বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

শান্ত পাহাড়ে অশান্তি ও তৃতীয় পক্ষ

  • সম্পাদকীয়   
  • ৭ অক্টোবর, ২০২৫ ২২:৪৪

পাহাড় ও অরণ্যের রাখিবন্ধনে চিরসবুজ পার্বত্য চট্টগ্রামের গুরুত্ব বহুমাত্রিক- যা একসময় বাংলাদেশের বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের অধীনে বৃহত্তম একটি জেলা ছিল। আঞ্চলিক, ভূ-রাজনৈতিক ও ভূ-কৌশলগত দৃষ্টিকোণ থেকেও খুবই গুরুত্বপূর্ণ এ অঞ্চল। ভারত মহাসাগরের প্রবেশপথে বঙ্গোপসাগরের উপকূল থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংযোগস্থলে অবস্থিত। মেরিটাইম রুট ও সমুদ্র বন্দরের গুরুত্ব বিবেচনায় ভূ-খণ্ডটি নিছক একটি ভৌগলিক অঞ্চলই নয়, বরং এর উত্তরে ভারতের অংশবিশেষসহ চীন, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর এবং উত্তর-পূর্বে ভারতের সেভেন সিস্টার্স এলাকা এবং পূর্বে মায়ানমার তথা আরাকন অঞ্চল- এসব কিছু মিলিয়ে এটি একটি ভূ-কৌশলগত অতিগুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। গত কয়েক দশক থেকে দেশি-বিদেশি নানা ষড়যন্ত্রের শিকার যা এখনো চলমান। পাহাড়কে অশান্ত করার ক্ষেত্রে বার বার আসছে তৃতীয় পক্ষের নাম।

খাগড়াছড়ির গুইমারায় সম্প্রতি ঘটে যাওয়া সহিংসতা ও সংঘর্ষের ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক। এই অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সূত্রপাত হয় খাগড়াছড়ির সিঙ্গিনালা এলাকায় মারমা জাতিগোষ্ঠীর এক কিশোরীকে দলবেঁধে ধর্ষণের অভিযোগ থেকে। এ ঘটনায় সেনাবাহিনীর সহায়তায় পুলিশ শয়ন শীল নামে ১৯ বছর বয়সি এক তরুণকে গ্রেপ্তার করে। কিশোরীকে ধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদে ‘জুম্ম ছাত্র-জনতা’র ব্যানারে প্রথমে বিক্ষোভ ও পরে সড়ক অবরোধের মতো কর্মসূচি ডাকা হয়। কর্মসূচির কারণে চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি, খাগড়াছড়ি-রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি-সাজেক সড়কে যান চলাচল বন্ধ থাকে। পরিস্থিতি অবনতি হলে শনিবার দুপুরে খাগড়াছড়ির গুইমারায় ১৪৪ ধারা জারি করে উপজেলা প্রশাসন। কিন্তু এর মধ্যেই সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে এবং রামেসু বাজারে আগুন দেওয়া হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে অবরোধকারীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘর্ষে হলে তাতে তিনজন নিহত ও সেনাবাহিনীর মেজরসহ অন্তত ২০ জন আহত হন। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) বিবৃতিতে সহিংসতার জন্য পাহাড়ি সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট–ইউপিডিএফকে দায়ী করে। সেখানে বলা হয়, বিগত কয়েক দিনের ঘটনা পর্যবেক্ষণে এটি স্পষ্ট যে, ইউপিডিএফ এবং তার অঙ্গসংগঠনসমূহ পার্বত্য চট্টগ্রামকে অস্থিতিশীল করার লক্ষ্যে সুপরিকল্পিতভাবে এলাকার মহিলা এবং স্কুলগামী কোমলমতি শিশুদের বিভিন্ন পন্থায় নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণে বাধ্য করছে।

পাহাড়ে হঠাৎ এমন অশান্ত পরিস্থিতিকে দেশী বিদেশী ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে। গেল কদিন আগে চট্টগ্রাম বন্দর দখলের হুমকি দেন ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ত্রিপুরার রাজনৈতিক দল ত্রিপুরা মোথা পার্টির শীর্ষ নেতা প্রদ্যুৎ মাণিক্য দেববর্মা। তিনি বাংলাদেশকে ভেঙে ফেলার হুমকিও দেন। যার রেশ কাটতে না কাটতে পার্বত্য চট্টগ্রাম অশান্ত, ছড়িয়ে পড়ছে জনমনে নানা বিভ্রান্তি। ভারতীয় মিডিয়াগুলো উসকানিমূলক খবর ও অপতথ্য ক্যাম্পেইন করছে। ভারতীয় মানবাধিকার সংস্থ রাইটস অ্যান্ড রিস্কস অ্যানালাইসিস গ্রুপ (RRAG)-এর মতো মানবাধিকার সংগঠনগুলো এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জাতিসংঘের হস্তক্ষেপের এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হস্তক্ষেপের আহ্বান জানিয়েছে। এই মানবাধিকার গোষ্ঠীটি জানিয়েছে যে, গুইমারার ঘটনাটি চলতি সপ্তাহে জেনেভায় অনুষ্ঠিতব্য জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলে তোলা হবে। অভিযোগ আছে দেশি-বিদেশি বেসরকারি সংস্থাগুলো(এনজিও) দীর্ঘদিন ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর অধিকার, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি নিয়ে কাজ করলেও পাহাড় অশান্তের পেছনে তাদেরও ভূমিকা আছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের মোট ১২টি উপজাতি বাস করে। নৃতাত্বিক বিচারে উপজাতি জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই মঙ্গোলীয় শ্রেণিভুক্ত। এখানে বসবাসকারী উপজাতিদের সম্মিলিত সংখ্যা মোট জনসংখ্যার মাত্র ০.৪৫% (দশমিক চার পাঁচ শতাংশ)। তারা বিভিন্ন কারণে বিশেষত নিরাপদ আশ্রয় লাভের সন্ধানে তিববত, চীন, মায়ানমার এবং ভারতের বিভিন্ন পাহাড়ী অঞ্চল থেকে অনধিক ৪০০ বছর আগে বাংলাদেশের ভূখন্ড পার্বত্য চট্টগ্রামে আসে। অধিকাংশ চাকমা ও মারমা বৌদ্ধধর্মের অনুসারী, ত্রিপুরার অধিবাসিরা হিন্দু ধর্মের আর মিজো, বম ও থেয়াং খ্রিস্টান। অন্য কিছু গোত্র আত্মা, প্রাণী ও উদ্ভিদের পূজারী। এদের মধ্যে তুলনামূলকভাবে চাকমারা নবাগত। অনেকেরই নিজস্ব ভাষা থাকলেও এক উপজাতি অন্য উপজাতির ভাষা বুঝে না। এক উপজাতির সদস্য অন্য উপজাতির সাথে কথা বলার সময় বাংলা ভাষা ব্যবহার করে। প্রতিটি উপজাতি বাংলা ভাষা বুঝে এবং নিজস্ব উপজাতির বাইরে আসলে বাংলা ভাষায় কথা বলে।

ভৌগোলিক আয়তনে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলটি লেবানন, সাইপ্রাস, ব্রুনাই, কাতার, সিঙ্গাপুর, মরিশাস কিংবা লুক্সেমবার্গের আয়তনের চেয়েও বড়। আর অবস্থানগত গুরুত্ব বিবেচনা করলে পার্বত্য চট্টগ্রামের উত্তরে ও খাগড়াছড়ি জেলার পশ্চিমে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য, পূর্বে ভারতের মিজোরামের লুসাই পাহাড়পুঞ্জ ও মায়ানমারের অংশ, দক্ষিণে মায়ানমার, পশ্চিমে সমতল উপকূলীয় চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলা অবস্থিত। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামের ২৩৬.৮০ কিলোমিটার, মিজোরাম রাজ্যের সাথে ১৭৫.৬৮ কিলোমিটার এবং মায়ানমারের সাথে ২৮৮.০০ কিলোমিটার আন্তর্জাতিক সীমান্ত রয়েছে। সমস্যা হচ্ছে আন্তঃজেলাগুলোর মধ্যে পর্যাপ্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা, মোবাইল নেটওয়ার্ক, সুপেয় পানির তীব্র সংকট, বিদ্যুাৎ সংকট, পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যাবস্থা এখনো কার্যকরভাবে গড়ে উঠেনি- যার ফলে সীমান্ত এলাকা মাদক পাচার, অস্ত্র চোরাচালান ও সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে, যা পাহাড়কে হঠাৎ হঠাৎ অশান্ত করে তুলে। যা পাহাড়ি কিংবা বাঙালি কারোরই কাম্য নয়।

১৯০০ সালের ১ মে ব্রিটিশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি প্রভাব খর্ব করার লক্ষ্যে এবং ওই এলাকার স্থায়ী প্রশাসনিক ব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্যে ‘নোটিফিকেশন ১২৩ পিডি’ চিটাগাং হিল ট্রাক্টস, রেগুলেশন ১৯০০ (Chittagong Hill Tracts Regulation 1900) চালু করে। বৃটিশ বেনিয়া উপনিবেশিকদের এই কৌশলের কারণ ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি প্রভাব ও বসতিস্থাপন প্রক্রিয়া বন্ধ করা এবং সেখানে খ্রিস্টান ধর্ম প্রচার করা। প্রায় জনশূন্য এবং সম্পদ সমৃদ্ধ পার্বত্য চট্টগ্রামের উপর বার্মা, আরাকান, চীন ও উত্তর-পূর্ব ভারতের দূরবর্তী অঞ্চল থেকে আগত বসতি স্থাপনকারী উপজাতিদের যতটুকুই দাবী ছিল, অঞ্চলটির কাছের সংলগ্ন চট্টগ্রামের সমতলবাসী বাঙালি জনগোষ্ঠীর ওই অঞ্চলটির উপর অধিকার বা দাবি কোনো যুক্তিতেই কম ছিল না। কিন্তু স্বার্থান্বেষী বেনিয়া ইংরেজরা ন্যায়পরায়ণতার যুক্তিকে লঙ্ঘন করে ষড়যন্ত্রের বীজ বপন করেছিল। যা বিভিন্ন গণমাধ্যমে আমরা এখনো লক্ষ্য করছি।

১৯৫৬ সালে পৃথক অঞ্চলের বিধানের সমাপ্তি ঘটে। এই সালে প্রাদেশিক সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ মর্যাদা খর্ব করে এবং এর সম্পূর্ণ বিলুপ্তি ঘটে ১৯৬৪ সালে আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্র সংবলিত শাসনতন্ত্র প্রবর্তনের মাধ্যমে। মৌলিক গণতন্ত্রের আওতায় পার্বত্য চট্টগ্রাম সমতলের রাজনৈতিক ধারায় মিশে যাওয়ায় সমতলের শাসন বহির্ভূত অঞ্চল (Excluded Area) এর মর্যাদারও স্বাভাবিক অবসান ঘটে। ঐ বছর ম্যানুয়েলের ৫১ অনুচ্ছেদ রহিত করে পাকিস্তানের সর্বত্র সকল নাগরিকের অবাধ বিচরণ নিশ্চিত করা হয় ঢাকা হাইকোর্টের এক রায়ে। তখন থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি বসতি গড়ে উঠতে থাকে। ১৯৮০ সাল পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি মাত্র বৃহত্তর জেলা ছিলো। ১৯৮৩ সালে রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি এই তিনটি প্রশাসনিক পার্বত্য জেলায় বিভক্ত করা হয়।

১৯৯৬ সালে যে পার্বত্য শান্তি চুক্তি করা হয়েছিল তা ছিল পাহাড়কে শান্ত করবার একটি মাত্র পদক্ষেপ মাত্র, যা পাহাড়ে শান্তি স্থাপনের মূল নিয়ামক হয়ে উঠেনি এখনও। তাই পাহাড়ে শান্তি ফেরাতে পাহাড়ি-বাঙালি ভেদাভেদ ভুলে সকলের সম-অধিকার নিশ্চিতকরণ, ভূমি সংক্রান্ত্র বিরোধের যৌক্তিক নিষ্পত্তি, দল উপদলের আধিপত্যকে যথাযথ আইনের আওতায় আনা, ধর্মীয় উস্কানি কিংবা নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দেশি-বিদেশি সকল ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বেকে অটুট রাখতে হবে। পাহাড়-অরণ্যের মেলবন্ধনে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক সম্পদ ও পর্যটনশিল্পের বিকাশ ঘটিয়ে এর আঞ্চলিক গুরুত্ব ও ভৌগোলিক সার্বভৌমত্বকে যথাযথ ব্যবহার করে বাংলাদেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিতে হবে।

পরিশেষে বলা যায় যে, বাঙালি-পাহাড়ি দ্বন্দ্ব, ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ, বিভিন্ন দল ও উপদলগুলোর চাঁদাবাজি, অস্ত্র ও উগ্রবাদীগোষ্ঠীর প্রভাব বিস্তার, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব, ধর্মীয় উস্কানি, স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র ইত্যাদি কারণগুলোই প্রতিবার কোনো না কোনোভাবে পাহাড়কে অশান্ত করছে। পাহাড়ি কিংবা বাঙালি কেউ পাহাড়ে অশান্তি চান না। পাহাড়কে নিয়ে অপরাজনীতি চলছে, ঘুরে ফিরে আসছে তৃতীয় শক্তির নাম- তাই পাহাড়ে শান্তি ফেরানোর দায়িত্ব সরকার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, অংশীজন, বসবাসকারী সব জাতিগোষ্ঠী ও আমাদের সবার।

তানিম জসিম : প্রাবন্ধিক ও রাজনীতি-বিশ্লেষক। সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

এ বিভাগের আরো খবর