বাংলাদেশ এখন সংস্কারের এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের খসড়া প্রস্তাবগুলো দেশের রাজনৈতিক ভারসাম্য পুনর্গঠনের সম্ভাবনা দেখালেও বাস্তবায়নমুখী চ্যালেঞ্জ ও আস্থাহীনতা বিদ্যমান রয়েছে। কমিশনের আলোচনায় উঠে এসেছে প্রধানমন্ত্রীর সর্বোচ্চ মেয়াদসীমা সংক্রান্ত বিকল্প-ধারা (এক ব্যক্তি সাধারণত সর্বোচ্চ ১০ বছর পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন বলে এক বিকল্প প্রস্তাব আলোচনায় এসেছে) এবং নির্বাচন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, আইন কমিশন, তথ্য কমিশন ও প্রেস কাউন্সিলের মতো সংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়োগ পদ্ধতিতে রাষ্ট্রপতির ভূমিকা বৃদ্ধির ধারণাÑএই মূল প্রস্তাবগুলো গণমাধ্যমে খসড়া আলোচনার সারমর্ম হিসেবে প্রকাশ পেয়েছে।
এই প্রস্তাবগুলোর আলোচনায় সবচেয়ে গভীর শঙ্কা হলো প্রতিষ্ঠানগত নিরপেক্ষতার অভাব, অর্থাৎ যার ওপর সংস্কার বিশ্বাস করলে ভোটব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা ও তথ্যমঞ্চের স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে কিন্তু যদি নিয়োগপ্রক্রিয়ায় দলীয় প্রভাব বজায় থাকে তাহলে রাষ্ট্রপতির নিয়োগ-ক্ষমতা বাড়ানো কেবল কাগজে বিষয় হবে। নির্বাচন কমিশন, বিচারব্যবস্থা ও মিডিয়া-স্বাধীনতার ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি আস্থা ফিরে না এলে সংবিধানিক পরিবর্তনও টেকসই ফল দেবে না। এই প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় মানবাধিকার ও প্রশাসনিক সংস্কার রিপোর্টগুলো উল্লেখযোগ্য সতর্কবার্তা দিয়ে এসেছে।
বাংলাদেশের গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো সুশাসনের ঘাটতি। দুর্নীতি, প্রশাসনিক অস্বচ্ছতা, আইনের দুর্বল প্রয়োগ, দলীয়করণ, বিচারব্যবস্থার ওপর রাজনৈতিক প্রভাবÑএসব সমস্যা সংবিধান পরিবর্তন দিয়েই সমাধান করা সম্ভব নয়। যুক্তরাষ্ট্র বা জার্মানির মতো রাষ্ট্রে সংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের ওপর এমন আস্থা তৈরি হয়েছে যে রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় এলেও প্রতিষ্ঠানের নীতিমালা ভাঙতে পারে না। কিন্তু বাংলাদেশে এখনো সেই আস্থা গড়ে ওঠেনি। বর্তমানে দেশের গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন বিশ্লেষণ অনুযায়ী, এই সংস্কার প্রস্তাবগুলোকে বাস্তবায়নযোগ্য করতে হলে তিনটি স্তরে কাজ করতে হবে।
প্রথমত, রাজনৈতিক সদিচ্ছা: সরকার ও বিরোধী দল উভয়ের মধ্যে সংলাপের সংস্কৃতি তৈরি করতে হবে। সংলাপের মাধ্যমেই আস্থা পুনর্গঠন সম্ভব।
দ্বিতীয়ত, স্বচ্ছ নিয়োগপ্রক্রিয়া: রাষ্ট্রপতির হাতে নিয়োগ ক্ষমতা বাড়ানোর প্রস্তাব থাকলে তা অবশ্যই স্বচ্ছ, বহুপাক্ষিক ও জবাবদিহিমূলক হতে হবেÑযেমন ন্যাশনাল কাউন্সিল বা একটি স্বাধীন কমিশনের মাধ্যমে।
তৃতীয়ত, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি: প্রশাসন, বিচার বিভাগ, তথ্য কমিশন ও গণমাধ্যমের আর্থিক ও প্রশাসনিক স্বাতন্ত্র্য নিশ্চিত করতে হবে যাতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের সুযোগ না থাকে।
এছাড়া দীর্ঘমেয়াদে দরকার একটি নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতিÑযেখানে ক্ষমতা ভাগাভাগি, সহনশীলতা এবং বিরোধী মতের প্রতি শ্রদ্ধা থাকবে। কেবল সংবিধানের ধারা বদলে গণতন্ত্র টেকসই হয় না; বরং তার প্রয়োগে স্বচ্ছতা, রাজনৈতিক সহনশীলতা এবং নাগরিক অংশগ্রহণই মূল চাবিকাঠি।
অতএব, বলা যায়Ñজাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবিত সাংবিধানিক সংস্কারগুলো নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আশার আলো জ্বালিয়েছে। তবে এই আশাকে বাস্তব শক্তিতে রূপ দিতে হলে প্রয়োজন রাজনৈতিক দলগুলোর আন্তরিক সহযোগিতা, প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধীনতা এবং জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার। যদি এই তিনটি উপাদান নিশ্চিত করা যায়, তবে বাংলাদেশের গণতন্ত্র একটি নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করতে পারবে; অন্যথায়, এই সংস্কারগুলোও কেবল কাগজে লেখা প্রতিশ্রুতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে, এবং বাংলাদেশ আবারও ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের পুরোনো চক্রে ফিরে যাবে।
এই বাস্তবতায় বাংলাদেশ এখন এক ‘পরীক্ষামূলক গণতন্ত্রের’ পর্যায়ে আছেÑযেখানে সাংবিধানিক পরিবর্তনগুলো শুধু আইনি রূপ নয়, বরং রাজনৈতিক সংস্কৃতির পুনর্গঠন হিসেবেও দেখা উচিত। কারণ গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখা মানে শুধু নির্বাচন নয়, বরং প্রতিষ্ঠান, স্বচ্ছতা, জবাবদিহি এবং ক্ষমতার ভারসাম্যকে একসঙ্গে প্রতিষ্ঠা করা।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট বোঝার জন্য আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতাগুলো এখানে অলোচনা করা যেতে পারে। পাকিস্তানের ২০১০ সালের অষ্টাদশ সংশোধনী একটি তাৎপর্যপূর্ণ উদাহরণ। এর আগে প্রেসিডেন্টের হাতে সংসদ ভেঙে দেওয়ার ক্ষমতা ছিল, যা রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বাড়াত। অষ্টাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সেই ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয় এবং প্রেসিডেন্ট কার্যত আনুষ্ঠানিক প্রধানে পরিণত হন। এর ফলে সংসদ ও প্রধানমন্ত্রী শক্তিশালী হয়, যদিও রাজনৈতিক সংস্কৃতির দুর্বলতার কারণে সেই কাঠামোও পুরোপুরি স্থিতিশীল হতে পারেনি। আবার ফ্রান্সের আধা-রাষ্ট্রপতি শাসনব্যবস্থা একটি ভিন্ন অভিজ্ঞতা দেয়। সেখানে যদি প্রেসিডেন্ট এক দলে আর প্রধানমন্ত্রী অন্য দলে থাকেন, তবে এক ধরনের বাধ্যতামূলক ক্ষমতা ভাগাভাগি তৈরি হয়, যাকে কোহ্যাবিটেশন (ফ্রান্সের আধা-রাষ্ট্রপতি শাসনব্যবস্থায় এমন এক পরিস্থিতি, যখন প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী ভিন্ন রাজনৈতিক দলের হয়ে ক্ষমতা ভাগাভাগি করতে বাধ্য হন) বলা হয়। এ অভিজ্ঞতা দেখায়, সাংবিধানিক কাঠামো কখনো কখনো জটিল পরিস্থিতিতেও ভারসাম্যের পথ খুঁজে নেয়। ইতালিতে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি সরাসরি প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের প্রস্তাব দিয়েছেন, যাতে জনগণ সরাসরি ভোট দিয়ে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করবে। এটি হয়তো গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ বাড়াবে, কিন্তু একইসঙ্গে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা সীমিত হয়ে যাবে এবং ভারসাম্য নিয়ে নতুন বিতর্ক তৈরি হবে। তুরস্কের অভিজ্ঞতা আবার একেবারেই ভিন্ন। ২০১৭ সালে সংবিধান সংস্কারের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী পদই বিলুপ্ত করে দেওয়া হয় এবং প্রেসিডেন্টকে সর্বময় নির্বাহী ক্ষমতা প্রদান করা হয়। এতে প্রেসিডেন্ট একাই নিয়োগ, বাজেট এবং জরুরি ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন। সমালোচকরা বলেন, এ সংস্কার গণতন্ত্রের মৌলিক ভারসাম্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এই উদাহরণগুলো বাংলাদেশকে দেখায়, শুধু সংবিধানের ধারা বদলালেই সব সমাধান হয় না, বরং রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধীনতা সমান গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আমরা জানি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এক ধরনের নেকিবাচকতা আছে। আর সেই নেতিবাচকতা কি সহজেই কাগজ কলমে লিখিত আকারে প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে করা যাবে? এ বিষয়ে অনেক বড় প্রশ্ন থাকা সত্ত্বেও আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।
উন্নত রাষ্ট্রগুলোর অভিজ্ঞতা আরও স্পষ্ট করে দেয় ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার প্রক্রিয়া। যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট সরাসরি নির্বাচিত হলেও কংগ্রেস এবং সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে ক্রমাগত ক্ষমতার টানাপড়েন বজায় থাকে। প্রেসিডেন্ট কোনোভাবেই এককভাবে সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। এমনকি কংগ্রেস এবং প্রেসিডেন্টের মধ্যে ক্ষমতার একটি ভারসম্য আছে। যুক্তরাজ্যে প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত প্রভাবশালী হলেও সংসদীয় কমিটি, বিরোধী দলের কঠোর নজরদারি এবং শক্তিশালী গণমাধ্যম তাকে সব সময় জবাবদিহির মধ্যে রাখে। জার্মানিতে বড় কোনো নীতি বা নিয়োগ প্রক্রিয়া দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা ছাড়া এগোতে পারে না। সুইডেনে সংসদই কার্যত সরকারের নিয়ন্ত্রক শক্তি। এমনকি জাপানের মতো উন্নত দেশেও প্রধানমন্ত্রী সংসদ সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত হন। কিন্তু প্রশাসন ও রাজনৈতিক দলীয় কাঠামোর শক্ত নিয়ন্ত্রণ তাকে সীমাবদ্ধ রাখে। এসব উদাহরণ আমাদের বলে দেয়Ñগণতন্ত্র তখনই টেকসই হয় যখন প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী হয় এবং কোনো একটি পদে বা ব্যক্তির হাতে সব ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয় না।
কিন্তু বাংলাদেশে বাস্তবতা ভিন্ন। কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির হাতে যদি নিয়োগের ক্ষমতা বাড়ানো হয়, কিন্তু সেই প্রক্রিয়ায় দলীয় প্রভাব অটুট থাকে, তবে পরিবর্তনটি কার্যত কাগজে সীমাবদ্ধ থাকবে। বিরোধী দল যদি পুরো প্রক্রিয়ায় আস্থা না রাখে, তবে সংসদীয় কমিটিতে নেতৃত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্তও অর্থহীন হয়ে পড়বে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা। নির্বাচন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন কিংবা আইন কমিশন যদি রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত না হতে পারে, তবে তাদের প্রতি জনগণের আস্থা ফিরবে না। এর সঙ্গে আছে সুশাসনের ঘাটতি। দুর্নীতি, প্রশাসনিক অস্বচ্ছতা, আইনের দুর্বল প্রয়োগ-এসব সমস্যা শুধু সাংবিধানিক পরিবর্তন দিয়ে সমাধান হয় না। যুক্তরাষ্ট্র বা জার্মানির মতো দেশে প্রতিষ্ঠানগুলো এতটাই শক্তিশালী যে দলীয় প্রভাব সহজে ঢুকতে পারে না। কিন্তু বাংলাদেশে এখনো প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাতন্ত্র্য নিশ্চিত করা যায়নি।
এ অবস্থায় বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে জরুরি হলো একটি দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরি করা, যেখানে ক্ষমতার একচ্ছত্রকরণ বন্ধ হবে এবং প্রতিটি প্রতিষ্ঠান তার সাংবিধানিক দায়িত্ব স্বাধীনভাবে পালন করবে। নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ হতে হবে, সংসদীয় পর্যায়ে বিরোধী দলের মতামতকে সম্মান করতে হবে, এবং বিচারব্যবস্থা, প্রশাসন ও গণমাধ্যমকে রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত রাখতে হবে। এগুলো সম্ভব হলে তবেই সাংবিধানিক সংস্কারের সুফল পাওয়া যাবে। অন্যথায় ক্ষমতার ভারসাম্যের যে স্বপ্ন দেখানো হচ্ছে, তা কেবল কাগজেই সীমাবদ্ধ থাকবে।
অতএব বলা যায়, বাংলাদেশের সাংবিধানিক সংস্কার এখন এক ধরনের পরীক্ষামূলক প্রচেষ্টা। এসবের বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, বিরোধী দলের আস্থা, এবং শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ছাড়া এই সংস্কারগুলো কার্যকর হবে না। বিশ্বের অভিজ্ঞতা আমাদের স্পষ্ট বার্তা দেয়- গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে হলে শুধু সংবিধান পরিবর্তন নয়, বরং তার বাস্তবায়নে সুশাসন, স্বচ্ছতা এবং রাজনৈতিক সহনশীলতা নিশ্চিত করতে হবে। না হলে এই সংস্কারগুলোও থেকে যাবে আংশিক চেষ্টার প্রতিচ্ছবি, আর বাংলাদেশের গণতন্ত্র আবারও ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের দুষ্টচক্রে আটকে পড়বে।
লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।