পরিমিতিবোধ সবসময় সুখকর। সীমার বাইরে সবকিছু প্রত্যাশার অতীত। জল যেমন দুকূলের ভেতর দিয়ে বয়ে গেলে নদী হয়, কূল ছাপালে বন্যায় রূপ নেয়, একসময়ের শান্ত, সুদৃশ্য প্রিয় দরিয়া হয়ে ওঠে বেদনা-দায়ী, সর্বনাশী বানভাসী জলের উচ্ছ্বাস.. আগুনের ব্যাপারও তেমন। অল্পতাপে শীতের আরাম। বেশি শিখায় বন পুড়ে ছাই। সে হোক না মন কিংবা সঘন পাতার, বৃক্ষঘন বন। তবে অল্প, নিয়ন্ত্রিত আগুন-রূপী আলো অন্ধকারের বিপরীতে স্বচ্ছ-উদার।
কথায় আছে, “Keep a little fire burning, however small, however hidden.”(Cormac McCarthy)./ “The most powerful weapon on earth is the human soul on fire” (Ferdinand Foch / “One must never let the fire go out in one’s soul, but keep it burning.” (Vincent Van Gogh)| প্রেরণার আগুন প্রজ্জ্বলিত রাখা শুধু উচিতই নয়, আবশ্যকও। সেই উদ্দীপনার শিখা যত ছোট কিংবা যত গোপন হোক না কেন, তা জীবন্ত রাখা জরুরি। যে জিনিসে চলমানতা নেই, চঞ্চলতা যার স্বভাবের সংগে সামঞ্জস্য বয়ে আনে না, তাতে অবসন্ন সময়ের শেওলা জমে। থির পাথরের মতো পড়ে থাকে গহীন অরণ্যে কিংবা জানার বাইরে, সবার চোখের আড়ালে। এইকথা প্রযোজ্য হয়, ব্যক্তি-প্রতিভা থেকে নিয়ে পরিবার, সমাজ অথবা আরও বড় পরিসরে।
তবে সমস্যা হয় তখনই, যখন উৎসাহ-রূপ উত্তাপ রূপ নেয় সীমাহীন স্বার্থপরতায়। আত্মতুষ্টির অশান্ত আগ্রহে উপকারী উপাদানটিকে ব্যবহার করে ফেরে শোভন-সীমা না মনে রেখেই। চুলোর আগুন চালে নিয়ে আসে স্বার্থপরেরা। সম্প্রতি দেশে ধারাবাহিক আগুন-ঘটনা এবং জান ও মালের বিস্তর ক্ষতিতে কোনো অন্তর অক্ষত থাকতে পারে না। দুর্ঘটনা কারও মুখ চেয়ে আসে না। তবে যেসব ব্যাপারে ইচ্ছাকৃত অশান্তি সৃষ্টির ইশারা মেলে, সেগুলো তদন্তের দাবি রাখে। চোখের দীপ্তি নিভে গিয়ে অপরাধীদের হৃদয়ে জ্বলতে থাকে সর্বনাশের শিখা। সেখানে তারা আপন-পর দেখে না। নিজ দেশের, নিজ জাতির মানুষ, কিংবা স্বদেশের সুরক্ষিত সম্পদ তাদের কাছে ছাই মনে হয়। বিদ্বেষ ও প্রতিশোধ পরায়ণতায় ভুলে যায় মানুষ হিসেবে হিতকর কী কী করণীয় তাদের সৃষ্টি জগতের প্রতি। নিশ্চিত না জেনে, কাউকে সন্দেহবশত দোষারোপ করা সঠিক নয়। তবে ঘটনা-পরম্পরা ও প্রকৃতি আভাস দেয়, এ নিছক দুর্ঘটনা নাও হতে পারে। তখনই আসে, ব্যাপক তদন্ত ও কারণ অনুসন্ধানের।
একসময় দেশের গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিগুলোতে ঘন ঘন আগুন লেগে যেত। কত যে নিরিহ শ্রম-প্রাণ নারী-পুরুষ পুড়ে মারা গিয়েছেন তার সঠিক খবর নেই। গুমোট পরিবেশ, বিদ্যুতের ঝুঁকিপূর্ণ সংযোগ ব্যবস্থা, বিপদে-নিরাপদে কর্মচারীদের দ্রুত বের হয়ে আসার অপর্যাপ্ত ও অব্যবস্থা, ইত্যাদি কারণে গার্মেন্ট বা অন্যান্য মিল কারখানাগুলোতে আগুন লেগে মৃত্যু ও ক্ষয়ক্ষতির খবর ছড়িয়ে পড়ত প্রায়ই। অনার্স প্রথম বর্ষের সময় ধানমন্ডি ভূতের গলিতে থাকাকালে, পাশেই দেখতাম, হামিদ গার্মেন্টে কীভাবে কাজ করে যাচ্ছেন তারা। সেখানে, নারীরাই কাজ করতেন বেশি। টিউব লাইটের আলোয়, নানা রঙের কাপড় খণ্ডের সংগে সংগে তাদের শ্রমজীর্ণ মুখমণ্ডলও চিক চিক করে উঠত ঘামে, উজ্জ্বল আগুনের শিখার মতো। সৌভাগ্য ও সুখের বিষয়, সেই স্থানে সবসময় সুন্দর, সাবলীল ও শালীন পরিবেশ দেখেছি। আগুন তাদের স্পর্শ করতে পারেনি।
মাটির বাড়ির খড়ের চালে আগুন ধরে যাওয়া একসময় সাধারণ দৃশ্য ছিল গ্রাম গ্রামান্তরে। বিশেষ করে রান্নাঘর থেকে শুরু হতো আগুন। চুলায় রান্না রেখে হয়তো মা দুধের শিশু ঘুম থেকে উঠে পড়ার কারণে, তাকে আনতে গিয়েছেন, বা আবার ঘুম পাড়াতে গিয়েছেন অন্য ঘরে, এদিকে পাটকাঠির ফেঁসো (পাটের ছাল ছুলে নেওয়ার পরে, পাটকাঠির গায়ে লেগে থাকা নরোম, ফোলা ফোলা পাট-সুতো, পাটের আঁশ বা সুতোর সূক্ষ্ম অংশ) বেয়ে চিলিক মেরে উঠে গিয়েছে আগুন চাল অবধি। অথবা খোলা উনুনের ফুলকি হাওয়ায় ভেসে খড়ের গাদায় গিয়ে পড়ে আগুনের উৎস হতো। কিংবা বালকেরা পাটকাঠির আগায় আগুন লাগিয়ে খেলার ছলে অগ্নিকাণ্ড ঘটাত। তখন পাড়ার লোকজন চিৎকার শোনে এগিয়ে আসত। যে যা হাতের কাছে পেত, তাতে পানি ভরে ছুঁড়ে দিত উপরে, আগুনের অস্থির দগ্ধ-লোলুপ জিহবার ওপরে। এ রকম অগ্নিকাণ্ড অপরাধহীন ও সত্যিকার দুর্ঘটনা। পরিস্থিতি ও নির্দোষ অসতর্কতার ফল। আর পাড়া প্রতিবেশীও দ্রুত ছুটে আসতেন বিপদ উদ্ধারে। কিন্তু, এমনও ইতিহাস আছে, প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে নিজের চালে আগুন দিতে দ্বিধা করত না কেউ কেউ। থানায় গিয়ে মামলা করে আসত। এগুলো, নিরেট সত্য ঘটনা কোনো কোনো স্থানের। কথা হলো, অনিচ্ছাকৃত, অসতর্কতাবশত, ও পরিস্থিতির শিকারে অগ্নি-ঘটনা এবং ইচ্ছাকৃত, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও পরিকল্পিত অগ্নি-সংযোগের মধ্যে মিল হতে পারে না।
বৃষ্টির শীতল শান্ত আকাশে বজ্র আসে। এ এমন প্রচণ্ড শক্তিধর যে এর উৎসের এলাকায় যদি খুব ভারী প্রকাণ্ড লোহার বাক্সও এসে যায়, মুহূর্তে তা চ্যাপ্টা হয়ে যায়। এই বিদ্যুৎ আকাশে আকাশে ভেসে বেড়ালে মাটির ওপরের প্রাণী, আমাদের কোনো ক্ষতি নেই। আমরা এর শব্দে, ক্রোধ-গর্জনে, আলোর চমকে ভীত হয়ে কান বন্ধ করব মাত্র। অনিষ্ট থেকে রেহাই পাবার মন্ত্র উচ্চারণ করতে থাকব। নিরাপদ স্থানে যাওয়ার জন্য ছুটব বড়জোর অঝোর বৃষ্টিতে পাতার স্নান দেখব। গর্জন ও আগুন বৃষ্টির জলের কুয়াশায় মিশে যাওয়ার পরে, আবারও ছড়া কাটতে কাটতে ঘুমিয়ে পড়ার আয়োজন করতে পারব। কিংবা, উঠোনে, নিজস্ব বৃষ্টির জল-সুতোয় বেঁধে নেব আমরা নিজেকে। উচ্ছল হাসিতে ভরে উঠবে আমাদের প্রিয় গৃহকোণ। মনে পড়ে, “you do not own the rain, or the trees, or the laws which pertain to them.” (Mary Oliver : Her Grave)
কিন্তু বিপত্তি তখন, যখন বোমার আকারে আগুন উড়ে আসে আকাশ থেকে। হিরোশিমা, নাগাসাকির কথা পৃথিবী জানে। হয়তো তখন শিশুরা ছিল ঘুমে বা স্কুলে, চাকরিজীবীরা পথে, অফিসে। বয়স্করা ফুলঘেরা বারান্দায় চায়ে মগ্ন। তখনই অবরুদ্ধ আগুন এসে ফেটে পড়ল জাপানের এই দুই জনপদে। কীরকম নিষ্ঠুরতা পোষণ করলে, এমন কাজ করা সম্ভবপর হয়! যে ব্যক্তি পারমানবিক বোমা ফেলছে, সে তো জানছে, এর পরিণতি। মুহূর্তে ঝলসে যাবে, মাটি, মানুষ, গাছপালা, আশেপাশের সবকিছু। কতটা কাল বিকলাংগ হয়ে জন্ম নিয়েছিল শিশুরা এই শহরে। তবু আমরা মানবতার কথা শুনি এইসব মানুষ-রূপীদের মুখে।
আকাশের উল্কা আমাদের দৃষ্টিতে আসে। এই উড়ন্ত আগুনের নদী-স্রোত পৃথিবীর কোথাও বয়ে গেলে সেখানে গভীর ক্ষত হয়। মাটির বুকে দীর্ঘ কলঙ্ক হয়ে দগ্ধতার দাগ এঁকে দেয়। কিছু উল্কা বা ধুমকেতু আকাশেই বিলীন হয়ে যায়। তখন তা আর আমাদের ক্ষতির কারণ হয় না। রাতের গভীরে ঝিকিমিকি তারকারাজিও আমাদের মুগ্ধ করে। তাদের গা আগুনে ভরা। অতিদূরে নিজের পথে তারা ক্রমধাবমান। এক নিরন্তর, নির্ধারিত পথে তাদের বিচরণ। আমাদের অতিআপন নিকট-আগুনের গোলক হলো সূর্য। সেও সারা অঙ্গে আগুন মেখে ঘুরে বেড়ায়। নিজের মতো করে। কখনো সুদীর্ঘ শিখা ছুঁড়ে মারে। তবে তা পৃথিবীর আাকাশে আসে না। আসে, তার প্রাণশক্তি আর প্রণোদনা। সূর্য দূর থেকেই ধরণীর প্রাণের চঞ্চলতার চিহ্ন আঁকে। সে জন্য তার অগ্নি-আশির্বাদের। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, আামাদের পৃথিবী চারদিক থেকে আগুনে ঘেরা। তবু এক অপার রহস্যে, স্রষ্টার করুণায় আমাদের নিরাপদ বলয়ে বাস।
পাহাড়ের লাভা লুকোনো তার তলায়। কেউ জানে না পর্বতের ঘুমের আড়ালে কী অঢেল তরল আগুনের তৃষ্ণা। মৃত্তিকা, বনভূমি, প্রান্তর, উপত্যকা, নদী-জলাশয়, সাগর ও সমূহ সৃষ্টি.. এসবের অনড় পেরেক হয়ে, অবিশ্রান্ত প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে থাকে পর্বতমালা। তাই নিরাপদে আমাদের মালা বিনিময় হয়। সুখ-উল্লাস-হাসিতে ঘর ভরা থাকে। তবে, যখন পাহাড়ের কান্না আসে, ওঠে আসে ক্রোধরূপ লাভার উত্তাপ, তখন পুড়ে যায় ইটালির হাসি-উচ্ছ্বল পম্পেই শহর।
মানুষ বড় বিপজ্জনক প্রাণী। বাঘ, সিংহ তাদের স্বভাবগত তাড়নায়, প্রয়োজনে অন্যপ্রাণী শিকার করে। তাদের মাংস খায়। আর মানুষ পরিকল্পিতভাবে, প্রদত্ত শ্রেষ্ঠ বুদ্ধির বলে নানা কৌশলে অন্যের ক্ষতি করে। প্রসঙ্গত, গাজা পরিস্থিতি বিশ্ব জানে। আগুন ছড়িয়ে দিচ্ছে ইসরায়েল প্রতিদিন। প্যালেসটাইনের কোনো স্থান নিরাপদ নয়। বছরের পর বছর আঁটকে রেখে অত্যাচার ও হত্যা তাদের উল্লাসের বিষয়। তবু সমগ্র পৃথিবী আশ্চর্যজনকভাবে নীরব। কোনো কার্যকর কথা বা পদক্ষেপের, পন্থার বাস্তবায়ন নেই। অত্যাচারীরা ভাবে, তাদের কেউ দেখার নেই। কারও কাছেই কৈফিয়ত দিতে হবে না। তারা ভুলে যায় এইকথা ভাবতে, “See how the violets are opening, and the leaves unfolding, the streams gleaming and the birds singing. What does it make you think of?”
আমরা যেন সর্বনাশের আগুনকে নিরাপদ দূরত্বে রাখি। উপকার পাবার আশা করা যাবে তখনই। প্রকৃত শিক্ষার প্রয়োজন সে জন্য। উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস্ যেমনটা বলেছেন, “Education is not the filling of a pail, but rather the lighting of a fire.” আর নাম না জানা অন্য একজনের ভাষ্য, “Talent is a flame, Genius is a fire.” এই প্রতিভা, আগুনরূপে ধ্বংসকরভাবে ছড়ানোর নয়, বরং মানুষ হিসেবে আমাদের মনপাত্র যেন পরিপূর্ণ থাকে কল্যাণকর আগুনের আভায়। “The mind is not a vessel to be filled but a fire to be kindled.”
লেখক: কবি, কথাসাহিত্যিক, অনুবাদক, প্রবন্ধকার। প্রাক্তন প্রভাষক, ইংরেজি বিভাগ, ঝিকরগাছা মহিলা কলেজ, যশোর।