুগত্য অপরিহার্য।
মুহাম্মদ (স.) মুমিনদের নিজেদের প্রাণের চেয়েও অগ্রগণ্য :
আয়াতে বলা হয়েছে, মুমিনদের নিকট নবী মুহাম্মদ (স) তাদের নিজেদের জীবনের চেয়েও বেশি অগ্রগণ্য। কারণ নবী মুহাম্মদ (স) তাদের আদর্শিক নেতা। তিনি তাদের কল্যাণের দিকে খেয়াল রাখেন। মানুষ প্রবৃত্তির টানে এই দুনিয়ার জীবনে যা ইচ্ছা তা করতে পারে। প্রবৃত্তির আকর্ষণে মানুষের মন এমন কিছু চাইতে পারে, যা তার জন্য ক্ষতিকর। রাসূল মুহাম্মদ (স.)-এর আদর্শ এক্ষেত্রে তাকে ক্ষতি থেকে রক্ষা করে। অর্থাৎ রাসূল মুহাম্মদ (স.)-এর আদর্শ তাকে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক ক্ষতি, কষ্ট ও দুর্ভোগ থেকে বাঁচায়। সুতরাং রাসূল মুহাম্মদ (স.)-এর আদর্শ প্রাণের চেয়ে অগ্রগণ্য, কারণ তার আদর্শ প্রাণ রক্ষা করে। পিতা যেমন সন্তানকে ক্ষতিকর বিষয় থেকে ফিরিয়ে রাখে, রাসূল মুহাম্মদ (স.)-এর আদর্শ তেমনি মানুষকে ক্ষতি থেকে রক্ষা করে।
বৈষয়িক স্বার্থ থেকে আদর্শিক স্বার্থ অগ্রগণ্য
আখিরাতের বিবেচনায়ও রাসূল (স) ও তার আদর্শ মুমিনের নিজের প্রাণের চেয়ে অগ্রগণ্য। কারণ, মানুষের মন এমন কিছু কামনা করতে পারে, যা দুনিয়ার স্বাদ লাভে সহায়ক, কিন্তু আখিরাতে শাস্তির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। সুতরাং বৈষয়িক স্বার্থ থেকে আদর্শিক স্বার্থ তথা রাসূলের আদর্শ অগ্রাধিকার পাবে। কারো বৈষয়িক স্বার্থ আর আদর্শিক বা দীনি স্বার্থ যদি সাংঘর্ষিক হয়, তাহলে আদর্শিক স্বার্থই অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত। বলাবাহুল্য, রাসূল মুহাম্মদ (স.)-এর আদর্শই দীনি স্বার্থ। কাজেই রাসূল মুহাম্মদ (স.)-এর আদর্শ যদি প্রাণের চেয়ে অগ্রণী হন, তাহলে নিজের বৈষয়িক স্বার্থ ত্যাগ করে আদর্শিক স্বার্থকেই গ্রহণ করা উচিত।
নবীর স্ত্রীগণ মায়ের মতো সম্মানিত:
রাসূল (স.) যদি পিতার মতো অথবা পিতার চেয়েও বেশি সম্মানিত হন, তাহলে মুহাম্মদ (স.)-এর পবিত্র স্ত্রীগণ হবেন মুমিনদের মায়ের মতো (আয়াত ৬)। মাকে যেমন সম্মান ও মর্যাদা দিতে হয়, মুহাম্মদ (স.)-এর পবিত্র স্ত্রীগণকেও তেমনি বা তার চেয়ে বেশি সম্মান দিতে হবে। এর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এই যে, নবী মুহাম্মদ (স.)-এর পবিত্র স্ত্রীগণ তার সাথে বসবাস করার দরুন পারিবারিক অসংখ্য মাসয়ালা তারা জানতেন। অন্যরা রাসূল (স.)-এর পবিত্র স্ত্রীদের কাছ থেকেই জেনে নিতেন। কারণ অনেক সময় এমন বিষয়ের প্রশ্ন থাকতো, যা রাসূল (স.)-কে জিজ্ঞেস করতে তারা লজ্জা পেতেন। মুহাম্মদ (স.)-এর মৃত্যুর পর তার পবিত্র স্ত্রীগণকেও বিয়ে করা যাবে না, যেমন মাকে বিয়ে করা জায়েয নয়। তবে অন্যান্য বিষয়ে মাতৃত্বের সম্পর্ক প্রযোজ্য নয়, যেমন তাদের মেয়ে বোন হয়ে যায় না, এবং তাদের বোন খালা হয়ে যায় না এবং তাদের রেখে যাওয়া সম্পত্তির ওয়ারিশী অংশ পাওয়া যাবে না ইত্যাদি। যেমন যুবায়ের (রা.) মা আয়েশার বোন আসমাকে বিয়ে করেছিলেন। যদি রাসুল (স.)-এর স্ত্রীর বোন হওয়ার কারণে তিনি খালা হয়ে যেতেন তাহলে তাকে বিয়ে করা জায়েয হতো না।
ইসলামি ভ্রাতৃত্ব:
এখানে আনসার ও মুহাজিরদের ভ্রাতৃত্বের চেয়ে নিকটাত্মীয়ের সম্পর্ককে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের প্রেক্ষাপটে ইসলামিক ভ্রাতৃত্বের বিষয়টি উপলদ্ধি করা উচিত, যা ইসলামিক ভ্রাতৃত্বের গভীরতা প্রকাশ করে। রাসূল (স.)-এর সাথে এবং তার পরে অনেক সাহাবী মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করেন। তারা তাদের সহায়-সম্পদ আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে মক্কা থেকে মদীনায় যান খালি হাতে। রাসূল (স.) তখন একজন মুহাজিরের সাথে একজন আনসারের ভ্রাতৃত্ব সৃষ্টি করে দেন। সে বন্ধন এতো গভীর ছিল যে তারা একে অপরের উত্তরাধিকারী হতেন। এরপর যখন হিজরতকারীদের অন্যান্য আত্মীয় স্বজন মদীনায় চলে আসে এবং স্বাচ্ছন্দ্য ফিরে আসে, তখন আলোচ্য আয়াত দ্বারা সে মাত্রার ভ্রাতৃত্ব রহিত হয়ে যায়। অর্থাৎ আনসার ও মুহাজিররা ভাই ভাই থাকে, কিন্তু একে অপরের উত্তরাধিকারী হওয়ার নিয়ম রহিত হয়ে যায়। আলোচ্য আয়াতে বলা হয়েছে, আনসার ও মুহাজিরদের ভ্রাতৃত্বের চেয়ে আত্মীয়ের বন্ধন অধিকতর মজবুত। কাজেই আত্মীয় স্বজনই একে অপরের উত্তরাধিকারী হবে, এবং আনসার ও মুহাজিরদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের কারণে আর কেউ কারো উত্তরাধিকারী হবে না।
রক্ত সম্পর্কের আত্মীয়দের অধিকার :
আলোচ্য আয়াতের বক্তব্য থেকে রক্ত সম্পর্কের আত্মীয়ের অধিকার সম্পর্কে বুঝা যায়। কোরআনে বারবার আত্মীয়ের অধিকার প্রদানের কথা বলা হয়েছে। আত্মীয়ের বিশেষ অধিকারের কথা কোরআনের আরেকটি বর্ণনা থেকে উপলদ্ধি করা যায়। আখিরাতে জান্নাতিরা তাদের পরিচিত জাহান্নামীদের প্রশ্ন করবে, দুনিয়াতে আমরা একসাথে ছিলাম, এখন তোমরা কি কারণে দোযখে গেলে? তখন জাহান্নামীরা একটা একটা করে সেসব কারণ বলবে এবং তাদের মধ্যে একটা কারণ হলো আত্মীয়ের সাথে ভালো ব্যবহার না করা এবং তাদের সাথে সুসম্পর্ক না রাখা। অর্থাৎ আত্মীয়ের সাথে সুসম্পর্ক না রাখা জাহান্নামে যাওয়ার কারণ।
রক্ত সম্পর্কের ভিত্তিতে উত্তরাধিকার বণ্টন:
ইসলামী জীবনাদর্শে মৃত ব্যক্তির সম্পদ বণ্টনের সুনির্দিষ্ট রূপরেখা দেয়া হয়েছে। উত্তরাধিকার বণ্টন হবে আত্মীয়তার নৈকট্যের ভিত্তিতে। কোন্ আত্মীয় কতটুকু পাবে, তা বিস্তারিত বর্ণনা আছে, যা বাধ্যতামূলক। উত্তরাধীকারী তার নির্ধারিত অংশের বেশি পাবে না। তার জন্য বাড়তি কিছু ওসীয়ত করে যাওয়া নিষেধ। ওসীয়ত করা যাবে শুধু উত্তরাধিকারীর বাইরে, অন্যের জন্য, যার সর্বাধিক পরিমাণ হলো সম্পদের এক তৃতীয়াংশ। তৎকালীণ মদীনার আনসার ও মুহাজিরদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের প্রেক্ষাপটে এই দাঁড়াল যে, তাদের কিছু ওসীয়ত করা যেতে পারে। তবে তা কখনো সম্পদের এক তৃতীয়াংশের বেশি হবে না। বাকীটুকু অবশ্যই কুরআনে নির্ধারিত বণ্টন নীতি অনুযায়ী নৈকট্যের ভিত্তিতে বণ্টিত হবে। আসলে এটা হলো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের মধ্যে সুষম সম্পদ বণ্টনের একটি সুন্দর ব্যবস্থা, যা অন্য কোনো ধর্মে বা ব্যবস্থায় এভাবে নেই। কোন কোন ধর্মে শুধু পুত্র সন্তান উত্তরাধিকারী হয়। আর কোন ব্যবস্থায় উত্তরাধিকারী বণ্টনের ব্যবস্থাই নেই, বরং মৃত ব্যক্তি যাকে যতটুকু খুশি তাকে ওসিয়ত বা উইল করে দিতে পারে।
কিয়ামতের দিন নবীদের দায়িত্বের জবাবদিহিতা:
বলা হয়েছে, আল্লাহ কিয়ামতের দিন সত্যবাদীদেরকে তাঁদের সত্যবাদিতা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন। এর একাধিক মর্ম হতে পারে। তন্মধ্যে একটি হলো, কিয়ামতের দিন আল্লাহ নবীদেরকে তাদের দায়িত্ব পালন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন। তাদের যে জীবন-ব্যবস্থা দেয়া হয়েছিল, তারা তা তাদের জাতির নিকট পৌঁছে দিয়েছেন কিনা, এ ব্যাপারে জবাবদিহি করতে হবে। আলোচ্য জবাবদিহিতার আরেকটি অর্থ হলো, আল্লাহ নবীদেরকে জিজ্ঞেস করবেন, তাদের জাতি তাদের দাওয়াতে কেমন সাড়া দিয়েছিল। অর্থাৎ নবীগণকে তাদের জাতির সাক্ষ্য হিসাবে দাঁড় করানো হবে। তারা সাক্ষ্য দেবেন, কারা তাদের ডাকে সাড়া দিয়েছিল, আর কারা তা প্রত্যাখ্যান করেছিল। এসব তথ্য সহকারে সাক্ষ্য দেওয়া তাদের জন্য কঠিন হওয়ার কথা, কিন্তু আল্লাহই তাঁদেরকে এ ব্যাপারে সাহায্য করবেন।
নবীদের জিজ্ঞাসার মাধ্যমে বাতিলপন্থীদের ভ্রান্তি প্রমাণ করা:
খ্রিষ্টানসহ কোন কোন জাতি নবীগণকে প্রভু বা প্রভুপুত্র হিসাবে বিশ্বাস করে এবং উপাসনা করে। আল্লাহ কিয়ামতের দিন সংশ্লিষ্ট নবীদের জিজ্ঞেস করবেন, তারা কি তাদের জাতিকে এ দাওয়াত দিয়েছিলেন যে তারা তাদেরকে প্রভু বা প্রভুপুত্র হিসাবে গ্রহণ করুক এবং তাদের উপাসনা করুক। তখন নবীগণ নেতিবাচক উত্তর দিবেন। বলবেন, তারা তা কখনো করেন নি। যদি করে থাকেন, তাহলে আল্লাহই ভালো জানতেন। এভাবে নবীগণকে প্রশ্নের মাধ্যমে বাতিলপন্থিদের ভুল প্রমাণিত হবে।