বাংলাদেশে আমাদের মতো মধ্যবিত্তদের মাঝে এখন চরম অর্থনৈতিক অস্থিরতা বিরাজমান। বিশেষ করে বর্তমান সময়ে মধ্যবিত্তের দুরবস্থা চরমে মূলত চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ক্রমশ আয় কমে যাওয়া এবং মৌলিক চাহিদা পূরণে হিমশিম খাওয়ার কারণে সৃষ্টি হয়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে, যার ফলে যাদের জীবনে একসময় সুখের প্রবাহ ছিল স্বাচ্ছন্দ্য ছিল, বর্তমানে যাদের চাকরী নাই বিশেষ করে জুলাই আন্দোলনের পর যাদের কর্মস্থল বন্ধ রয়েছে তারা এখন কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি। আয় না থাকা, কর্মসংস্থান নাহওয়া এবং জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি—এই দুইয়ের প্রভাবে মধ্যবিত্তরা তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে হিমশিম খাচ্ছে। সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক বাস্তবতায় সবচেয়ে নীরব অথচ গভীর সংকটে নিপতিত হয়েছে এই মধ্যবিত্ত শ্রেণি। একসময় যারা ছিল আর্থিকভাবে স্বনির্ভর, আজ তারাই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধির কবলে দিশেহারা। ফলে জীবনের মান রক্ষা তো দূরের কথা, বেঁচে থাকাই এখন তাদের জন্য কঠিন হয়ে উঠেছে। সাথে রয়েছে চিকিৎসা ব্যয় ও সন্তানদের শিক্ষা ব্যয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সন্তানের নিয়মিত ফিসমূহ পরিশোধে ব্যর্থ পিতা মাতা মারাত্মক মানসিক বিপর্যস্ত পরিস্থিতিতে রয়েছেন। সংসারের সরবরাহ মিটিয়ে আগে যেখানে মাস শেষে কিছু সঞ্চয় করে সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভাবতেন, তারাই এখন মাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পাড়ার দোকানে বাকি করছেন। কেননা আয় অপরিবর্তিত এবং কোথাও কোথাও নাই বললেই চলে, অথচ ব্যয় প্রতিনিয়ত ঊর্ধ্বমুখী। ফলে আয় ও ব্যয়ের ব্যবধান দিনে দিনে বাড়ছে, যা মধ্যবিত্তের জীবনে নির্মম দহন সৃষ্টি করেছে।
পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের প্রায় ৮২ শতাংশ পরিবার তাদের প্রয়োজন মাফিক আয় করতে পারছে না। এক-তৃতীয়াংশ পরিবার সংসার চালাতে গিয়ে ঋণের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। খাদ্যের পেছনে মাসিক আয়ের ৫৫ শতাংশ ব্যয় হচ্ছে। শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসাভাড়ার মতো মৌলিক খাতেও ব্যয় বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। এই পরিসংখ্যান একদিকে যেমন আর্থিক অনিশ্চিয়তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় নীতির ব্যর্থতাও উন্মোচন করে। বর্তমানে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি ৭.৫৬ শতাংশ এবং খাদ্যবহির্ভূত খাতে মূল্যস্ফীতি ৯.৩৮ শতাংশ। টানা তিন বছরের অধিক সময় ধরে চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির অভিঘাত সবচেয়ে নির্মমভাবে আঘাত হেনেছে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর ওপর। যাদের জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য ছিল, তারাই আজ মৌলিক চাহিদা পূরণে হিমশিম খাচ্ছে। এটি মোকাবিলায় সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বরাবরই সীমিত, দুর্বল এবং ব্যবস্থাপনাগত ব্যর্থতায় জর্জরিত। বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন যথার্থই বলেছেন- দারিদ্র্য বৃদ্ধির মূল কারণ দুটি : মূল্যস্ফীতি ও কর্মসংস্থানের সংকট। গাজীপুরসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে একের পর এক শিল্প কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় হাজার হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন উল্লেখ করার মত এক বেক্সিমকো টেক্সটাইলের প্রায় ৪২ হাজার কর্মীসহ এত বড় একটি প্রতিষ্ঠান আজ প্রায় এক বছর যাবত বন্ধ, গাজী গ্রুপ, নাসা গ্রুপ ও ওই একই কারণে বন্ধ। প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের বেকারত্বের এই প্রবণতা কেবল অর্থনৈতিক ব্যর্থতাই নয়, এটি জাতীয় উৎপাদনশীলতার ওপরও একটি দীর্ঘমেয়াদি আঘাত। যখন একজন দক্ষ শ্রমিককে পেশা বদলে রিকশাচালক বা ফেরিওয়ালা হতে হয়, তখন তা শুধু ব্যক্তিগত পতন নয়- তা রাষ্ট্রীয় নীতির অন্তঃসারশূন্যতার বহিঃপ্রকাশ।
তার পর রয়েছে কর্মকর্তাদের
পারিবারিক অসম্মান এবং সামাজিক মর্যদাহানী, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকার সুদের হার বাড়ানো, আমদানি শুল্ক হ্রাস এবং মুদ্রানীতিতে কড়াকড়ি আরোপ করলেও, নিত্যপণ্যের বাজারে এর কার্যকর প্রতিফলন অনুপস্থিত।
বাজার ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলার অভাব এবং একশ্রেণির প্রভাবশালী ব্যবসায়ীর সিন্ডিকেট-নির্ভর অপশাসনে জনগণ কার্যত জিম্মি। চাল, ডাল, তেল, চিনি ও পেঁয়াজের মতো প্রয়োজনীয় পণ্যে সরকারের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা দুর্বল। এই ব্যবস্থাগত শৈথিল্য ও নীতিগত অবস্থান আগামী দিনে পরিস্থিতিকে আরও দুর্বিষহ করে তুলতে পারে তার উপর রয়েছে করের চাপ, জনগণের আয়ের উৎসই ক্রমশ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সেখানে করের সমাধান কি করে স্বাভাবিক হবে আশা করা যায় । মধ্যবিত্তের মুখে হাসি নেই, সামাজিক অনুষ্ঠানমালাতে উপস্থিতিতে তার প্রতিফলন দৃষ্টিগোচর হয়। অধঃপতনের চরম পর্যায়ে ধাবমান আমাদের যুবসমাজসহ সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ের জনগণ বিশেষ করে মোবাইলের ব্যবহার সহজলভ্য হওয়াতে যুবক যুবতী কিশোর, শিশু এমন কি বৃদ্ধরাও মোবাইল নির্ভর হয়ে পড়াতে সকলেই এক অজানা কারনে কর্মবিমুখ হয়ে পড়ছেন। বিবেকের কাছে প্রশ্ন করলে উত্তর আসবে, অপারগতা, ব্যর্থতা অযোগ্যতার মূলে রয়েছে অভাব আর এই অভাবের কারণেই হয়তো সমাজে ডিভাইজ নামের বৈজ্ঞানিক অবদানের ফজিলতে আমরা সর্বত্রই বিপর্যস্ত ও নিরাপত্তাহীনতায় ও পংগুত্বে ভুগছি। আমাদের হাত, চোখ ও মস্তিষ্ক ও সময় ওই মোবাইলে সীমাবদ্ধ ফলে বর্তমান সমাজের সকল পর্যায়ে অনেক বেশি সচেতনতা বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান তৈরি এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দেশে মুল্যস্ফিতি কমানোর দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া অত্যান্ত জরুরি অন্যথায় সমাজে চরম বিপর্যয় আসন্ন।
সমাজের এক বিরাট অংশজুড়ে আছে এই মধ্যবিত্ত শ্রেণি। শহরে জীবনের চাপ, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, সামাজিক প্রত্যাশার চাপ – এই সবকিছু মিলিয়ে তৈরি হয় মধ্যবিত্তের জীবনে এক অদ্ভুত সংকট। আমি আশাবাদি আজকের লেখাটি মধ্যবিত্ত ছেলেমেয়েদের কষ্টের বিষয়টি নিয়ে লেখাটি যা অনেকেরই ভালো লাগবে।
মধ্যবিত্ত পরিবারের জীবন অনেক সময় নীরব কষ্টে ভরা থাকে। সমাজের এই শ্রেণির ছেলেমেয়েরা প্রায়শই তাদের আবেগ, ইচ্ছা এবং চাহিদাগুলো প্রকাশ করতে পারে না। তাদের কষ্টগুলো অনেক সময় অদৃশ্যই থেকে যায়।এই অব্যক্ত বেদনার লাঘব কবে হবে তা কারো জানা নাই তবে আমরা আশা করবো দেশ পরিচালনায় ন্যস্ত কর্তা র্যক্তিরা মধ্যবিত্তের অভাব দূরীকরণে ও কর্মসংস্থানে এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসহ সকল প্রকার নাগরিক সুবিধা সহজলভ্য করণে দ্রুত সহায়ক হবেন।
লেখক: প্রবন্ধিক, কলামিস্ট।